এ বার দিল্লি সফরে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক নিঃশব্দ বিপ্লব করে গিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রের সঙ্গে মমতার সরকারের বিবাদ চলছে। এ বার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে রাজ্যের আর্থিক হাল নিয়ে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা না হলেও, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে মমতা এ বিষয়ে বরফ অনেকটাই গলাতে সক্ষম হয়েছেন। এই বৈঠকের পর মমতা বা প্রণব, দুজনের কেউই মুখ খোলেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে আজ জানা গেল, রাজ্যের আর্থিক হাল ফেরানো নিয়ে প্রণব এবং মমতার সে দিনের বৈঠকে একটা সুনির্দিষ্ট সমঝোতা সূত্র বেরিয়ে এসেছে।
মমতার বক্তব্য ছিল, কেন্দ্র প্রকল্পভিত্তিক টাকা দিলে রাজ্যের আর্থিক সমস্যা মিটবে না। প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নের জন্য টাকার দরকার ঠিকই, কিন্তু মূল সমস্যা হল, বেতন, পেনশন ও ঋণের সুদ মেটানো। শতকরা ৯৫ ভাগেরও বেশি টাকা খরচ হয় এই সব যোজনা বহির্ভূত খাতে। রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা ২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে মমতার প্রশ্ন, ৩৪ বছরের বাম সরকারের এই দায় তাঁর সরকার কেন বহন করবে? এ জন্য প্রত্যেক মাসে রাজ্য সরকারকে মাসুল গুণতে হচ্ছে। নাভিশ্বাস উঠছে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে।
প্রণববাবুর পাল্টা যুক্তি ছিল, এখন কোনও রাজ্যকে ইচ্ছামতো অর্থ দেওয়া যায় না। বিশেষ করে বেতন দেওয়া বা সুদ মেটানোর জন্য তো নয়ই। কারণ, আর্থিক দায়বদ্ধতা আইন তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া, দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শুধু একটা রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য তিনি দেবেনই বা কী করে? অন্য রাজ্যগুলি তো তা মেনে নেবে না। অর্থ কমিশন পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পঞ্জাবকে ঋণগ্রস্ত বলে ঘোষণা করে যে সুপারিশ করেছে, তার ভিত্তিতে আর্থিক সাহায্য দেওয়ার পথ খুঁজতে অর্থ মন্ত্রকের ব্যয়সচিব সুমিত বসুর নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। তাতেও জট কাটেনি।
এই অবস্থায় রাজ্যের নগদ টাকার অভাব মেটাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করে বাড়তি ঋণ নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন প্রণববাবু। গত আট মাসে রাজ্য সরকারের কাজের মূল্যায়ন করে অর্থ মন্ত্রক মনে করছে, মমতার সরকার একটা ভাল কাজ করেছে। তারা প্রতি মাসে বাজার থেকে ঋণ নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে পুরনো দেনা শোধও করছে। প্রণববাবু রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করেছেন, এই দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে রাজ্যকে বাজার থেকে আরও টাকা ঋণ নেওয়ার অধিকার দেওয়া হোক। প্রণব-মমতা বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে, ৩১ মার্চের মধ্যে রাজ্যকে অতিরিক্ত ২৭০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে। এর মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছে রাজ্য।
এর পাশাপাশি, প্রণববাবু মমতাকে বলেছেন, কোনও মাসে বেতন দিতে অসুবিধা হলে ২১ তারিখের মধ্যে তা অর্থ মন্ত্রককে জানাতে। তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে রাজ্যকে আরও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ ব্যাপারে রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য সুমিত বসু ও অতিরিক্ত সচিব অঞ্জলি দুগ্গলকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অসীম দাশগুপ্তর আমলে ‘জাতীয় ক্ষুদ্র সঞ্চয় তহবিল’ থেকে রাজ্য ঋণ নেওয়ার ফলে জটিলতা দেখা দিয়েছিল। এখন অর্থ মন্ত্রক চেষ্টা করছে, রাজ্য যাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) থেকে অনেক বেশি ঋণ পায়। তার জন্য প্রণববাবু নিজে সক্রিয় হয়ে এডিবি-র সঙ্গে কথা বলছেন। এডিবি বলছে, তারা রাজি আছে। কিন্তু রাজ্য সরকারকে আর্থিক সংস্কারের বার্তা দিতে হবে। রাজ্যও জানিয়েছে,
তারা সংস্কার করতে প্রস্তুত। এর জন্য একটি ‘ব্যয় সংস্কার কমিশন’ তৈরির প্রস্তাব রয়েছে। যারা খরচ কমানোর জন্য এক থেকে তিন বছর মেয়াদি সুপারিশ করবে। এতে এডিবি-ও খুশি হবে।
পাশাপাশি মমতা নতুন কর বসাতে না চাইলেও অর্থ মন্ত্রক চাইছে, রাজ্য নিজস্ব কর সংগ্রহের পরিমাণ বাড়াক। মন্ত্রকের প্রস্তাব, অন্য রাজ্য থেকে আসা পণ্যের উপর রাজ্য সরকার ‘এন্ট্রি ট্যাক্স’ বসাতে পার। তাতে ২০০০ কোটি টাকা আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা। এই সব বিষয় নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। পাশাপাশি সড়ক, পরিকাঠামোর মতো ক্ষেত্রে ৮,৭৫০ কোটি টাকার প্রকল্পও অনুমোদন করা হচ্ছে। ১১টি অনগ্রসর জেলার জন্য ১২০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আরও ৮০০ কোটি আগামী সপ্তাহে দেওয়া হবে।
সব মিলিয়ে মমতা দিল্লি এসে প্রধানমন্ত্রী ও প্রণবের সঙ্গে বৈঠক করায় গোটা বিষয়টাতেই একটা গতি এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেই কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও শুধু প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠকের জন্যই মমতা রাতে থেকে যান। প্রণববাবুই মমতার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। মমতার সঙ্গে আলোচনার পরই প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে যান। মমতার সঙ্গে বৈঠকের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দেন। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের ফল যা-ই হোক, মুলায়ম ইউপিএ-তে যোগ দিন বা না দিন, মমতার সঙ্গে তাঁরা যে জোট অক্ষুণ্ণ রাখতে চান সেই বার্তাই দিতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
তবে রাজ্যকে আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে প্রণববাবু বা মমতা কেউই বিশেষ হইচই করতে চাইছেন না। কারণ ১৬ মার্চ কেন্দ্রীয় বাজেট। এখন প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করছেন দেখলে অন্য রাজ্যগুলি চেপে ধরতে পারে। মমতাও খুব বেশি প্রচার চাইছেন না। কারণ, কেন্দ্রের এই ‘সাহায্য’কে মন্দের ভাল বলে মনে করলেও তাঁর বক্তব্য, অতিরিক্ত ঋণে রাজ্যের গভীর আর্থিক সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হবে না। এটা নেহাতই ঠেকনা দেওয়া একটা ব্যবস্থা। সেই কারণে আর্থিক সাহায্যের জন্য কেন্দ্রের উপরে চাপ বজায় রাখবেন তিনি।
আপাতত রাজ্যকে আরও কিছু প্রকল্পভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দিতে রাজি কেন্দ্র। সোমবার সড়ক ও পরিবহণ নিয়ে যোজনা কমিশনে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে যোগ দিতে রাজ্যের পূর্তসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন দিল্লি আসছেন। সেখানে ১৪০০ কোটি টাকা অনুমোদন হবে। কৃষি মন্ত্রকও রাজ্যের জন্য ২৩৯ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। কেন্দ্রীয় কৃষিসচিব প্রবীর কুমার বসু ও কৃষি মন্ত্রকের যুগ্মসচিব, পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের অফিসার, অতনু পুরকায়স্থ এর জন্য সচেষ্ট হয়েছেন।
তা ছাড়া, ৯ মার্চ কেন্দ্রীয় কয়লাসচিব অলোক পেরটি কলকাতা যাচ্ছেন। কয়লার সঙ্কট মেটানোর জন্য দেউচা-পাঁচামি কোল ব্লক রাজ্যকে দেওয়া হতে পারে। ওই ব্লক থেকে ২০০০ মেট্রিক টন কয়লা পাওয়া সম্ভব। কোল ইন্ডিয়া, এনএমডিসি ও রাজ্য, তিন পক্ষ মিলে ওই কয়লা সংগ্রহ করবে। |