এত দিন তাঁর নির্দেশে দলের একাধিক মন্ত্রী মঙ্গলবারের সাধারণ ধর্মঘটে সামিল না-হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। এ বার খোদ মুখ্যমন্ত্রীই সরাসরি রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন জানালেন, “কথায় কথায় বন্ধ-অবরোধ করবেন না। কোনও বন্ধে যাবেন না। রাজ্যকে সচল রাখুন। নিজেদের পরিবারকে সচল রাখুন।”
শনিবার অসংগঠিত শ্রমিকদের এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আবেদনে আরও স্পষ্ট, বামপন্থী-সহ ১১টি শ্রমিক সংগঠনের ডাকা মঙ্গলবারের বন্ধ (নামে ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা ‘সাধারণ ধর্মঘট’ হলেও বিষয়টিকে সাধারণ বন্ধ বলেই উল্লেখ করছে সরকার-সহ বিভিন্ন মহল) ‘ব্যর্থ’ করতে রাজ্য সর্বতোভাবে ‘সক্রিয়’ হবে। বস্তুত, শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মহাকরণে মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, দল এবং সরকারের পক্ষে তাঁরা বন্ধের সর্বাত্মক বিরোধিতা করবেন। যা থেকে ওই দিন গোলমালের আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সিপিএম সূত্রের খবর, তারা বন্ধ করার জন্য ‘সক্রিয়’ হওয়ার কথা এখনও ভাবছে না। বরং দলীয় কর্মীরা যাতে কোনও ‘প্ররোচনা’য় পা না-দেন, সেই মর্মেই নির্দেশ জারি করেছে আলিমুদ্দিন। এমনিতেই বিধানসভা ভোটে পর্যুদস্ত হয়ে সিপিএম যথেষ্ট কোণঠাসা। তার উপর বন্ধে যে আমজনতার বিরক্তি এবং ভোগান্তি হয়, সে সম্পর্কেও তারা সম্যক অবহিত। যদিও সদ্যসমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের অন্দরে স্বীকার করেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বন্ধের বিরোধিতা করে তিনি ‘ভুল’ করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার সর্বতো ভাবে বন্ধের বিরোধিতায় নেমে আমজনতার কাছেও একটি ‘বার্তা’ দিতে চাইছে। সেই প্রেক্ষিতে জোর করে বন্ধ ‘করাতে’ গেলে হিতে বিপরীত হওয়ারই সম্ভাবনা।
ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই মমতা বন্ধ-অবরোধ নিয়ে ‘কড়া’ অবস্থান নিয়েছিলেন। বিরোধী দলে থাকাকালীনই তিনি বন্ধ-অবরোধের রাজনীতি থেকে ‘দূরত্ব’ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি ‘প্রশাসক’ হিসেবেও যত্রতত্র মিটিং-মিছিল এবং বন্ধের বিরোধিতার বিষয়ে ‘কঠোর’ হওয়ার কথা সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সবই ছিল ‘তাত্ত্বিক’ স্তরে। বাস্তবে সরকারে আসার পর এই প্রথম মমতা একটি বন্ধের ‘মোকাবিলা’ করবেন। কী ভাবে তিনি তা করেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে কৌতূহল তা নিয়েই। তাঁর আমলের প্রথম বন্ধ ‘সফল’ না করার জন্য প্রশাসক মমতার পরামর্শ, “গ্রাম দখলের রাজনীতি করতে দেবেন না। এ রাজ্যে মানুষ অধিকার ফিরে পেয়েছে, তাই তাঁবেদারদের (সিপিএমের) অনেক অসুবিধা হচ্ছে। আপনারা সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখুন।”
প্রস্তাবিত ধর্মঘটের এক সপ্তাহ আগে গত মঙ্গলবারই দলগত এবং সরকারি স্তরে বন্ধের বিরোধিতা করে মমতা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও ভাবেই বন্ধের রাজনীতি তাঁর সরকার বরদাস্ত করবে না। সে কথা বোঝাতে পর্যায়ক্রমে তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক
সদস্য সরকারি কর্মী-সহ শ্রমিকদের কার্যত ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলেছেন, মঙ্গলবার কাজে ‘অনুপস্থিত’ থাকলে বেতন কাটার পাশাপাশি তাঁদের ‘সার্ভিস ব্রেক’-ও হতে পারে। বন্ধের দিনে জনজীবন সচল রাখতে সরকার অনেক বেশি যানবাহন চালানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। রাজ্য জুড়ে এলাকায় এলাকায় দলগত ভাবে বন্ধ-বিরোধী মিটিং-মিছিলের পাশাপাশি মঙ্গলবার পথে নেমে দল ও সরকার যে ‘সক্রিয় ভাবে’ বন্ধের বিরোধিতা করবে, সে কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন মন্ত্রী সুব্রতবাবু। এই পরিস্থিতিতে ‘বন্ধের প্ররোচনায় পা’ না-দেওয়ার কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে ‘বার্তা’ দিলেন।
বাম আমলে শুরু-হওয়া অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রকল্পগুলির আর্থিক সীমা প্রায় দ্বিগুণ করে মমতা এ দিন বলেছেন, “৩৪ বছর ধরে দালালিকে প্রশ্রয় দিয়েছে সিপিএম। এখনও সেটাই করতে চাইছে। আমরা তা হতে দেব না। ওরা (সিপিএম) মানুষের ভাল চায় না। সিপিএমের কোনও প্ররোচনায় পা দেবেন না।”
বন্ধের দিন সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন চালাতে আগেই ‘সক্রিয়’ হয়েছে সরকার। সে দিন যাতে অটো চলে, সে জন্য এ দিন এক দফা ‘হুঁশিয়ারি’ এসেছে পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রের তরফে। মহাকরণে পরিবহণ মন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, কলকাতার ৬০-৭০ শতাংশ অটোরই কোনও বৈধ কাগজপত্র নেই। ‘মানবিক কারণেই’ সরকার এখনও ওই অটো চালকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তবে ধর্মঘটের দিন অটো না-চললে রাজ্য সরকার কড়া পদক্ষেপ করবে। ধর্মঘটের দিন যাতে পরিবহণ কর্মীরা কাজে যোগ দেন, সে জন্য আগামী কাল, সোমবার মদনবাবু বিভিন্ন সরকারি ডিপোয় ঘুরবেন। সেখানকার কর্মী সংগঠনগুলির সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করবেন। মন্ত্রীর অভিযোগ, ধর্মঘটে যোগ দেওয়ার জন্য সিটুর নেতারা নানা ভাবে মানুষকে ‘প্রভাবিত’ করার চেষ্টা করছেন। শ্রমিকদের টানা ছুটি নিয়ে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের ওই সিটু নেতাদের ‘উপদেশ’ না-শুনতে এ দিন ‘অনুরোধ’ করেছেন পরিবহণ মন্ত্রী। তিনি জানান, ধর্মঘটের দিন কোথাও জোর করে যানবাহন আটকানো হলে যে কেউ মহাকরণের হেল্প লাইনে ফোন করে সাহায্য চাইতে পারেন। তিনি নিজে সকাল থেকে পরিবহণ দফতরে থাকবেন। সরকার সব রকম সাহায্য করবে। হেল্প লাইনের নম্বর: ২২১৪-৪০১৪/৫৭০০/৫৫০১।
শিল্পকেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে বন্ধকে সাধারণ ধর্মঘটে পরিণত করতে বামেরা ‘চক্রান্ত’ করছে বলে আগেই সরব হয়েছে তৃণমূল। একই যুক্তিতে সাধারণ ধর্মঘটের বিরোধিতায় সামিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমগুলিতে তাঁদের শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘটে থাকবে না বলে প্রদীপবাবু জানিয়েছেন। ফলে জোট শরিকের ‘সমর্থন’ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।
এ দিন মমতার মঞ্চ থেকেই মন্ত্রী তথা আইএনটিটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রতবাবু বলেছেন, “যাঁরা এখন নানা অধিকারের কথা তুলে রাজ্যকে বিপন্ন করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বলছি, আপনারা সব অচল করে দেওয়ার রাজনীতি থেকে সরে আসুন।” শুক্রবারই তিনি ওই ধর্মঘটকে ‘বেআইনি ও জনবিরোধী’ আখ্যা সরকারের মনোভাব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সরকার তথা তৃণমূলের বন্ধ-বিরোধী ‘সক্রিয়তার’ সৌজন্যে বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষের যে অভিযোগ উঠছে, তার জন্য উল্টে সিপিএমকেই দায়ী করেছেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, “মানুষ এখন শান্তিতে আছে বলে চক্রান্ত করা হচ্ছে। অশান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এই সব চক্রান্তকারীদের যারা মদত দিচ্ছে, তারাও চক্রান্তকারী। মানুষ শান্তিতে আছে বলে এই সব চক্রান্তকারীর ব্যবসা হচ্ছে না।” |