বড় শিল্প হওয়া কঠিন
চলতি মাসেই জমি-তথ্য চাইলেন অসন্তুষ্ট মুখ্যমন্ত্রী
রাজ্যের ‘জমি ব্যাঙ্ক’ তৈরির কাজের অগ্রগতিতে খুশি নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের ১৮টি জেলা এবং সরকারি দফতরগুলি যে ভাবে তাদের হাতে থাকা জমির খতিয়ান পেশ করেছে, তাতে ‘কাজের কাজ’ কিছু হবে না বলেই মনে করছেন তিনি। তাঁর এই ‘অসন্তোষের’ কথা উল্লেখ করে সব জেলাশাসক এবং বিভাগীয় সচিবদের চলতি মাসের মধ্যে নির্ভুল (এরর ফ্রি) রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ভূমি-রাজস্ব কমিশনার রামদাস মিনা।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি জারি করা ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সরেজমিন তদন্ত না-করেই জমি সংক্রান্ত যে তথ্য পেশ হয়েছে, তা নির্ভরযোগ্য নয় এবং কোনও কাজে আসবে না। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সব আধিকারিককে ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জমি ব্যাঙ্ক সংক্রান্ত নির্ভুল তথ্য জমা দিতে বলুন। কী ভাবে এই তথ্য জমা দিতে হবে, তারও উল্লেখ রয়েছে ওই নির্দেশনামায়। ২৮ তারিখের মধ্যে সব তথ্য বিশেষ সংবাদবাহক মারফত ভূমি-রাজস্ব দফতরে পাঠাতে বলেছেন মিনা। যাতে ২৯ তারিখ মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট পেশ করা যায়।
সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, জেলা এবং রাজ্য সরকারি দফতরগুলির কাছ থেকে জমি ব্যাঙ্কের ব্যাপারে প্রাথমিক যে তথ্য মিলেছে, তা মোটেই ‘আশাব্যঞ্জক’ নয়। সেই তথ্য বলছে, সরকারের হাতে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ একর খাস জমি থাকলেও তার অর্ধেকের বেশি হয় জবরদখল হয়ে রয়েছে, না হয় আটকে রয়েছে আইনি জটিলতায়। এখানেই শেষ নয়। এক লপ্তে কয়েকশো একর জমি প্রায় কোথাওই নেই। ফলে মূলত যে কারণে জমি ব্যাঙ্ক তৈরির কথা ভাবা হয়েছিল, সেই বড় শিল্পের প্রয়োজন যে মিটবে না, সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারি কর্তারা মোটামুটি নিশ্চিত।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরে রাজ্যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ যখন কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, তখন জমি ব্যাঙ্ক তৈরির কাজে হাত দেয় তৎকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। নতুন সরকার আসার পর সেই কাজ অনেক বেশি গতি পায়। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ঘোষিত নীতিই হল, বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকার নতুন করে কোনও রকম জমি অধিগ্রহণ করবে না। ফলে এখনই রাজ্য সরকারের হাতে কতটা জমি আছে, সেই পরিসংখ্যান হাতের সামনে থাকলে শিল্প সংস্থাগুলিকে সেখান থেকেই জমি দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছিল।
ভূমি-রাজস্ব দফতর গত কয়েক মাস লাগাতার তাগাদা দিয়ে যে প্রাথমিক তথ্য আদায় করেছে তা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৮টি জেলা প্রশাসনের হাতে থাকা সরকারি ‘খাস’ জমির পরিমাণ ৫ লক্ষ ৮৩ হাজার একরের মতো। এর মধ্যে ফাঁকা জমি ২ লক্ষ ৬০ হাজার একর। বাকি জমির মধ্যে ৮০ হাজার একর ঘিরে মামলা চলছে। আড়াই লক্ষ একরের কাছাকাছি জমি জবরদখল হয়ে রয়েছে। অন্য দিকে, রাজ্যের ৫৫টি দফতরের মধ্যে ৫২টির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের হাতে থাকা জমির পরিমাণ ৫২ হাজার ৬৫১ একর। কিন্তু ফাঁকা জমি মাত্র ২০ হাজার একর।
এই ফাঁকা জমিরও বেশির ভাগটাই বড় শিল্প গড়ার কাজে লাগানো যাবে না বলে সরকারি কর্তাদের অভিমত। তাঁদের বক্তব্য, জেলাগুলিতে ফাঁকা জমি যেখানে রয়েছে, তাতে শিল্প করতে গেলে মূলত তিনটি সমস্যা হবে। প্রথমত, জমির চরিত্রজনিত সমস্যা। দ্বিতীয়ত, পরিকাঠামোর সমস্যা। তৃতীয়ত, এক লপ্তে বেশি জমি পাওয়ার সমস্যা। তাঁরা জানিয়েছেন, জমি ফাঁকা থাকলেও তার যা চেহারা ও চরিত্র তাতে শিল্প করা খুব কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই ওই জমির নিকটবর্তী এলাকায় জল-বিদ্যুৎ-নিকাশির মতো পরিকাঠামো নেই। শিল্প গড়তে গেলে নতুন করে ওই পরিকাঠামো গড়তে হবে। যার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। যা জোগানোর মতো অবস্থায় সরকার নেই। লোকালয় বা তার কাছাকাছি যে ফাঁকা জমি রয়েছে, সেখানে আবার সব ধরনের শিল্প গড়া সম্ভব নয়। এখানে উৎপাদনভিত্তিক (ম্যানুফ্যাকচারিং) প্রকল্প করতে গেলে পরিবেশ নিয়ে সমস্যা তৈরি হবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল একলপ্তে বেশি জমি পাওয়া।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বড় মাপের উৎপাদনভিত্তিক প্রকল্প (যেমন, গাড়ি, ইস্পাত, বিদ্যুৎ) করতে হলে বেশ কয়েকশো একর জমির প্রয়োজন। এমনকী, মাঝারি মাপের শিল্পের জন্যও অনেক জমি লাগে। জমি ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একলপ্তে ৫ থেকে ১০ একরের বেশি জমি নেই। একলপ্তে ৫০ থেকে ১০০ একরের মতো জমি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কোথাও এমন জমি পাওয়া গেলেও তা শিল্পের কাজে আদৌ লাগবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
প্রাথমিক তথ্য বলছে, জেলাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমি রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুরে। সবচেয়ে কম কোচবিহার ও দক্ষিণ দিনাজপুরে। দফতরগুলির মধ্যে শিল্প দফতরের হাতে ১ হাজার ৮৮৩ একর, কৃষি দফতরের ২ হাজার ১৯৭ একর, সেচ দফতরের ১ হাজার ৭৩২ একর, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের ৩ হাজার ৭৪৯ একর, নগরোন্নয়ন দফতরের ১ হাজার ৬৮৯ একর, পুর দফতরের হাতে ২ হাজার ৭৭২ একর ফাঁকা জমি রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ক্রীড়ার মতো ১৪টি দফতর জানিয়েছে, তাদের হাতে জমি নেই। 3টি দফতর এখনও কোনও তথ্য জমা দেয়নি।
কিন্তু এই প্রাথমিক তথ্য নির্ভরযোগ্য নয় বলেই মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার কারণ, খাস জমি বাস্তবিক কী অবস্থায় রয়েছে তা খতিয়ে না দেখেই জেলা প্রশাসন এবং দফতরগুলি রিপোর্ট পেশ করেছে। সেই কারণে এ বার ব্লক ও প্লট ভিত্তিতে একেবারে ‘নির্ভুল’ রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে। যদিও তার পরেও ছবিটা বদলানোর সম্ভাবনা নেহাতই কম বলে সরকারি কর্তাদের একাংশের অভিমত।
শেষ পর্যন্ত শিল্পের কাজেই যদি না লাগে, তা হলে জমি ব্যাঙ্কের উপযোগিতা কী?
ওই মুখপাত্র জানান, হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ নির্মাণ-সহ নানা সরকারি কাজের জন্য অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ জমি প্রয়োজন হয়। জমি ব্যাঙ্ক থাকলে সেই জমি পেতে অসুবিধা হবে না। এ ছাড়া প্রতিটি জেলা ও দফতরের নিজস্ব ‘ডেটা ব্যাঙ্ক’ প্রস্তুত থাকবে। ফলে নিজেদের জমি থেকেই তারা সেই কাজ করতে পারবে। কারণে-অকারণে জমির জন্য তাদের ভূমি দফতরের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। জমির মালিক কে, তাই নিয়ে বিভিন্ন দফতরের মধ্যে বিরোধও কমবে।
তা হলে শিল্পের জমির কী হবে? সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, জমি ব্যাঙ্ক থেকে একলপ্তে বেশি জমি পাওয়া যাবে না ধরে নিয়েই শিল্পের জন্য ‘বিকল্প’ হিসেবে বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার জমির কথা ভেবে রাখা হয়েছে। শিল্প দফতরের এক মুখপাত্র জানান, রাজ্যের বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার তালিকা তৈরি করার জন্য সমীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। এই কাজ সময়সাপেক্ষ। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আগে জানিয়েছিলেন, রাজ্যের বিভিন্ন শিল্পবিকাশ কেন্দ্রে এমন অনেক জমি রয়েছে, যেখানে এক সময় প্রকল্প থাকলেও বহু দিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথবা, জমি নিলেও কোনও দিন প্রকল্পই চালু হয়নি। এই ধরনের জমি চিহ্নিত করে তা ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারীদের তা দেওয়া হবে।
কিন্তু এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত করা যাবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। কারণ, সরকারি-বেসরকারি বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার জমিতে নতুন শিল্প করতে হলে ওই কারখানার বিপুল দেনার ভার বহন করতে হবে নতুন সংস্থাকে। সেই ভার বহনে বিনিয়োগকারীরা রাজি হবেন কি না, সেই প্রশ্ন থাকছেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.