মৃত্যুর আগেই ‘মারা’ গিয়েছিলেন তিনি!
অন্তত কাগজে-কলমে এমনই দেখানো হয়েছিল। আর তার ‘জোরে’ই উত্তর কলকাতার গড়পাড়ের বাসিন্দা দীপ্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের গোটা বাড়িটা বেদখল হয়ে গিয়েছিল! ডেথ সার্টিফিকেটে তেইশ বছর আগে ‘মৃত’ দীপ্তিদেবী অবশ্য বিষয়টি জানার পরে গত ডিসেম্বরে সশরীরে পুরসভায় গিয়ে বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করেন। সেই সঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, কী ভাবে পুরসভার এক দল কর্মীর যোগসাজসে জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে সম্পত্তি বেদখল করা যায়। বাড়ি পুনরুদ্ধারের পরে অবশ্য তিন মাসও কাটল না। গত শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি সত্যি সতিই মারা গেলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দীপ্তিদেবী।
১০ডি গড়পাড়ের রোডের বাড়ির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা দীপ্তিদেবী। কলকাতা পুরসভায় মিউটেশনের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৯৮ সাল থেকে ওই বাড়িটির মালিক তিনি। গত সেপ্টেম্বরে দীপ্তিদেবীর ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ জমা পড়ে পুরসভায়। তাতে বলা হয়, ১৯৮৯ সালের মে মাসে মৃত্যু হয়েছে দীপ্তিদেবীর। ওই ‘ডেথ সার্টিফিকেটের’ জেরেই দীপ্তিদেবীর গোটা বাড়িটা জনৈক মিনু দাসের নামে মিউটেশন করে দেয় পুরসভা।
দীপ্তি গঙ্গোপাধ্যায় |
বিষয়টি নজরে আসার পরে চোখ কপালে ওঠে দীপ্তিদেবীর। কিন্তু তিনি যে ‘মরেন নাই’, ওই সব নথি যে ‘জাল’, তা প্রমাণ করতে অশক্ত শরীরেই তাঁকে বারবার ছোটাছুটি করতে হয় পুরসভায়। শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে নিজের সম্পতি পুনরুদ্ধার করেন দীপ্তিদেবী। তবে যাঁদের গাফিলতিতে ওই ঘটনা ঘটেছে, পুরসভার সেই কর্মীদের বিরুদ্ধে পুর প্রশাসন এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে পুরসভার অন্দরমহলে। গাফিলতির দায়ে যুক্ত কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিন দিন আগে পুর কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ।
এ দিন দীপ্তিদেবীর এক আত্মীয় বলেন, “মৃত্যুর আগেই নিজের ডেথ সার্টিফিকেট দেখার পর থেকে উনি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। আর আজ সত্যই তিনি চলে গেলেন।”
কী ভাবে ঘটেছিল ওই ঘটনা?
আত্মীয়-পরিজন সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৮ সালে ১০ডি গড়পাড় রোডের বাড়িটি দীপ্তিদেবীর নামে মিউটেশন করে পুরসভা। অবিবাহিত দীপ্তিদেবী ভাইপোদের নিয়ে ওই বাড়িতে থাকতেন। পুরসভা সূত্রের খবর, ২০১১-র সেপ্টেম্বরে জনৈক মিনু দাস পুরসভার কাছে লিখিত এক আবেদনে জানান, তিনি দীপ্তিদেবীর মেয়ে। দীপ্তিদেবী ১৯৮৯ সালের ৭ মে মারা গিয়েছেন। তাই উত্তরাধিকারী হিসেবে তাঁর নামে গড়পাড় রোডের বাড়িটির মিউটেশন করা হোক। ওই আবেদনের সঙ্গে কলকাতা পুরসভা থেকে দীপ্তিদেবীর নামে দেওয়া একটি ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ও জমা দেওয়া হয়। সেই ডেথ সার্টিফিকেটে দেখানো হয়েছে দীপ্তিদেবী বিবাহিত। তাঁর স্বামীর নাম অমরনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। এই ‘ডেথ সার্টিফিকেটের’ ভিত্তিতেই নভেম্বর মাসে মিনু দাসের নামে বাড়িটির মিউটেশন করে দেয় পুরসভা।
দীপ্তিদেবীর এক ভাইপোর কথায়, “ওই মহিলা (মিনু দাস) মিউটেশনের পরে মালিকানার সত্ত্ব দাবি করে উকিলের চিঠি পাঠায় এই বাড়ির ঠিকানায়। তখনই পিসি জানতে পারেন সব কিছু। যোগাযোগ করা হয় পুরসভায়। শারীরিক অক্ষমতা নিয়েই পিসিকে বারবার পুরসভায় যেতে হয়েছে।” সব কিছু জানিয়ে নারকেলডাঙা থানায় একটি অভিযোগও দায়ের করা হয় বলে দীপ্তিদেবীর আত্মীয়রা জানান। |
কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এক মহিলাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে তাঁর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ আসার পরেই আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ওই মিউটেশন বাতিল করতে বলি। এই ঘটনায় ওই দফতরের জড়িতদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছি।” মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলেন, “অভিযোগ আসার পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডেথ সার্টিফিকেটটি জাল। পুরসভা থেকে দেওয়া হয়নি।” পুরসভা সূত্রের খবর, জাল ডেথ সার্টিফিকেটের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেই তা ধামাচাপা দিতে সক্রিয় হয় সংশ্লিষ্ট দফতরের অফিসারেরা। অবশেষে মিনু দাসের নামে দেওয়া মিউটেশন ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাতিল করা হয়।
পুরসভার এক পদস্থ অফিসার বলেন, “আগে যাঁর নামে মিউটেশন করা আছে, তাঁর বর্তমান অবস্থা যাচাই করে তবেই পরবর্তী মালিককে মিউটেশন দেওয়ার নিয়ম। অথচ এ ক্ষেত্রে এক জনের (মিনু দাস) আবেদনের ভিত্তিতেই তাঁর নামে মিউটেশন দেওয়া হল এবং আগের মালিকানার স্বত্ত্ব সম্পর্কে কোনও রকম খোঁজখবর ছাড়াই! এটা শুধুমাত্র চূড়ান্ত গাফিলতি নয়, রীতিমতো অপরাধ। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।”
এ দিন দীপ্তিদেবীর এক আত্মীয় বলেন, “ওঁর মৃত্যুর পর বিষয়টা জানা গেলে বাড়িটাই তো বেহাত হয়ে যেত!” অতীনবাবু বলেন, “পুরসভার এক শ্রেণির কর্মী-অফিসারদের মদতেই এ সব কাজ হচ্ছে। তাঁদের চিহ্নিত করা দরকার। কমিশনারকেও জানিয়েছি, এই ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করা হোক। দীপ্তিদেবীর মতো ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, তা দেখা দরকার।”
পুর কমিশনার অর্ণব রায় অবশ্য এ দিন বলেন, “ওই বিষয়ে ব্যক্তিগত ভাবে আমি কিছু জানি না।” অতীনবাবুর চিঠি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “চিঠি পেলে বলতে পারব।” অতীনবাবু বলেন, “তিন দিন আগেই কমিশনারের কাছে চিঠি চলে গিয়েছে। মৌখিক ভাবেও আমি নিজে ওঁকে বিষয়টি জানিয়েছি।” |