রবিবাসরীয় গল্প
অপারেশান পাঁচ কাহিনা
রা হাঁটছে। একসঙ্গে পাঁচ জন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বড় রাস্তায় না গিয়ে ওরা শর্ট-কাট করতে অলিগলির পথ ধরেছে।
বর্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে কবেই! তবু ঝোপঝাড়ের তলায় এখনও লেগে রয়েছে বর্ষার দাগ। গাছের গোড়ায় আটকে আছে বৃষ্টির জলে ভেসে আসা নোংরা-জবরা, সাপের খোলস আর শুকনো পাতাপত্তর।
শুকনো পাতায় পা পড়লে খড়মড়ে আওয়াজ হচ্ছে। আর তাতেই তারা চমকে উঠছে। এই বুঝি সেই বুঝি...
সবাই যেন একসঙ্গে ফিসফিস করে আঁতকে উঠছে, ‘চো-ও-প’!
কেন যে এত সতর্কতা, কেন যে জঙ্গলের ভেতরে বড় রাস্তা ছেড়ে অলিগলির রাস্তা ধরা, তা শুধু তারাই জানে! আর জানেন তাঁদের ঈশ্বর।
কেউ এক জন তিতিবিরক্ত হয়ে বলল, ‘ধুত, অত কীসের ডর! অত কীসের চাপাচুপি! আমরা তো আর অল্যায্য কিছু করতে আর যাচ্ছি না।’
‘তা হলেও সাবধানের মার নেই।’
‘আমার তো মনে হয় বড় রাস্তা দিয়ে দলের সঙ্গে গেলেই ভাল হত। কত লোক যাচ্ছে বেটাছেলে মেয়েছেলে!’
যে বলল তার থুতনি নেড়ে ধরে আর এক জন টিপ্পনী কাটল, ‘দলের গুরুঠাকুর, আহা রে! যাও না কেনে, মাথায় করে নিয়ে যাবে। ওই তো হাঁটা থাপুর থুপুর!’
রাস্তার ধারের একটা পাতাওয়ালা কুড়চি গাছের ডাল ভেঙে বুকের কাছে পার্টির ফেস্টুনের মতো তুলে ধরে হাঁটার ভঙ্গি করে দেখাল সে।
দলটায় ভয়ার্ত হাসির একটা লহর উঠল।

ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে পাঁচ জন। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, ভেতর দিয়ে। জঙ্গলের নামটিও ‘পাঁচ কাহিনা’। একটানা কিছুটা জঙ্গল, মাঝে হয়তো একটুখানি ফাঁকা। ফাঁকা জায়গায় তিল-তিসি কদো-গুঁদলির চাষ। নয়তো সাঁওতাল-মাহাতোদের গ্রাম। ভুট্টাখেত। তার পরে আবার জঙ্গল।
জঙ্গল, জঙ্গল। জঙ্গলের ও ধারে নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুরের পিচ সড়ক। পেরোলেই খড়িকামাথানী হাইস্কুলের মাঠ। সে মাঠে ‘আজ বৈকাল তিন ঘটিকায়...’
আর, ওরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছে। যাকে বলে ‘এক্সোডাস’, বহির্গমন। শাল-পিয়াশাল-ধ-আসন বট-অশ্বত্থের ঝুরির ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে প্রাক-মধ্যাহ্নের রৌদ্র। বাঁদরলাঠি আলকুসির ফল মাথার তালু ছুঁয়ে যাচ্ছে।
‘ওরা’ বলতে মলিনা, নাকফুঁড়ি, টগরী, টিয়া বাগদি আর যমুনাবতী। মলিনার হাতে একটা কবেকার ময়লা রোল করা কাগজ! নাকফুঁড়ি টগরী-টিয়া বাগদির হাত খালি। যমুনাবতীর হাতে জলের বোতল ভরা প্লাস্টিকের প্যাকেট যা একটা।
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে পাঁচ জন। নিরস্ত্র। যেতে যেতে চমকে চমকে উঠছে। সে তো চমকাবেই! এ জঙ্গলে বাঘ-ভালুক-ল্যাকড়া-হুঁড়ার না থাক, যখন দলমার হাতি-গামছায় মুখ বাঁধা শরীরী-অশরীরীদের বাস!

দুই
মলিনা। সংক্ষেপে মলি। ভোর ভোর বুলান-হদহদির ঘাসের ডগায় ধরা শিশিরের জল চোখে ছিটিয়ে চোখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। রোজ যেমন বেরোয়।
হাতে ধরা সেই ময়লাটে রোল করা এক ফর্দ কাগজ। কী-ই না, কাগজ দিয়ে দরখাস্ত লেখানো হবে। পিটিশান। যার ভিত্তিতে সে ‘ড্রাইডোল’ পাবে, ‘রিলিফ’ পাবে, পাবে ‘ওল্ড-এজ-পেনশন’। বার্ধক্য ভাতা।
কবে, কত বছর আগে হীরালাল মুদির দোকান থেকে এক ফর্দ কাগজ কিনেছিল সে! সে কাগজ হাতের মুঠোয় রোল করাই আছে। ঘামে-ময়লায় তা এখন বাসি ঝিঙা ফুল। মলিনার থেকেও ততোধিক মলিন।
তা, দোষ একটু আছে বই কী মলিনার। গ্রামের ছেলেদের হাতের লেখা ওই তো কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং, তার পছন্দ হয় না। সে এমন এক জন দরখাস্ত লেখকের সন্ধানে কিয়াঝরিয়া-বিড়িবাড়িয়া-চঁদরপুর-খান্দারপাড়া গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, কোথায় কোথায় না ঘুরে বেড়ায়! খোঁজ পেলে হাতের ফর্দ কাগজ বাড়িয়ে ধরে বলবে, ‘দে তো বাপ, একখানা পিটিশন লিখে! যা পড়ে আমাদের সরকার বাহাদুর ভয়ে থত্থর করে কাঁপে!’
আজ এসেছিল নদীধারের গ্রাম থুরিয়ায়। মনোরঞ্জন পাতরের বউয়ের কাছ থেকে কোঁচড় ভর্তি মুড়ি নিতে গিয়ে তার মুখেই শুনল, ‘এলা মলিনা, আজ তোর সরকার বাহাদুর আসেটে লো পাঁচকাহিনার সে পারে খড়িকা-মাথানী হাই স্কুলের মাঠে।’
সেই থেকে মলিনা হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে নদীঘাটে টিয়া বাগদির দেখা। হয়তো কোনও ধনী গৃহস্থের মৃত্যুতে মুণ্ডন, ঘাট ক্রিয়াদি চলছে। তাদের বাড়ির বধূরা ঘাটে উঠছে।
টিয়া বাগদি সে দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নদীর পাড়ে বসে কখনও ঝিমোচ্ছে। কখনও পাকুড় গাছের ডালে বসে থাকা গাংচিলের সঙ্গে মনে মনে কথা বলে দেয়ালা করছে।
অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা! কখন বাবুঘরের বউয়েরা, বাবুমেনেরা পরনের ছেঁড়া কাপড় ছেড়ে নতুন কাপড় পরবে। আর সে ছেঁড়া শাড়ি-ধুতি হামলে পড়ে কুড়িয়ে নেবে টিয়া বাগদি। এই রকম দু’দশ ঘরের ফেলে দেওয়া কাপড়েই তো তার পরিবারের সম্বৎসর চলে!
মলিনা প্রথমে চুপিসাড়ে তার চোখ চেপে ধরে পরে কানে কানে সরকার বাহাদুরের আগমনবার্তা ঘোষণা করল।
শুনে তো লাফিয়ে উঠল টিয়া বাগদি। এত দিনে তারও তো কিছু পাওয়া হয়নি সরকার বাহাদুরের ঘর থেকে! বলল, ‘হঁ যামু।’
খালধারে সবে ভাটিতে আগুন দিয়েছিল যমুনাবতী। খালবিলের ঝিনুক পুড়িয়ে ‘কলিচুন’ করা তার পেশা। লোকে তাকে ‘চুনাবতী’ বলেই ডাকে।
পোড়া ঝিনুকের ছাই জলে ভিজিয়ে চুন বানিয়ে সে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে। আগে লোকে কিনতও। এখন তো রেডিমেড চুন দোকানে দোকানে! সহসা কলিচুন আর কিনতে চায় না দক্তাখোররা, খইনিখোররা।
কিন্তু সে বললে কী হবে! সংসারও যে আর চলতে চায় না। জলে ভিজে ভিজে খালেবিলে সেই তো ঝিনুক তোলা। কাঠকুটো জড়ো করে ভাটিতে আগুন দেওয়া...
অর্জুনতলায় গাছের শনশনে হাওয়ায় আসা ঝিমুনি কেটে যাচ্ছিল ভাবনায়। এমন সময় মলিনা এসে কী তাল করল! ভাটিতে আধপোড়া ঝিনুকে জল ঢেলে সে বিদ্রোহ করে বলে উঠল, ‘চ চ, এক্ষুনি চ!’
ক্রমশ দলটা আরও বড় হল। তাদের সঙ্গে এসে জুটল নাকফুঁড়ি, যে কি না মানুষের গায়ের গন্ধ শুঁকে বলতে পারে তার ভূত-ভবিষ্যৎ। আর জুটল মুখ কুঁচকে-মুচকে ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাওয়া টগরী।

তিন
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে পাঁচ জন। হাঁটতে হাঁটতে এ বার ফাঁকা জায়গায় একটা আউশ ধানের খেত পেরোচ্ছে। ঝাঁটি জঙ্গল কেটে সাফ-সুতরো করে বানানো আউশ ধানের খেত। ধানে শিষ এসেছে। শিষগুলি হাওয়ায় ‘লহ লহ’ করছে। টিয়া হরিয়াল উড়ে-ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝেই ডাক শোনা যাচ্ছে কয়ের কপ্তির।
আচমকা কে বা কারা সামনের বড় জঙ্গলে ডালেপাতায় ঝোপেঝাড়ে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ‘হই-হুস হুস’ আওয়াজ করে কাকে যেন তাড়া করছে। জঙ্গল আর সে জঙ্গল নেই। গরু-ছাগল চরাতে এসে বট-অশ্বত্থের ঝুরিতে চিহড় লতার দোলনা বানিয়ে দোল খাওয়ার দিন শেষ!
এই তো ক’মাস আগে ওড়িশা ঘেঁষা এই জঙ্গলে মুখে গামছা বাঁধা শরীরী-অশরীরীরা ধুমসাই-বাঁশকুঠি-নেকড়াসোল-পেলিয়া-কটাশের ও দিক দিয়ে এসে দাপিয়ে বেড়াত। জঙ্গলের গাছগুলোও তখন নাকি হাঁটত-চলত। তা, ‘তেনারা’ সব কি আর ভাগলবা! আঁটারি-চুরচু ডকা-ভাদুগাছের আড়ালে-আবডালে কেউ না কেউ তো আছেই। তবে কি না ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়! বুড়ি-ধাড়ি মলি-নাকফুঁড়ি-টিয়া-টগরী-চুনাবতীর আর হারাবার আছেটা কী?
তবু তারা দৌড়চ্ছে। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’। কিন্তু দৌড়নো কী যায়। এই তো শরীর আর রাস্তাঘাটের হাল। বন কেটে বসত, এখানে ওখানে ঢিবি-ঢাবা, গাছের মুঢ়াকাটির জঙ্গল। পা ছেঁদিয়ে প্রথমে পড়ল মলিনা, তার উপর এক ধারসে বাকিরা।
তবে কি আজ পাঁচকাহিনার জঙ্গল পেরিয়ে খড়িকামাথানী যেতে পারবে না তারা? নিজ হাতে স্বয়ং সরকার বাহাদুরের কাছে ‘পিটিশান’ দাখিল করতে পারবে না মলিনা? ‘এলাহি ভরসা সবিনয় নিবেদং মিদং...’
ফের ভরসা করে উঠে দাঁড়াল ওরা। মলিনার হাতের মুঠোয় ঠিক ধরা আছে রোল করা কাগজটা! তার চোট একটু বেশি, সে খোঁড়াচ্ছে। জঙ্গল ফুঁড়ে উদয় হওয়া লোকটা খানকতক শুয়োর খেদিয়ে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে।
চোখে ঝাপসা দেখা, মুখ কুঁচকে-মুচকে ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাওয়া কামারবুড়ি টগরী ফিসফিস করে বলল, ‘শুঁকি দ্যাক ত নাকফুঁড়রি নোকটা আসলি না নকলি!’
বাতাসে আউশ ধানে দুধ আসার গন্ধ, তার উপর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া শুয়োরগুলোর গায়ের বটকা গন্ধ। নাক টানছে নাকফুঁড়ি। তার বুকের ধুকপুকানিটা আর নেই। আসলে লোকটা তার চেনা, সুখজুড়ির সামাই হাঁসদা।
‘হায় দ্যাখ-অ! চেনা মানুষ অথচ কেমন ডর লাগছে।’
সামাই হাঁসদা বলল, ‘হুঁ, তা দল বেঁধে কোন দিশমে যাওয়া হচ্ছে শুনি?’
রোল করা কাগজ হাতে মলি বুড়িই উত্তর করল, ‘খড়িকামাথানী। সেখানে সরকার বাহাদুর আসছে মিটিং করতে।’ কাঁপতে কাঁপতে সে আরও বলল, ‘আজ একটা হেস্তনেস্ত হবে।’
টাঙির মতো গোঁফের ডগা মুচড়ে সামাই হাঁসদা হাসছে।
‘আচ্ছা যাও ওই দিক দিয়ে সোজা।’ বলল সে। তার পর ‘হেই-হুস-হুস’ আওয়াজ করে শুয়োর খেদিয়ে বলতে বলতে গেল, ‘কিন্তুক বহোৎ দূর যে বুড়িমারা!’
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে পাঁচ জন। আগে আগে যমুনাবতী, সবার পিছনে মলিনা। সে তো খোঁড়াচ্ছে, তাই পিছিয়ে পড়ছে। তার উপর বয়সটাও দেখতে হবে তো! চোখে পিঁচুটি। জিদ্দি মেয়েমানুষ। কোথায় কোথায় না ঘুরে বেড়ায় টঙ্গস টঙ্গস করে।
জঙ্গল আরও গভীর হচ্ছে, গভীরতর। কোথাও বা হনুমান ডাকছে হুপ হুপ করে। ডাকছে বনকপতি কয়ের গুঁড়ুর পাখ। শিহরে উঠছে গা-গতর ভয়ে। ভয় কাটাতে তারা ফিসফিস করে কথা বলছে নিজেদের ভিতর। কী কথা? ব্যাঙের মাথা...
টগরী জিজ্ঞেস করল, ‘এলা মলিনা, তোর সরকার বাহাদুর কালা না ধলা?’
‘জানি না। কোনও দিন তো দেখিনি চোখে!’
টিয়া বাগদি বলল, ‘মোর ভাসুরপো কইথিলান-ধলাই। তিনি নাকি দেখিছেন।’
খানিক চুপচাপ। কথা নেই, শুধুই দশ পায়ের ওঠা-পড়া, থা-পা-র থু-পু-র। জঙ্গলমহালে বনমোরগ বাঙ্ দিচ্ছে।
‘পুরুষমানুষ না মেইয়ালোক?’ এ বার নাকফুঁড়ি নাক তুলল।
ফের টগরী। ‘তুই ত গনৎকার, গন্ধ শুঁকি ক না!’
যমুনাবতী ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘ভগবানের আবার জাত বিচার! নারী না পুরুষ!’
সে খোদার উপর খোদকারিও করে। গ্রামেগঞ্জে কলিচুন বেচার ফাঁকে-ফোকরে দাফন-ছুঁচ কী গাছের কাঁটা ফুটিয়ে গাছের আঠা-হলুদবাটা-তেল সহযোগে পুরুষমানুষ কী মেয়েমানুষের কব্জিতে বুকে বাহুতে নাকের পাটায় চিবুকে উল্কি এঁকে দেয়। খোদানি সে।
টিয়া বাগদিই বলল, ‘মোর ভাসুরপো কইথিলান মেইয়ালোকই।’
হঠাৎ হুড়মুড় করে পড়ে গেল মলিনা, মলিবুড়ি। তার চোখ দু’টি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কাতরাচ্ছে সে। তবে রোল করা কাগজটা শক্ত করে ধরা আছে ঠিক হাতের মুঠোয়।
তার মুখে প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল ঢেলে দিল যমুনা।
‘আঃ! দমে থকে গিয়েছি। তোমরা এগোও! আমি একটু জিরিয়ে নিয়ে আসছি।’ বলেই রোল করা কাগজটা বাড়িয়ে দিল কামারবুড়ি টগরীর দিকে।

চার
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে চার জন। মলিনার হাতের রোল করা কাগজ এখন টগরীর হাতে। গুরুদায়িত্বের ভারে সে খানিক ন্যুব্জ, ঝুঁকে পড়ে হাঁটছে। জঙ্গলে কুয়া-কুইরি যেমন ডাকে, ডাকছে।
চোখে ঝাপসা দেখলে কী হবে, লোহা-পেটা-হাত কিন্তু লোহার মতোই শক্ত। যোগ্য হাতেই পড়েছে মলিনার এত দিনের ধরা অধরা কাগজখানা। যে-সে কাগজ তো নয়, যে কাগজের বয়ানের চাপে সরকার বাহাদুরও ভয়ে থত্থর করে কাঁপবে!
টগরীই ঝাপসা চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন দিকে ঘনঘন দেখছে মলিনা আসছে কি আসছে না! শুঁড়িপথের দু’ধারের ঝোপঝাড়, আঁটারি-চুরচুর ‘লত’ ছেড়ে আসা গলিপথ ক্রমশ ঢেকে দিচ্ছে, কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
জরপ করে টগরী বলল, ‘এলা নাকফুঁড়রি, মলিনা জন্মের মতন রহি গেলা নাকি রে? গনৎ করি ক ত তুই!’
কেউ কোনও কথা বলছে না। চুপচাপ, চুপচাপ। জঙ্গলের মাথার উপর মধ্যাহ্ন সূর্যের খর তাপ, নীচেয় গুমসানি গরম। দম আটকে আসছিল। আরও দু’তিনটে বাঁক কোনও ক্রমে পেরিয়ে এসে টগরী ঘামছে অঝোরঝর। লোলচর্ম, বার্ধক্য ভাতার আশায় আশায় থাকা, এত দিনে কুঁচকে-মুচকে ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাওয়া মুখের কামারবুড়ি ধুঁকছে।
কী-ই বা খায়। লোহা পিটে পিটে হাতের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। আর সে পারে না। তাও তো অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একটা কাটা গাছের গুঁড়ি হাতড়ে সে বসে পড়ল।
নাকফুঁড়ির দিকে হাতে ধরা রোল করা কাগজটা কাঁপা কাঁপা হাতে বাগিয়ে ধরে টগরী বলল, ‘নে ধর! কাগজটা ধরি তোরা আগা। মুই খানিকটা বিশ্রাম নিই।’
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে তিন জন। নাকফুঁড়ি, টিয়া বাগদি আর যমুনাবতী। পিছনে রাস্তার মোড়ে মোড়ে পড়ে আছে মলি, টগরী। রোল করা ফর্দ কাগজ এখন নাকফুঁড়ির হাতে।
গন্ধ শুঁকছে নাকফুঁড়ি কাগজের, জঙ্গলের। হাতের গন্ধ পাচ্ছে মলির, টগরীর। জঙ্গলে এখন বিকালের গন্ধ, বেলা ক্রমশ আড় হচ্ছে। বন্য জন্তুরা ভাতঘুম সেরে আড়মোড়া ভাঙছে। ফের বেরোবে রাতের খাবারের খোঁজে।
সত্যি সত্যি একটা শিয়াল হুলুম-ঝুলুম করে সামনেই রাস্তা পেরোল আর গনৎকারের হয়ে গেল! কোন দিক থেকে কোন দিকে গেল? ডান থেকে বামে, না বাম থেকে ডানে?
গন্ধ আর গণনার মারপ্যাঁচে বসেই পড়ল নাকফুঁড়ি। আশঙ্কা রাস্তা পেরোবে কি পেরোবে না? ভাল হবে কি মন্দ হবে? আসলে ‘ডাইনি’ সন্দেহে কম মারধর তো খায়নি! হাড়গোড় সব ভাঙা। অত দূরের পথ আর হাঁটতে পারছে না।
‘কাগজটা নাও তো টিয়াদি। চুনাবতীর সঙ্গে সঙ্গে যাও। মুই টিকে গণনা করি দেখি। তার পর আসছি।’
অনেকটাই এগিয়ে এসেছে যমুনাবতী। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নাকফুঁড়ি আর টিয়া বাগদি কতটা দূরে। দেখা যাচ্ছে না। ফের জঙ্গলের বাঁকে রাস্তা হারিয়ে যাচ্ছে। শর্টকাটের রাস্তা তো আর পিচের বড় রাস্তা নয়, বড়জোর ‘ভালুক ঝোড়’। ভালুকরাই যেতে পারে গুঁড়ি মেরে। তবে মলিনা, নাকফুঁড়ি, টগরী, টিয়া বাগদি, যমুনাবতী পাঁচ জনেরই এ রাস্তা হাতের তালুর মতো চেনা। বড়খাঁকড়ির হাটে যেতে, শুকনো ডালপালা কুড়োতে পাতা ছিঁড়তে কত বার যে এ দিক দিয়ে শর্ট-কাট করেছে তারা।
দৌড়তে দৌড়তে ওই আসছে টিয়া। হাতের মুঠোয় ধরা মলিনার রোল করা কাগজটা। দেখেই যা বোঝার বুঝে গেল যমুনা। ‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে...’
ক্রমেই পাঁচকাহিনা জঙ্গলমহালের রাস্তা আরওই লম্বা হচ্ছে।

পাঁচ
ওরা হাঁটছে। একসঙ্গে দু’জন। না, ঠিক একসঙ্গে নয়, পিছনে ওই তো দৌড়তে দৌড়তে আসছে টিয়া বাগদি। দৌড় কী আর, দৌড়তে কী পারে? ওই থা-পু-র থু-পু-র থেকে একটু যা ঊর্ধ্বগতি।
যমুনা দাঁড়িয়ে পড়েছিল থমকে। কাছে এসে কোনও মতে হাঁপাতে হাঁপাতে হাতে ধরা মলিনার কাগজটা বাড়িয়ে ধরে টিয়া বাগদি বলল, ‘মোকে টিকে পানি দে যমুনা!’
জল খেল টিয়া। তার পর মাটিতেই ধপাস করে বসে পড়ল, উল্টে গেল। সেই তো নদী ঘাটে ছেঁড়া কাপড় সংগ্রহ করে ঘরে থুয়ে দিয়েই আসা। না খাওয়া না দাওয়া।
‘চিন্তা করবুনি। তুই আগা। সরকার বাহাদুরকে ঘিরি ধর...’
হাতের রোল করা কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই এগিয়ে গেল যমুনা।
জঙ্গল ফাঁকা হচ্ছে। ‘আলো ক্রমে আসিতেছে।’ মুক্তাফলের মতো নভোমণ্ডল না দেখা গেলেও আলো ঝিরিঝিরি আকাশ। দু’ধারের ঝোপঝাড় সরে সরে যাচ্ছে। শুধু যা মাথার উপর আঁটারি লতার ‘ডগ’ হাতি শুঁড়ের মতো দুলছে। যেন যমুনাকে অভ্যর্থনা করে বলছে,‘আসতে আজ্ঞা হোক!’
থেকে থেকে দেখা যাচ্ছিল বাবুই ঘাসের খেত, মাহাতোদের জনার খেত। পাঁচকাহিনা ফরেস্ট বিট অফিসও পেরিয়ে এল যমুনা। হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল সে।
নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুর পিচ রাস্তার উপর উঠে এসে দেখল দু’ধারে কাতারে কাতারে লোক। মাঝখান দিয়ে চলে যাচ্ছে সাদা-কালো, আরও হরেক রঙের সারি সারি গাড়ি। মিটিং শেষ। সরকার বাহাদুর চলে যাচ্ছে...
পিছনে এক বার তাকাল যমুনা। থাকল পড়ে জঙ্গলে টিয়া-টগরী-নাকফুঁড়ি-মলিনা। থাকল পড়ে খাল ধারে তার সাধের চুনাভাটি, কাঁসকুটের থালা-তাটিয়া-গিনা...
সবাইকে চমকে দিয়ে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে সে দৌড়ল গাড়ির পিছু পিছু। আজ যত দূর যেতে হয় যাবে। এক বার শুধু ম্যারাথন রেসের ব্যাটন সেই রোল করা কাগজটা খুলে দেখেছিল। লোকের কব্জিতে বুকে বাহুতে ‘রামসীতা’ ‘মাছের কাঁটা’ ‘লতাপাতা’ আঁকা খোদানির বিদ্যাবুদ্ধিতে বুঝেছিল কিছুই তো লেখা নেই, সাদা!
লেখা নাই থাক। সাদা পাতার সাদা অক্ষরও যদি পড়তে না পারে তবে আর কীসের সরকার?
হাতের মুঠি আরওই শক্ত করে চুনাবতী যমুনাবতী দৌড়চ্ছে।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.