মা নিষাদ...
খুব শান্ত, একমনা হয়ে ছুটে চলেছে একটি তির। ভঙ্গিটি নির্লিপ্ত। লক্ষ্যবস্তুটি ভেদ করতে পারলেই হল। দু’দিকের বাতাস কেটে যাচ্ছে তার ফলায়। কিন্তু, তাতে কী? বাতাসের কোনও শরীর নেই। তাই বিদ্ধ করার কোনও সুখও নেই। অথচ লক্ষ্যবস্তুটি শরীরী।
আক্ষরিকই শরীরী। দু’টি পাখি। উড়ন্ত, এবং কামমোহিত। তারা আকাশে ভাসমান, কিন্তু আসলে তারা যে কে কোথায়, কে জানে! শরীর এখন শরীর চেয়েছে। সেই মুহূর্তে নির্বিবাদে মুছে যায় সমস্ত পরিপার্শ্ব। কালপুরুষ ঢাকেন তাঁর চক্ষুতারা। আকাশে আলো মুছে দিয়ে টেনে দেয় অন্ধকারের আবরণ। সূর্যদেব রৌদ্রের স্রোতে ঝাপসা করে দেন সমস্ত অবয়ব। শুধু দু’জন ছাড়া অন্য কারও এ দৃশ্য দেখতে নেই।
কিন্তু, ভূমি থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি তির এ সব কিছুই খেয়াল করে না। তার শরীরটি নিরীহ। শুধু মুখটি ধাতব। মসৃণ। এবং ভয়ঙ্কর। সেই ভয়াল ধাতুর গায়ে পিছলে যাচ্ছে সূর্যকিরণ। পিছলে যাচ্ছে সমস্ত অতীত। ধাবমান মৃত্যুবাণের কোনও অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই। বর্তমান আছে। সেই উড়ন্ত বর্তমানের দিকে, নীচ থেকে, তাকিয়ে আছেন এক জন। নিষাদ। খেয়াল করছেন, তাঁর নিক্ষিপ্ত তিরটি দূরত্ব আর সময়ের জটিল অঙ্ক মেনে ঠিক মতো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারবে তো? কারণ, লক্ষ্যবস্তুটি স্থির নয়। ধাবমান। অবশ্য তিরের এত মাথাব্যথা নেই। তার মন নেই। মৃত্যুবাণের মন থাকে না। সে নির্বিকার ভাবে উড়ে চলেছে। তাকিয়ে আছেন আরও এক জন। তিরের দিকে নয়। তিরটি খেয়াল করেননি তিনি। তিনি তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। এখন প্রাতঃকালে আবহাওয়া স্নিগ্ধ। হাওয়া বইছে মৃদু। রৌদ্রটি মনোরম। পাশেই তিরতির করে বয়ে চলেছে একটি নদী। তমসা। তার কাকচক্ষু জলে খেলা করছে রৌদ্র আর বাতাস। তিনি, মহর্ষি বাল্মীকি স্থির করেছেন, এই জলেই অবগাহন করবেন। যদিও গন্তব্য ছিল পুণ্যতোয়া গঙ্গা, কিন্তু তমসার এই তীরভূমি ভাল লেগেছে তাঁর। পিছনে বস্ত্র বয়ে আনছেন তাঁরই শিষ্য। ভরদ্বাজ। তাঁকে থামার ইঙ্গিত করলেন মহর্ষি, বললেন, পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছ?
ছবি: অমিতাভ মালাকার
ভরদ্বাজ হাসলেন। বাল্মীকি আকাশের দিকে তাকালেন। সেই কূজনের উৎসটি দৃশ্যমান হল। দু’টি উড়ন্ত ক্রৌঞ্চ। তারা উড়ে চলেছে গায়ে গায়ে। যেন, দীর্ঘ অদর্শন ছিল তাদের। যেন, অজস্র কথা জমে ছিল তাদের ভিতর, দীর্ঘ কাল ধরে। এই সুস্মিত সকালে, ডানার ঝাপটে, সে সবই জানিয়ে দিতে হবে। একটি মুহূর্তও কাছছাড়া হওয়া চলবে না। একটি কথাও যেন হারিয়ে না যায়। তাই, চলার ফাঁকেই সমস্ত আলাপ। কিংবা, সংলাপ। মহর্ষি সেই দৃশ্য দেখছেন দুই চক্ষু ভরে। যেন, ওই ভাবে উড়তে উড়তেই অনন্তের দিকে পাড়ি দেবে এই যুগল। সময় থমকে যাবে এই ভালবাসার সামনে।
মহর্ষি বললেন, ভরদ্বাজ দেখো। পারস্পরিক বার্তা কী ভাবে জীবনের সঙ্গে অনন্তকে যোগ করে, দেখো।
ভরদ্বাজ বললেন, মহর্ষি, এই উড়ান তো সময়ের দ্বারা সংক্ষিপ্ত।
বাল্মীকি বললেন, এক অর্থে তা ঠিকই, কিন্তু এই আলাপের মধ্যে অসীমের স্পর্শ আছে। যেন, সময়ের সঙ্গেই এক সংলাপে মেতেছে ওরা। দেখো। দৃশ্যটি দেখো।
দেখছেন ভরদ্বাজ। দেখছেন মহর্ষি নিজেও। কিন্তু, ও কী হল? আচমকা একটি পাখি হঠাৎ ছিটকে উঠল কেন? কেন তার কিচিরমিচির সহসা বদলে গেল আর্তরবে? কেন স্তম্ভিত অন্য পাখিটিও ওই ভাবে, শেষ বারের মতো, গলা মেলাল তার সঙ্গীর চিৎকারে?
একটি পাখি তিরবিদ্ধ। পড়ে যাচ্ছে। তারই সঙ্গে, তারই মতো দ্রুত মাটির দিকে ধেয়ে আসছে তার রক্ত। সেই পতনশীল রক্তের দিকে, একটি মৃত পাখির দিকে সহর্ষে এগিয়ে আসছেন এক নিষাদ। আর মহর্ষি বাল্মীকি, যিনি জাগতিক সমস্ত দুঃখসুখের ঊর্ধ্বে, তাকিয়ে আছেন। বিস্ফারিত। তাঁর হৃদয়ে জন্ম নিচ্ছে একটি বেদনা। একটি মুহূর্ত বিচূর্ণ হচ্ছে যেন। তার কণা থেকে উছলে উঠছে একটি অনুভব। এই অনুভব, তার গড়ন সবই মহর্ষির অপরিচিত। কিন্তু, তাঁর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে তারা। এদের আর ঠিক শব্দ বলা যাবে না। বলা উচিত, বাক্। মহর্ষি সেই নিষাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন।
এই মুহূর্তটির সম্মুখে সময় নতজানু হোক।
কেউ নেই, কিছু নেই, সূর্য নিভে গেছে।
অতঃপর, পৃথিবীর প্রথম শ্লোকটির জন্ম হবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.