রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
যুদ্ধ করে করবি কী তা বল
প্রথম আফগান যুদ্ধের অব্যবহিত পর ১৮৪৩ সালে, সেনাবাহিনীর যাজক রেভারেন্ড জি এইচ গ্লেগ তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি স্মৃতিকথা লিখেছিলেন। সর্বনাশা সেই যুদ্ধ থেকে হাতে-গোনা যে কয়েক জন বেঁচে ফিরেছিলেন, রেভারেন্ড গ্লেগ তাঁদেরই এক জন। “যুদ্ধ শুরুর পিছনে ঠিকঠাক কোনও কারণ ছিল না, হঠকারিতা আর দুর্বলতার অদ্ভুত মিশ্রণে যুদ্ধটা কয়েক বছর ধরে চলল, শেষ হল ধ্বংস আর যন্ত্রণার আর্তিতে। সরকার এবং সেনাবাহিনী, কারও চেহারাই উজ্জ্বল হল না। ব্রিটেনের রাজনৈতিক বা সামরিক কোনও উপকারেই এল না এই যুদ্ধ। উল্টে যে ভাবে আমরা চলে আসতে বাধ্য হলাম, তাকে পরাজিত সৈন্যের পশ্চাদপসরণ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।”
আফগানিস্থানে আজকের যুদ্ধ সে দিনের প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের মতো ব্যর্থ ভাবে শেষ হবে, ভাবতেও কষ্ট লাগে। তর্ক ওঠার সম্ভাবনা নিয়েও একটা কথা অক্লেশে বলা যায়। প্রাচ্যের কাছে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় সামরিক পরাজয় উনিশ শতকের ওই ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে। পুরনো অস্ত্রশস্ত্র সম্বল করেই আফগান উপজাতিরা সেই সময়ে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জাতিকে পুরোদস্তুর নিকেশ করে দিয়েছিল। তখনকার হিসেবে, ব্রিটেনের ১ কোটি ৫০ লক্ষ পাউন্ড (আজকের অর্থমূল্যে ১০০ কোটি পাউন্ডেরও বেশি) এবং ৪০ হাজারেরও বেশি জীবন সেই যুদ্ধে জলাঞ্জলি গিয়েছিল।
আর আজকের যুদ্ধ? আফগানিস্থানে সম্মিলিত পশ্চিমি শক্তি বা ‘ন্যাটো’ (উত্তর অতলান্তিক চুক্তি সংগঠন)-র হামলা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। আর সেখানে একটি লক্ষণ ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। আফগানিস্থানের পাহাড়ে ব্রিটেনের এই চতুর্থ যুদ্ধের সমাপ্তি প্রথম তিনটি ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধের মতোই! রাজনৈতিক লাভের ঘরে ফক্কা, শোচনীয় পরাজয়ের পর সেনাদের ঘরে ফিরে আসা এবং আফগানিস্থানকে ফের উপজাতি হানাহানির মধ্যে ঠেলে দেওয়া। আরও ভাল ভাবে বলতে গেলে, যে সরকারকে হঠাতে যুদ্ধ শুরু, শেষ অবধি তাদের হাতেই আফগানিস্থানকে ছেড়ে যাওয়া।
একটা ঘটনা যেমন এখনই নিঃসংশয়ে বলা যায়। একদা-ঘৃণ্য তালিবানরা এই যুদ্ধে পরাস্ত তো হয়ইনি, উল্টে নতুন ভাবে সংগঠিত হচ্ছে। পাশ্চাত্য শক্তির আঙুলের ডগায় বাঁধা হামিদ কারজাইয়ের পুতুল-সরকারের ওপর চূড়ান্ত বদলা নিতে তারা তৈরি। সীমান্তের নিরাপদ এলাকা ছেড়ে তালিবানেরা ইতিমধ্যেই কাবুলের কাছে চলে এসেছে, আফগান-রাজধানীর চার পাশে তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ক্রমেই বাড়ছে। আটের দশকের শেষাশেষি সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে থাকা পুতুল সরকারকে হঠাতে মার্কিন মদতে পুষ্ট মুজাহিদিনরাও এ ভাবেই কাবুলের চার পাশে ঘাঁটি গেড়ে বসতে শুরু করেছিল।
মুজাহিদ আমলের সেই পুরনো সিনেমাই যেন আজকের আফগানিস্থানে নতুন ভাবে মুক্তি পেয়েছে। রাজধানী কাবুলের বাইরে বিদেশিদের যাতায়াত মানেই সােঁজায়া ট্যাঙ্ক, সেনাবাহিনীর কনভয় আর হেলিকপ্টার। দেশের ৭০ শতাংশই এখন তালিবান অধিকারে। সেই সব জায়গায় তারা নিয়মিত কর আদায় করে, শরিয়তি শাসন চালু রাখে। প্রতিদিনই সেই সব তালিবানি এলাকা আয়তনে বাড়ছে। পেন্টাগনের সাম্প্রতিক রিপোর্ট, দেশের ১২১টি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক’ এলাকার মধ্যে মাত্র ২৯টি কারজাই সরকারের দখলে। গত বছরেও কাবুলের দার উল-আমান এলাকায় মার্কিন কনভয়ের ওপর আত্মঘাতী হামলায় ১২ জন বেসামরিক ব্যক্তি মারা গিয়েছেন। বাগরাম বিমানঘাঁটিতে মার্কিন সেনার সদর দফতরে গ্রেনেড ও মেশিনগান নিয়ে টানা পাঁচ ঘণ্টা হামলা চালিয়েছিল তালিবান জঙ্গিরা। এবং সেখানেই শেষ নয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফক্সের সফরের আগে কান্দাহার বিমানবন্দরে রকেট ও মর্টার এমন ভাবে আছড়ে পড়তে থাকে যে, দুই মন্ত্রীই তাঁদের সফরসূচি বদলাতে বাধ্য হন।
অতঃপর এক ডজনেরও বেশি আফগান অফিসার আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন। হত্যা করা হয়েছে কাবুলের ডেপুটি মেয়রকেও। হেলমন্দ এলাকায় আফিং ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র মার্জা থেকে তালিবানদের হটিয়ে দিয়েছিল মার্কিন সেনা। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে তালিবানরা সেখানে ফের ঘুরে দাঁড়ায়। মার্কিন মিডিয়ার সহস্র উল্লাস সত্ত্বেও আফগানিস্থানের পরিস্থিতি ক্রমশ তলানিতে।
লাখো লাখো বিদেশি সেনা, তবু রাজধানী কাবুলের রাস্তায় সশস্ত্র দেহরক্ষী ছাড়া পশ্চিমিরা নিরাপদ নন। রাজধানীর উত্তরে পঞ্জশির উপত্যকা, মাজার এবং হিরাট শহরেই জোরদার তালিবান-বিরোধী হাওয়া। সারা আফগানিস্থানে একমাত্র ওই কয়েকটি জায়গায় পশ্চিমি পর্যটকেরা অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারেন। অন্য কোথাও যেতে হলে সেনাবাহিনীর কনভয়!
কাবুলের দক্ষিণে খুর্দ কাবুল আর তিজিন গিরিপথে যাওয়ার সময়েও তাই কনভয়-ব্যবস্থা। ১৮৪২ সালে ওই দুই এলাকাতেই চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৮ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য। আজও ওই এলাকাগুলিই বিদেশি হানাদারদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রতিরোধ-কেন্দ্র। আফগানিস্থানে গত কয়েক দশক ধরে ত্রাণশিবির চালাচ্ছেন যাঁরা, সেই সব কর্মীর মতে, নিরাপত্তা-ব্যবস্থা আগে কখনও এত খারাপ ছিল না। কয়েক বছর আগেও আফগানিস্থান জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হবে, মধ্য এশিয়ার সুইৎজারল্যান্ড হয়ে উঠবে ইত্যাদি দামামা বাজত। এখন সেই সব ধূসর স্বপ্ন। ‘লোনলি প্ল্যানেট’ খুব আশা নিয়ে ২০০৫ সালে তাদের আফগানিস্থান গাইড-বই প্রকাশ করেছিল। গত সাত বছরে সেখানে নতুন তথ্য যোগ তো হয়ইনি, উল্টে সংখ্যাটিও আর ছাপা হয় না।
উনিশ শতকে মধ্য এশিয়া দখলের জন্য রাশিয়া বনাম ব্রিটেনের ‘গ্রেট গেম’-এর পুরনো কক্ষপথেই যেন আজকের যুদ্ধও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৮৩৯ সালে ভুলভাল গোয়েন্দা রিপোর্টের ফলে ব্রিটিশরা আফগানিস্থানে হামলা চালায়। কাবুলে জনৈক রুশ দূতের উপস্থিতি সে বার ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছিল। উচ্চাভিলাষী সেনাকর্তারা কাল্পনিক রুশ আগ্রাসন নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল অহেতুক, অনর্থক এক যুদ্ধ।
শুরুতে সেনাকর্তারাই জিতেছিলেন। অনায়াসে, রক্তপাত ছাড়াই ব্রিটিশরা জিতে যায়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাবুল তাদের হস্তগত হয়। পুরনো জমানা পাহাড়ে পালিয়ে যায়, শাহ সুজা নামের এক দুর্বল শাসককে সিংহাসনে বসানো হল। তার পর কয়েক মাস ধরে ব্রিটিশরা সেখানে ক্রিকেট খেলল, বরফে স্কি করতে গেল। শিমলায় ছুটি কাটানোর সময় যে ভাবে নাটক অভিনয় করা হত, তাও হল। শিমলার বদলে কাবুলকে কোম্পানিরাজের গ্রীষ্মাবাস হিসাবে বেছে নেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলল।
আর তার কয়েক দিনের মধ্যে উপজাতি বিদ্রোহ সেই ক্ষণস্থায়ী ব্রিটিশ সাফল্যকে দমছুট করে ছেড়ে দিল। প্রথমে কান্দাহার ও হেলমন্দ এলাকায় পাশতুনদের মধ্যে ধিকিধিকি বিদ্রোহ, তার পর আগুন উত্তর দিকে ছড়াতে ছড়াতে ক্রমে রাজধানী কাবুলে। ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর বিদ্রোহ। খুন করা হল আলেকজান্দার বার্নস এবং স্যর উইলিয়াম ম্যাকনাগটেন নামে দুই প্রবীণ অফিসারকে। প্রথম জনকে উন্মত্ত জনতা রাস্তায় কচুকাটা করল, দ্বিতীয় জনকে আলোচনার টেবিলে প্রথমে ছুরি ও পরে গুলি মেরে খুন করলেন প্রতিরোধবাহিনীর নেতা ওয়াজির আকবর খান।
তার পরই ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেনাদলের পশ্চাদপসরণ শুরু। আফগানিস্থানের শীত, বরফে ঢাকা গিরিপথ। ফিরছে ১৮ হাজার সেনা। সঙ্গে আরও ৯ হাজার ভারতীয় পাইক, বরকন্দাজ, লোকলস্কর। গুহা এবং গিরিপথের আড়ালে, পাহাড়ের চুড়ায় ততক্ষণে নির্ভুল নিশানা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে আফগান বন্দুকবাজরা। হামলাকারীদের ওপর প্রতিশোধ তারা নেবেই!
আট দিনের মৃত্যুপথ পেরিয়ে মাত্র ৫০ জন কোনওক্রমে গান্দামাক গ্রামের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছেছিলেন। সত্তর দশকেও ওই গ্রামে আশপাশের গুহাগহ্বরে ভিক্টোরীয় আমলের বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্রের কিছু ভাঙাচোরা নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যেত। আজও বলা হয়, রোদ্দুরে ঝলসানো ব্রিটিশ হাড়গোড়ে ভর্তি সেই পাহড়!
শেষ পর্যায়ে মৃত্যু-উপত্যকার গল্পটি বলার জন্য একটি মানুষই বেঁচেছিলেন। টমাস সউটার নামে সাধারণ এক পদাতিক সৈন্য! টমাস তাঁর বাহিনীর স্কার্ফ ও পতাকায় আবৃত করে নিয়েছিলেন নিজেকে। আফগানরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারা ভেবেছিল, বর্ণাঢ্য পোশাকের সৈন্যটি নির্ঘাত হোমরাচোমরা অফিসার, ধরে রাখলে ভাল মুক্তিপণ পাওয়া যাবে। আজকের আফগানিস্থানে ন্যাটো-র অন্যতম ঘাঁটি সেই সউটারের নামেই, ক্যাম্প সউটার!
যত দিন গিয়েছে, আফগানিস্থানের মাটিতে ব্রিটিশ পরাজয়ের ঘটনাটি ততই প্রতীকী হয়ে উঠেছে। ভিক্টোরীয় আমলের ব্রিটিশদের কাছে ওটি ছিল উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে দেশের সবচেয়ে বড় হার। তাঁরা জানতেন না, এই ঘটনার ঠিক একশো বছর পরে, ১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ বাহিনী আরও এক বার পর্যুদস্ত হবে।
ব্রিটিশদের কাছে তখন কাবুল থেকে বেঁচে ফেরা মানে সমস্ত প্রতিকূলতা জিতে আসা। উইলিয়াম বার্নস উলেনের বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘লাস্ট স্ট্যান্ড অব দ্য ফর্টিফোর্থ ফুট’ মনে পড়তে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে ছিন্নভিন্ন পোশাকে একদল হা-ক্লান্ত ব্রিটিশ সেনা, সামনে সজারুর কাঁটার মতো উঁচিয়ে থাকা বেয়নেট, পাশতুন উপজাতিরা ক্রমশ এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। চেমসফোর্ড জাদুঘরে আজও রাখা আছে সেই ছবি। ওই সময়ের আর এক বিখ্যাত চিত্রকল্প, ডাক্তার উইলিয়াম ব্রাইডনের ঘটনা নিয়ে এলিজাবেথ বাটলারের আঁকা ছবি ‘রেমন্যান্টস অব অ্যান আর্মি।’ মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে একমাত্র ব্রাইডনই বেঁচে ফিরছেন জালালালাবাদ। অদূরে দুর্গ, ঝুঁকে পড়া ক্লান্ত ঘোড়ার পিঠে আহত ও রক্তাক্ত ব্রাইডন।
আফগানদের কাছেও ১৮৪২ সালে ব্রিটিশদের পরাস্ত করার ঘটনাটি হয়ে ওঠে স্বাধীনতার প্রতীক। বিদেশি শক্তির কাছে আর নতি স্বীকার করবে না তারা। কাবুলের দূতাবাস-এলাকা আজও ওয়াজির আকবর খানের নামে নামাঙ্কিত। প্রতিরোধবাহিনীর সেই নেতা, যিনি ব্রিটিশদের হটিয়ে দিয়েছিলেন। এটি নিশ্চয় কাকতালীয় দুর্ঘটনা নয়!
দক্ষিণ এশিয়ার লোকেরাই ওই যুদ্ধে পদাতিক এবং লোকলস্করদের সবচেয়ে বড় অংশ। কামানের সামনে তাঁদেরকেই বুক পেতে দাঁড়াতে হয়েছিল। প্রথম আফগান যুদ্ধে ব্রিটিশ পরাজয় দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের কাছেও হয়ে ওঠে অন্য এক সম্ভাবনার প্রতীক। বহুসংখ্যক ভারতীয় মারা গিয়েছিলেন ওই যুদ্ধে। কিন্তু বোঝা গেল, ব্রিটিশ বাহিনী অজেয় নয়। ঠিকঠাক পরিকল্পনা নিয়ে বিদ্রোহ করলে তাদেরও শুইয়ে দেওয়া যায়। কয়েক বছর পরে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তাই ভারতীয়রাও ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করবে! আফগান যুদ্ধে অংশত প্রভাবিত সেই বিদ্রোহ আজও ব্রিটেনে ‘মহাবিদ্রোহ’ এবং ভারতে ‘প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ’ নামে খ্যাত।
আজকের ব্যর্থ যুদ্ধের প্রভাবও দক্ষিণ এশিয়ায় যথেষ্ট। পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে তালিবানরা ফের সংঘবদ্ধ হচ্ছে। সোয়াট উপত্যকায় ইতিমধ্যেই তাদের যথেষ্ট প্রভাব। পেশওয়ার শহর রোজই বোমাবর্ষণে কাঁপে।
রাজধানী ইসলামাবাদের পথেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে সেই তালিবানরা। পাকিস্তানের এক-পঞ্চমাংশ জুড়ে উপজাতি-অধ্যুষিত যে বিস্তীর্ণ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সেখানে মেয়েরা আবার বোরখায় ঢুকে গিয়েছেন গান-বাজনা বন্ধ, ক্ষৌরকারদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেন কারও দাড়ি না কামান। উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ১২৫টিরও বেশি মেয়ে-স্কুল। পেশওয়ারের সম্ভ্রান্তবর্গ শহর ছেড়ে ঘাঁটি গেড়েছেন লাহৌর ও করাচির অপেক্ষাকৃত নিরাপদ পরিবেশে। অন্যরা মার্কিন বোমারু বিমান ও পাকিস্তানি হেলিকপ্টার গানশিপের হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছেন শহরের উপকণ্ঠে ত্রাণশিবিরে।
সোয়াট, পেশওয়ারের এই অঞ্চল বরাবরই বেতমিজ, কোনও দিনই পাক সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। কিন্তু বোমারু বিমানের হানা সাধারণ নাগরিকদেরও নির্বিচারে প্রাণ কাড়ছে। গত ২০১০ সালেই এখানে ৭০০ জন সাধারণ নাগরিক বিমানহানায় প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে প্রতিনিয়ত তালিবানশিবিরে রাগী এবং তরুণ পদাতিক সৈন্যের ভিড় বাড়ছে। সামরিক বিমানহানা ছাড়াও পাকিস্তানের নাগরিকদের দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। ফলে পশ্চিমবিরোধী ধর্মান্ধতা আর রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদও সেখানে ক্রমে জাঁকিয়ে বসছে।
আফগানিস্থান আর পাকিস্তানের এই অস্থির, টালমাটাল পরিস্থিতির ঢেউ এখন আছড়ে পড়ছে নিউ ইয়র্কেও। বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ফয়সল সাজাদ ম্যানহাটানের টাইমস স্কোয়ারে একটি গাড়ি-বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা করেছিল, সফল হয়নি। সিআইএ-র জেরার উত্তরে তরুণ ফয়সল “বোমারু বিমান যে ভাবে ওপর থেকে বোমা ফেলে নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে খতম করছে,” সেই কথাই জানিয়েছিল। প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করছিল সে।

১৮৪২ সালের যুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করতে গত বছর আফগানিস্থানে গিয়েছিলাম, অল্পের জন্য আমার ভিক্টোরীয় পূর্বসূরিদের ললাটলিপি থেকে বেঁচে ফিরেছি।
তোরা বোরা আর পাকিস্তান সীমান্তের মধ্যে যে পাহাড়, সেখানেই ছিল প্রথম আফগান যুদ্ধের সৈন্যদের পশ্চাদপসরণের পথ। জায়গাটি বরাবর তালিবানদের শক্ত ঘাঁটি। স্থানীয় নিরাপত্তা ছাড়া যেন ওই তল্লাটে না যাই, সে বিষয়ে পইপই করে সাবধান করা হয়েছিল।
এক সকালে তাই এক উপজাতি নেতার সঙ্গে বেরিয়ে পড়া গেল। বিশাল বপুর এই আনোয়ার খান জিগদালিক তাঁর গ্রামের প্রাক্তন কুস্তি চ্যাম্পিয়ন। আটের দশকে সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে তিনি ‘হিজব-ই-ইসলামি মুজাহিদিন’ কম্যান্ডার, পরে হামিদ করাজাই সরকারে মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
গিরিপথ বেয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন জিগদালিক। সেই গিরিপথ, যেখানে ১৮৪২ সালে কাতারে কাতারে ব্রিটিশ সেনার মৃত্যু। জিগদালিক বেশ কয়েক বার গর্বের সঙ্গে জানালেন, তাঁর পূর্বপুরুষরাও ব্রিটিশদের কচুকাটা করার অন্যতম অংশীদার ছিলেন। “নিজেদের সম্মান বাঁচাতে ওরাই আমাদের বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য করেছিল, শেষ হারামিটাকেও শুইয়ে দিয়েছিলাম,” বললেন তিনি। এত কিছুর পরে, জিগদালিক এখন তাঁর পরিবারকে কাবুল থেকে বহু দূরে, ইংল্যান্ডের নর্থহোল্ট শহরের নিরাপত্তায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
জিগদালিক নিজে এস ইউ ভি ড্রাইভ করছেন। পিছনের পিক-আপ ভ্যানে আসছে অস্ত্র হাতে আফগান দেহরক্ষীরা। কাবুল শহরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে চোখে পড়ল ‘ন্যাটো’র বিধ্বস্ত ব্যারাক। ১৭০ বছর আগে এখানেই ছিল ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট। এগিয়ে চলেছি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার দিকে। এই রাস্তাই কাবুলের সঙ্গে খাইবার গিরিপথের যোগসূত্র।
হিংসায় ধ্বস্ত, নাটকীয় সব দৃশ্য। কখনও ঝাঁকুনির চোটে গাড়ির নীচের রাস্তা কঁকিয়ে কেঁদে উঠছে, দু’পাশের খাড়াই পাথরের দেওয়ালে বারুদের রং। দূরের পাহাড়চূড়া রহস্যময় কুয়াশায় ঢাকা। গাড়ি চালাতে চালাতেই জিগদালিক পশ্চিমি শক্তিগুলিকে নিয়ে তিক্ত অনুযোগ জানাচ্ছিলেন, “আশির দশকে যখন রুশদের মারছিলাম, আমেরিকানরা আমাদের বলত স্বাধীনতা সংগ্রামী। আর এখন বলে যুদ্ধবাজ উপজাতি।”
গিরিপথ থেকে নেমে আমরা এখন সোরোবি শহরে। পাহাড় এখানে মরচে রঙের এক মরুভূমিতে এসে মিশেছে। দূরে যাযাবরদের তাঁবু। প্রধান রাস্তা ছেড়ে এখানেই আমরা তালিবান এলাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। পাশের রাস্তা দিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের ‘এসকর্ট’ করতে এসে গিয়েছে আরও পাঁচটি ট্রাক। প্রতিটিতেই মাথায় স্কার্ফ (কেফিয়ে) জড়িয়ে, রকেট লঞ্চার আর গ্রেনেড নিয়ে কম্যান্ডোরা। জিগদালিকের পুরনো মুজাহিদিন বন্ধুরাই এখন আমাদের দেহরক্ষী!
আর জিগদালিক গ্রামেই ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি ঘটনাটা ঘটেছিল। বরফ ঢাকা পথে দুশো ব্রিটিশ সৈন্য দেখল, বন্দুক হাতে কয়েক হাজার পাশতুন তাদের ঘিরে ধরেছে। দুই পদস্থ সেনাধ্যক্ষ জেনারেল এলফিনস্টোন ও ব্রিগেডিয়ার শেল্টন বিপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে গেলেন, তাঁদের পণবন্দি হিসেবে ধরে রাখা হল। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে কোনও ক্রমে মাত্র পঞ্চাশ জন সৈন্য পালাতে পেরেছিল।
আমরা অবশ্য সেই তুলনায় বেশ উষ্ণ আতিথেয়তা পেলাম। মন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার খান জিগদালিকের এই প্রথম স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন। সাদা পপলার গাছে ছাওয়া পাহাড়ি সুঁড়িপথ, দু’পাশে বিচিত্র ফুল। সেই রাস্তা বেয়ে গর্বিত গ্রামবাসীরা পুরনো কম্যান্ডারকে নিয়ে গেল স্মৃতির উজানে। ওই পাহাড়চুড়োতেই ছিল জিগদালিক এবং মুজাহিদদের বাঙ্কার। স্মৃতিসফর শেষ হলে, আখরোট বাগানে প্রায় মুঘল ঘরানায় আমাদের ভোজ দিল গ্রামবাসীরা। জড়ানো এক লতার নীচে কার্পেটে বসে আমরা, সামনে একের পর এক কাবাব আর পোলাও। সেই দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের মাঝেই আপ্যায়নকারী গৃহকর্তা আঙুল দিয়ে গ্রামের বিভিন্ন জায়গা, ১৮৪২ সালে যেখানে ব্রিটিশদের কোতল করা হয়েছিল, দেখাচ্ছিলেন। ইতিহাসের সেই যুদ্ধ কি আজকের স্মৃতিতে আছে? এই যুদ্ধের সঙ্গে কি গ্রামবাসীরা অতীতের মিল খুঁজে পান? “মিল মানে? দুটো যুদ্ধই হুবহু এক,” জিগদালিক বলল, “দু’বারই বিদেশিরা নিজেদের স্বার্থে হামলা চালিয়েছে। আমাদের উপকারের জন্য নয়। প্রতিবারেই তারা বলেছে, আমরা তোমাদের বন্ধু। এখানে গণতন্ত্র আনতে চাই, তোমাদের সাহায্য করতে চাই। প্রতি বারেই মিথ্যে বলেছে।”
যে আখরোট বাগানে বসে আছি, তার মালিক মহম্মদ খান হাসলেন, “আজও আফগানিস্থানে যারাই আসুক না কেন, তাদের কপাল বার্নস, ম্যাকনাগটেন আর ডক্টর ব্রাইডনের মতোই পুড়বে।” প্রত্যেকে পোলাও খেতে খেতে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। ১৮৪২ সালের মৃত সেনারা স্বদেশ ব্রিটেনে বিস্মৃত। কিন্তু এখানে তাঁরা আজও রয়ে গিয়েছেন।
“ব্রিটিশরা বিদেয় হওয়ার পর এল রুশরা,” আমার ডান পাশে বসা বৃদ্ধ বলছিলেন, “তাদেরও আমরা তাড়িয়ে ছেড়েছি। কিন্তু যাওয়ার আগে ব্যাটারা গ্রামের অনেক বাড়ি বোমায় উড়িয়ে দিয়ে গেল।” পিছনের এক গিরিশিরায় আঙুল দেখালেন তিনি। সেখানে আগুনে ধূলিসাৎ হওয়া অনেক পোড়ো মাটির বাড়ির স্মৃতিচিহ্ন।
“আমরাই তো দুনিয়ার ছাদ। এখান থেকে আপনি সর্বত্র নজরদারি চালাতে পারবেন, সব জায়গা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন,” বললেন মহম্মদ খান। জিগদালিক সায় দিলেন তাঁর কথায়, ‘‘যখনই কোনও জাত ক্ষমতায় আসে, আফগানিস্থান তার কাছে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমাদের নেই। প্রতিবেশীরাই সব সময় আমাদের নিয়তি ঠিক করে দেয়।”
“আমেরিকানদের শেষ ঘনিয়ে এল। কে জানে, এর পরই হয়তো আসবে চিন।”

উইলিয়াম ডালরিম্পলের এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ বছরে একটি বই প্রকাশিত হবে। তারই আগাম পাঠ।

(চলবে)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.