গণধর্ষণের জেরে বরাহনগরের এক ঝুপড়িবাসিনীর মৃত্যুর পরে ২৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। পুলিশ শনিবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
দুষ্কৃতীদের পরিচয় জানতে পারে এমন এক জনের নামধাম জানা গিয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও তাকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওই ঝুপড়ির এক বাসিন্দা পুলিশের কাছে বলেছেন, ঘটনার দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পরে তিনি ওই মহিলাকে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কাছে দু’জন অপরিচিতের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিলেন। কিন্তু এর বেশি আর কিছু বলতে পারেননি ওই যুবক। ফলে তদন্তে নেমে এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে পুলিশ। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া গিয়েছে। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি ঘটনার কিনারা করা যাবে।
বৃহস্পতিবার রাত ৩টে নাগাদ ডানলপের এক ঝুপড়িবাসী মহিলা বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের পাশে কাগজ কুড়োচ্ছিলেন। তখন দুই ব্যক্তি তাঁকে একটি ম্যাটাডর ভ্যানে তুলে নিবেদিতা সেতুর নীচে নিয়ে যায়। সেখানে উপর্যুপরি ধর্ষণের পরে ফের গাড়িতে উঠিয়ে শুক্রবার ভোরের আলো ফোটার আগে রাজচন্দ্রপুর এলাকায় ব্যস্ত রাস্তার উপরে ফেলে রেখে চম্পট দেয়। |
এর বেশ কিছু ক্ষণ পরে স্থানীয় লোকজন ও নিবেদিতা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা ওই মহিলাকে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বালি থানায় খবর দেন। তাঁকে উত্তরপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার রাতে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। শনিবার কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে ওই মহিলার ময়না-তদন্ত করায় পুলিশ।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে তদন্তকারী অফিসারেরা জেনেছেন, ধর্ষণের ফলে ওই মহিলার মলদ্বার ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। পুলিশের অনুমান, একাধিক বার ধর্ষণের পরে স্ক্রু-ড্রাইভার বা ভোঁতা রড জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তাতেই অত্যধিক রক্তপাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্থানীয় মানুষজন পুলিশকে জানিয়েছেন, রাস্তার উপরে কাত হয়ে পড়েছিলেন মহিলা। বাঁ হাত বেঁকে মাথার নীচে ঢুকে ছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সমস্ত শরীর। পুলিশ দেখেছে, মহিলার সারা শরীরে মারধরের দাগ ছিল স্পষ্ট। তদন্তকারীদের অনুমান, ধর্ষণের আগে তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল।
তদন্তকারী অফিসারেরা কয়েকটি বিষয়ে আলাদা করে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সেতুর নীচে যে নির্জন স্থানে মহিলাকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি বাইরের কোনও ম্যাটাডর-চালকের সচরাচর জানার কথা নয়। সেই কারণে ওই এলাকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনও লোকই এই ঘটনায় জড়িত বলে মনে করছে পুলিশ। এক পুলিশকর্তা বলেন, “দিনেদুপুরে তবুও স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ওখানে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ওই এলাকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে রাতে পৌঁছনো খুব একটা সহজ নয়।” পুলিশ দেখেছে, যে রাস্তা দিয়ে মহিলাকে ওই নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে বড় ম্যাটাডর ঢোকা সম্ভব নয়। তাই ছোট ম্যাটাডর-ভ্যানই ব্যবহার হয়েছিল বলে পুলিশের অভিমত।
পুলিশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, ধর্ষণ করে পালানোই যদি দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য হবে, তা হলে তারা দ্বিতীয় বার মহিলাকে গাড়িতে তুলেছিল কেন? সেতুর নীচেই রক্তপাত শুরু হয়েছিল ধর্ষিতার। তবে কি ঘটনাস্থল আড়াল করার চেষ্টা করেছিল তারা? যদি ধর্ষণ করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে মহিলার উপরে ওই অমানুষিক অত্যচার চালানো হয়েছিল কেন? তবে কি ধর্ষণের পিছনে কোনও প্রতিহিংসা কাজ করেছে? উত্তর খুঁজছে পুলিশ।
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পাশাপাশি এ দিন তদন্তে নামে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ (সিআইডি)-ও। এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ গোয়েন্দাদের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। পরে যান আইজি (সিআইডি) অধীর শর্মা ও স্পেশাল সুপার দেবাশিস বড়াল। সঙ্গে ছিলেন ব্যারাকপুরের অ্যাডিশনাল ডিসি বিশ্বজিৎ ঘোষ এবং এসি জ্যোতির্ময় দে। বেশ কিছু ক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে তাঁরা সেতুর নীচে নির্জন স্থানে মাটির উপরে চাপ চাপ রক্ত পড়ে থাকতে দেখেন।
এর পরে নিবেদিতা সেতুর লাগোয়া সার্ভিস রোডের উপরে যেখানে ওই মহিলা রক্তাক্ত অবস্থায় শুক্রবার ভোরে পড়ে ছিলেন, সেখানে যান তাঁরা। পুলিশকর্তারা এ দিন মৃতার বড় ছেলে ও রাজচন্দ্রপুরের কিছু বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কথা বলেন নিবেদিতা সেতুর কর্মীদের সঙ্গে। দক্ষিণেশ্বর থেকে সেতু পেরিয়ে রাজচন্দ্রপুরে যাওয়ার রাস্তাগুলো ঘুরে দেখার সময় দোকানদার ও স্থানীয় একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেন তাঁরা।
শনিবার হাওড়ায় পুলিশ কমিশনারেটের কন্ট্রোল রুম ও ওয়েবসাইট উদ্বোধন করার পরে বরাহনগরে গণধর্ষণ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, এই ঘটনা কি পুলিশের ব্যর্থতা প্রমাণ করছে? ডিজি বলেন, “নো কমেন্টস।” |