সোমবার ছুটির পরেও অফিস ছাড়বেন না সরকারি কর্মীদের একাংশ। তবে, কাজের জন্য নয়। মঙ্গলবার, ধর্মঘটের দিন ‘অনুপস্থিতি’ এড়াতে।
রাজ্য সরকার জানিয়ে দিয়েছে, ২৮ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের দিন অফিসে গরহাজির হলে সার্ভিস রেকর্ডে ছেদ পড়তে পারে। আটকে যেতে পারে পদোন্নতি-ও। সরকারি কর্মীদের প্রতি রাজ্য প্রশাসনের এই কড়া বার্তা পেয়েই নড়েচড়ে বসেছে কর্মীমহল। চাকরি জীবনের মাঝে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে তাই ধর্মঘটের আগের দিন অফিসেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বহু কর্মী।
ধর্মঘট ব্যর্থ করতে মহাকরণ থেকে ব্লক স্তর পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন অফিসে আগের রাতে কর্মীদের রেখে দেওয়ার মূল উদ্যোক্তা তৃণমূলের বিভিন্ন কর্মী সংগঠন। সে দিন স্কুল-কলেজ ‘সচল’ রাখতে শিক্ষকদেরও প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি কোথাও রেখে দেওয়ারও উদ্যোগ চলছে। তবে, আইএনটিইউসি অনুমোদিত কর্মী সংগঠন ধর্মঘটের বিরোধিতা করলেও সরকারি অফিসে রাত জাগার বিরোধিতা করেছে। আর ধর্মঘটের সমর্থনকারী কো-অর্ডিনেশন কমিটি অবশ্য এই উদ্যোগ নিয়ে হেলদোল দেখাতে নারাজ।
সব মিলিয়ে পরিবর্তনের আমলে ধর্মঘট ব্যর্থ করতে এমন ‘নজিরবিহীন’ ব্যবস্থার সাক্ষী থাকতে চলেছে রাজ্য, যে দিন অফিস ছুটির পরেও মহাকরণ থেকে জেলার কোনও ব্লক অফিস রাত জাগবে।
নতুন সরকারের আমলে এটাই প্রথম ধর্মঘটের ডাক। অতীতে বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে এমন ধর্মঘট সরকারি মদতে পুরোপুরি বন্ধের চেহারা নিত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, তিনি এই রাজ্যকে অচল করে দেওয়ার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সেই কারণে ধর্মঘটের দিন সরকারি অফিস-কাছারি-সহ জনজীবন স্বাভাবিক রাখতে তাঁর সরকার
যেমন যাবতীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, তেমনই দল হিসেবে তৃণমূলও পথে নেমে সক্রিয় ভাবে ধর্মঘটের বিরোধিতা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এক দিকে, সরকার ও শাসক দলের ঘোষণা। উল্টো দিকে, বামেদের সক্রিয়তাএই দ্বিমুখী অবস্থায় এক অজানা আশঙ্কা থেকে সরকারি কর্মীদের বেশির ভাগই ধর্মঘটের দিন অফিস যাওয়া নিয়ে দোলাচলে ছিলেন। কিন্তু ওই দিন ‘অনুপস্থিত’ হলে কর্মীদের বেতন কাটা, পদোন্নতি আটকে যাওয়া, এমনকী চাকরিতে ছেদ পড়তে পারে। নতুন সরকারের কাছ থেকে এমন কড়া বার্তা পেয়ে ‘বন্ধের ছুটি’ ভুলে এ বার বহু কর্মীই আর কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। তৃণমূল কর্মী সংগঠনের ব্যবস্থাপনায় তাঁরা অফিসে রাত কাটাতেও রাজি।
এই ব্যবস্থাকে পাকাপাকি রূপ দিয়ে ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিবের কাছে চিঠি দিয়েছে তৃণমমূলের দুই সংগঠন। ইউনাইটেড স্টেট গভঃ এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “প্রয়োজনে আমাদের সংগঠনের লোকেরা সরকারি অফিসে রাত কাটাতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়ে মুখ্যসচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও এ ব্যাপারে মৌখিক সমর্থন দিয়েছেন।” তৃণমূলের আরেক সংগঠন ফেডারেশন অব সেক্রেটারিয়েট এমপ্লয়িজ-এর সম্পাদক সঞ্জীব পাল বলেন, “কলকাতা-লাগোয়া জেলা থেকে যাঁরা সদরে অফিস করতে যান, তাঁদের নৈশযাপনের অনুমতি চেয়ে মুখ্যসচিব ও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সোমবার এ ব্যাপারে মুখ্যসচিব নির্দেশিকা জারি করতে পারেন।”
বস্তুত, মুখ্যসচিবের জারি করা ছুটি বাতিলের নির্দেশিকার চাপে স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল থেকে মহাকরণ-জেলাশাসকের দফতর-মহকুমা-ব্লক অফিস পর্যন্ত প্রায় সর্বত্র সাজোসাজো রব পড়ে গিয়েছে। আরও একটি বিষয়ও কর্মীদের ভাবাচ্ছে। তা হল, ‘সার্ভিস রুল’ অনুযায়ী সরকারি কর্মীদের তাঁদের অফিস থেকে ৮ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করার কথা বলা হয়েছে। কর্মীদের আশঙ্কা, যানবাহন চলাচল করেনি, এই কারণ দেখিয়ে কেউ অফিসে না এলে তাঁর বিরুদ্ধে ওই বিধি মেনে ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার।
অতএব, কোনও ঝুঁকি নিতে নারাজ ধর্মঘটের বিরোধীরা। অফিস থেকে কোন কর্মী, কত দূরে বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে কত জন পুরুষ ও মহিলা, তার হিসাব-নিকাশ চলছে। বিশ্বজিতবাবু ও সঞ্জীববাবু দু’জনেই জানিয়েছেন, তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নান রকম নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন, অফিসের কাছাকাছি এলাকার কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে অনেককে থেকে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কলকাতার লোককে বলা হয়েছে, মেট্রো ধরে অফিসে আসুন। বাকিদের অফিসেই রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
কী সেই ব্যবস্থা?
সরকারি হাসপাতালে আগের দিন রাতেই কর্মীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। যেমন, আরজি কর হাসপাতালের দু’টি গেস্ট হাউস খুলে দেওয়া হচ্ছে। এসএসকেএম, বাঙ্গুর, মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা কোয়ার্টারও ও বিভাগের মধ্যে রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্তোষপুরের আক্রায় ডাইরেক্টরেট অব ব্রিক ডেভেলপমেন্টের অফিস। সেখানে কর্মীরা ১৫০ টাকা করে চাঁদা তুলছেন পিকনিক করার জন্য। এমন ব্যবস্থা হচ্ছে আরও অনেক সরকারি অফিসেই। কোথাও রান্না হবে গেস্ট হাউসে। কোথাও হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে খাবারের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এন্টালিতে স্বাস্থ্য দফতরের গ্যারাজে চালকদের আগের দিন রাত থেকে থাকতে বলা হয়েছে। সেখানে রান্না করে খাওয়া হবে। হুগলির একটি কলেজের শিক্ষকেরা স্থানীয় হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করছেন। বহু স্কুলে শিক্ষকেরা রাত কাটানোর কথা ভাবছেন।
বিধাননগরে সব কটি সরকারি অফিসেই রাতে থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে। সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টর সচল রাখতে ব্যাপক সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। পেট্রোলিং করে নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে পুলিশ।
ধর্মঘট ব্যর্থ করে সে দিন অফিসে হাজিরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইএনটিইউসি অনুমোদিত সরকারি কর্মীদের সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-ও। সংগঠনের সম্পাদক সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা ধর্মঘটের দিন অফিস করব। তবে ধর্মঘট সফল কিংবা ব্যর্থ করার জন্য বলপ্রয়োগের আমরা বিরোধী।” কিন্তু তাঁরা অফিসে রাত কাটাবেন না।
কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, রাজ্যের মোট ৪ লক্ষ সরকারি কর্মীর মধ্যে ৯০% রয়েছে তাঁদের সঙ্গে। এঁদের মধ্যে নীরবে প্রচার হয়েছে। তাই সরকারি কর্মীদের সিংহ ভাগ ধর্মঘটের পক্ষেই থাকবেন। কিন্তু ওই নির্দেশিকা? তাঁর জবাব, সার্ভিস রুলে কর্মীদের ধর্মঘট করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তা সংশোধন না করে সরকার কিছু করতে পারে না। তাই দেখা যাক, কী হয়।” |