রবিবার, তাই হাসপাতালে অনুপস্থিত টেকনিশিয়ান। আলট্রাসোনোগ্রাফি ঘর বন্ধ। আসন্ন প্রসবার গর্ভের সন্তানের অবস্থান জানতে চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন বাইরে থেকে আলট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে আনতে। কিন্তু গর্ভস্থ সন্তানের সেই প্রতীক্ষা করার সময় ছিল না। রাস্তাতেই ওই মহিলার প্রসব শুরু হয়ে যায়। হাসপাতালে ফিরিয়ে আনলেও মহিলার সন্তানকে কিন্তু আর বাঁচানো যায়নি। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহরে রবিবার সকালের এই ঘটনা রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আর একটি দিক উন্মোচন করল। আর বিষয়টি নিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হতেই জানা গেল শুধু বালুরঘাটই নয়, রবিবার কিংবা অন্য ছুটির দিন রাজ্যের সব সরকারি হাসপাতালের আলট্রাসোনোগ্রাফি ইউনিটই বন্ধ থাকে। এসএসকেএম সহ কলকাতার অন্য সব সরকারি হাসপাতালগুলিও তার ব্যতিক্রম নয়।
তা হলে রবিবার ওই ধরনের আসন্ন প্রসবা কোনও রোগী সরকারি হাসপাতালে এলে তাঁদের কি আলট্রাসোনোগ্রাফির জন্য বেসরকারি ক্লিনিকের উপরেই নির্ভর করতে হবে? রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানাচ্ছেন, আপৎকালীন অবস্থা হলে রবিবার বা অন্য ছুটির দিনেও হাসপাতালে ইউএসজি করানো যায়। সে ক্ষেত্রে ‘অন-কল’ ভিত্তিতে টেকনিশিয়ানকে ডেকে এনে সেটা করানো যায়। জেলা হাসপাতালেও এই ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ‘অন কলে’ যেখানে চিকিৎসকদেরই পাওয়া যায় না, সেখানে টেকনিশিয়ানকে ডেকে পাঠালে তিনি আসবেন কী না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন জেলা ও গ্রামীণ হাসপাতালের প্রশাসকেরা। |
বালুরঘাট হাসপাতালে রিন্টু দাস। রবিবার। ছবি: অমিত মোহান্ত |
এই অবস্থায় রবিবার কিংবা অন্য ছুটির দিন বেসরকারি কোনও ক্লিনিকের টেকনিশিয়ানকে সরকারি হাসপাতালে এনে তাঁদের দিয়ে জরুরি কাজ চালানো যায় কী না, সেই প্রস্তাব দিচ্ছেন জেলা হাসপাতালের একাধিক প্রশাসক। না হলে বালুরঘাট হাসপাতালের মতো এমন ঘটনা ঠেকানো যাবে না বলেই তাঁদের অভিমত। তবে রবিবার ওই ঘটনার পরে প্রসূতি রিন্টু দাসের স্বামী সুমন দাস সংশ্লিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুরেশ মণ্ডলের বিরুদ্ধে ‘অবহেলা ও ভর্তি নিয়েও ফিরিয়ে দেওয়া’র অভিযোগও তুলেছেন। হাসপাতাল সুপারের কাছে নালিশও জানান তিনি। বালুরঘাট থানাতেও অভিযোগ জানানো হয়েছে। হাসপাতালের সুপার বুদ্ধদেব মন্ডল ও ওই চিকিৎসক সুরেশবাবু দু’জনেই জানান, রবিবার ছুটির দিনে হাসপাতালের ইউএসজি বিভাগ বন্ধ থাকায় বাইরে থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখাতে বলা হয়েছিল। সুপার বুদ্ধদেববাবু বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।” ওই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুরেশবাবুর অবশ্য দাবি, “প্রসূতিকে ভোর ৬টা ৫ মিনিটে ভর্তি নেওয়া হয়েছিল। গর্ভস্থ সন্তানের শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতে বলেছিলাম। রবিবার ছুটির দিনে হাসপাতালের ইউএসজি বিভাগ বন্ধ থাকায় বাইরে থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেখাতে বলি। তবে তাঁকে ছুটি দিইনি। ফিরিয়েও দিইনি।”
তবে বালুরঘাটের বঙ্গি বাদুরতলার বাসিন্দা সুমনবাবুর অভিযোগ, “ওই চিকিৎসক পরীক্ষা করে আমার স্ত্রী ও সাত মাসের গর্ভস্থ সন্তান সুস্থ রয়েছে বলে জানান। তার পরে বাইরে থেকে ইউএসজি করানোর পরামর্শ দেন। তবে তিনি ছুটি দেওয়ার সময়ে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দেননি।” জেলা রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা কারামন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, “সুপারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলব।”
তবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ওই মহিলাকে ঠিক ভাবে পরীক্ষা করলে ওই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটত না বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য দফতরের অনেকেই। এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য অধিকর্তা স্বয়ং। এ দিনই তাই এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। প্রয়োজনে কলকাতা থেকে তদন্তকারী দল যাবে বলেও স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন। শনিবার নদিয়ার নবদ্বীপ স্টেট জেনারেল হাসপাতালেও এক শিশুর মৃত্যুর পরে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। ওই শিশুর বাবা নবদ্বীপের বাসিন্দা বিমল সাহা বলেন, “আমার ছেলেকে ভর্তি করানোর দু’ঘণ্টা পরে তার চিকিৎসা শুরু হয়। ডাক্তারবাবুর কথা মতো চিকিৎসা করতেও ঢিলেমি করা হয়েছে। এই নিয়ে বলতে গেলে নার্সদের কেউ কেউ দুর্ব্যবহার করেছেন আমাদের সঙ্গে।” তাঁর দাবি, “আমার ছেলেকে অক্সিজেন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। নার্সরা এসে অক্সিজেনের সিলিন্ডারের নলটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমরাই তখন বাধ্য হয়ে কোনও মতে ওই অক্সিজেনের নলটি ছেলের কাজে লাগাতে পেরেছি। তবে তাকে বাঁচানো যায়নি।” হাসপাতালের সুপার স্বপনকুমার দাস বলেন, “অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।” |