রক্তপাতে মরিনি আমরা, রাজধানী বদলালেও ঘর করি!
শনিবার সন্ধ্যায় টাউন হলে ‘দেশ’ পত্রিকা আয়োজিত বিতর্কসভায় পুর ও শ্রম দফতরের মুখ্য কমিশনার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী এবং অধ্যাপক চৈতালি মৈত্র জোর বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ১৯১১ সাল থেকেই বাঙালির অধোগতি শুরু। সেই যে ১৯১১-র ডিসেম্বরে কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা হল, সেখানেই পশ্চাদপসরণের সূচনা। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীয় কক্ষপথে না থাকলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে পিছিয়ে পড়তে হয়।
অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়ের নেতৃত্বে শিক্ষাবিদ দেবী কর ও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধ্যক্ষ, বিজ্ঞানী শিবাজি রাহা সেই যুক্তিতে মোটেও ভবি ভুলতে দেননি। ‘‘ও ভাবে হয় না। ভারতে দিল্লি, গোয়া, পুদুচেরি, চণ্ডীগড়ে মাথাপিছু আয় সবচেয়ে বেশি। দিল্লি না হয় রাজধানী! কিন্তু গোয়া-পুদুচেরিও রাজধানী নাকি? উন্নতি করার জন্য বেঙ্গালুরুকে দেশের রাজধানী হতে হয়েছে?’’ প্রশ্ন তুললেন ‘সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ’-এর অর্থনীতিবিদ। টাউনহলে সমবেত জনতা তাঁদের কথাই মেনে নিল। ‘বাংলা ও বাঙালির অধোগতির শতবর্ষ (১৯১১-২০১১)’ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি ধ্বনিভোটে পরাস্ত হল।
পরাস্ত? স্কোরবোর্ডে হয়তো সে রকমই লেখা থাকবে। কিন্তু থাকবে না, ধ্রুপদী টেস্ট ম্যাচের মতো রোমাঞ্চকর আবহ ও বিচিত্র যে সব ভাঁজ তৈরি হয়েছিল বিতর্কসভায়, তার কথা। বিতর্কের প্রস্তাব পরাস্ত! কিন্তু ‘বাঙালির অধোগতি’ কেউ উড়িয়ে দেয়নি। “১৯১১ সালকে সূচনাবিন্দু ধরব কেন? অধোগতিটা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। আজ যে দিল্লির কথা বলা হচ্ছে, তার উন্নতি সত্তরের দশকে। ষাটের দশকের গোড়াতেও মহারাষ্ট্র, গুজরাত বা অন্যান্য জায়গার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ শারীরিক-সামাজিক সূচকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিরিখে এগিয়ে ছিল,” বলছিলেন বিবেক। দর্শক তাঁকেই জিতিয়ে দিয়েছে। |
এই জয়টা এসেছে ‘একশো শতাংশ বিশ্বাস’ থেকে। বিতর্ক মানে কী? এক দিকে ১০০, অন্য দিকে ০? নাকি প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে কোথাও তার্কিকের পূর্ণ বিশ্বাস নেই? এক দিকে ৫৫ শতাংশ, অন্য দিকে ৪৫ শতাংশ?
প্রস্তাবের পক্ষে বলতে উঠে এ রকম একটি দার্শনিক প্রশ্নেরও অবতারণা করেছিলেন ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। “১৯১১ সালের ঢের আগে থেকে বাংলা ও বাঙালির অধোগতি শুরু। কৃষিতে উৎপাদন ক্ষমতা অনেক আগে থেকে কমছিল। উনিশ শতকের গোড়ায় রেললাইন ও বাঁধ তৈরি হল। সেখান থেকে এল ‘ম্যালেরিয়া’ নামে অচেনা অসুখ। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই বাংলার ইতিহাস মানে জনশূন্য গ্রাম আর অসুস্থ মানুষ। ১৯০০ সালের তুলনায় ১৯৫০ সালে মাথাপিছু আহার্য শতকরা ২৬ ভাগ কমে যায়,” বলছিলেন তপনবাবু। সোজা কথায় বাঙালির পতনের সূচনাবিন্দু উনিশ শতকের গোড়ায় নিয়ে গিয়েছেন ‘বাঙালনামা’র কথাকার। ‘অধোগতির শতবষর্’ সংক্রান্ত প্রশ্নে পূর্ণ বিশ্বাস তাঁর ছিল না।
বিবেক দেবরায় সেখানেই কব্জা করলেন তপনবাবুকে। ইতিহাসের দর্শন নয়, তিনি অর্থনীতির অঙ্কে আগ্রহী। “তপনবাবু সূচনাবিন্দুকে আরও আগে নিয়ে গেলেন। ১৯০০ থেকে ১৯৫০ সাল অবধি বাঙালির স্বাস্থ্য ও কৃষি-উৎপাদনে অবনতির কথা বললেন। কিন্তু তার পরেরটা বলেননি। অতএব ৫৫-৪৫ নয়। আপনি যদি একশো শতাংশ সহমত হন, তা হলেই প্রস্তাবের পক্ষে বলবেন,” বললেন তিনি। বিবেকই এ দিন প্রস্তাবের বিপক্ষে ধারালো তরবারি।
আর প্রস্তাবের পক্ষে শাণিত ছুরিকা ছিলেন আলাপন। নরেন্দ্রপুরের দুই প্রাক্তনীর দ্বন্দ্বযুদ্ধে মাঝে মাঝেই তার্কিক আগুন ছুটল, লোকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল সেই ফুলকি। বিবেক যতই ১৯১১-র সূচনাবিন্দু উড়িয়ে দিন, আলাপন অনড়। “একটা কোথাও সূচনাবিন্দু ধরতে হয়। গ্রিসের পতন, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মতো।” বিবেক আলাপনদের ঠুকেছিলেন, “১৯১১ কেন? আর একটু পিছিয়ে যান। পৌণ্ড্রের রাজা যে দিন কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবপক্ষে যোগ না দিয়ে কৌরবপক্ষে গেলেন, সে দিন থেকেই অধঃপতন শুরু।” প্রত্যুত্তরে আলাপন, “অতটা পিছোতে পারছি না। রোমিলা থাপার দেখিয়ে দিয়েছেন, আর পাঁচটা ভূমির মতো বঙ্গভূমি গড়ে ওঠে অষ্টম শতাব্দী থেকে। তপনবাবু যেখানকার লোক, সেই বরিশাল জায়গাটা পাঁচশো বছর আগে ছিলই না।”
প্রস্তাবের পক্ষে চৈতালি মৈত্র বাঙালির অধোগতি বোঝাতে গিয়ে এ দিন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘অমার্জিত বিশ্বায়ন’, পরীক্ষার হলে মোবাইলে টোকাটুকি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ এনেছিলেন। শিক্ষাবিদ দেবী কর ছিলেন প্রস্তাবের বিপক্ষে। ‘‘১৯১১ সালে রাজধানী বদল হওয়া ছাড়াও আরও দুটো জিনিস ঘটেছিল। মোহনবাগান ইয়র্কশায়ার ইস্টার্ন রেজিমেন্টকে হারিয়ে শিল্ড জিতেছিল, রবীন্দ্রনাথ জনগণমন লিখেছিলেন। শুধু অধোগতি নয়, ওই বছরে ঊর্ধ্বগতিও ছিল।” বিজ্ঞানী শিবাজি রাহা জানালেন, “প্রবাদপ্রতিম মানুষের সংখ্যা হয়তো কমছে। কিন্তু মেধার প্রাচুর্য কমেনি। বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা এখনও ট্রেন্ডের বিরুদ্ধে গিয়ে মৌলিক গবেষণার কাজ করে।’’
পক্ষে-বিপক্ষে এ ভবেই বারংবার উত্তাল হল সভা। বিবেক দেবরায় প্রস্তাবের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ফ্যালাসি’র দিকেও ইঙ্গিত করলেন, “রাজধানী বদল হওয়ায় কি এমন ক্ষতি হল? উত্তরবঙ্গ বা মেদিনীপুর-পুরুলিয়ার মতো জেলা কি ১৯১১ সালের আগে খুব উন্নত ছিল? বিতর্কের বিষয় তো কলকাতার অধঃপতন নয়, বাংলা ও বাঙালির অধঃপতন।” এই ক্ষুরধার যুক্তির সামনে দর্শক যে ভেসে যাবে, প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেবে অপ্রত্যাশিত নয়।
তা হলে অধোগতির সূচনাবিন্দু কবে? কেউ একমত নন। তপনবাবু বলছেন উনিশ শতকের শুরুতে। আলাপন ধরছেন ১৯১১। বিবেক দেবরায় ধরছেন ষাটের দশক।
খুঁজলে ইতিহাসে অন্য বিন্দুও পাওয়া যাবে। ‘‘১৯১১ সালে কিপলিং বাঙালিদের ‘ক্যালিবান’ বলে ঠাট্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৯২১ সালের পর থেকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাঙালির অবক্ষয় ঘটতে শুরু করে,” ‘অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইন্ডিয়ান’-এর ভূমিকায় লিখেছিলেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
সূচনাবিন্দু নিয়ে নানা জনের নানা মত। কিন্তু নিম্নগতির কক্ষপথটা এ দিনও অস্বীকার করা গেল না! শতবর্ষ হোক না হোক, অধোগতির স্বর্ণজয়ন্তী বা হীরকজয়ন্তী পালনে বাঙালির বিশেষ অসুবিধা নেই। |