হাজার বছর ধরে
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দী। রাজদরবারে কবিসভা বসেছে। নানা ভাষার কবিরা এসেছেন সেই দরবারে। এসেছেন মহাকবির দল। মহাকবি হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। ছ’টা ভাষায় যাঁরা কবিতা লিখতে পারেন তাঁরাই মহাকবি। লোকজন তাঁদের কদর জানে, রাজারাজড়ারা তাঁদের খাতির করে চলেন। এই মহাকবিদের দাপটই আলাদা। সেই রাজসভায় মহাকবিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে এসেছেন আরও কিছু মানুষ। তাঁরা দুচোখ ভরে দেখেন তাঁদের চার পাশের জগৎ আর জীবন, সেই সাধারণ জগৎ আর জীবনের কথা ফুটিয়ে তোলেন তাঁদের পদে। ছ’টা ভাষা নয়, একটা ভাষাই তাঁদের কবিতার ভাষা। মহাকবিরা এঁদের বড় একটা পাত্তা দিতে চান না, নিতান্ত পদকর্তা বলে এই একভাষী কবিদের খানিকটা খাটো চোখেই দেখেন। কিন্তু সে দিন সেই রাজসভায় ঘটল অদ্ভুত এক কাণ্ড। চাটিল পাদ, বীণা পাদ আর সরহ পাদ এই তিন পদকর্তা বড় মনভরানো, প্রাণমাতানো পদ শোনালেন সেই সভায়।
ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝে ণ থাহী॥
ধার্মার্থে চাটিল সাঙ্কম গটই।
পারগামি লোঅ নিভর তরই॥

এর মানে হল গহন গভীর নদী দ্রুত বেগে বয়ে যাচ্ছে, তার দুই তীর পিছল, মাঝনদীতে থই মেলে না; চাটিল এই নদী পার হওয়ার জন্য সাঁকো বানালেন, যাঁরা এই খরস্রোতা নদী পার হতে চান তাঁরা ভর করলেন তার ওপরেই।
সহজ কথা, কিন্তু শুনে মন ভরে যায়। নদীপ্রধান এই দেশেরই ছবি, কিন্তু এ পদ যেন আরও কিছু বলে। সত্যি তো, এ ভবসংসারে এক দিন সময় ফুরোবে, আমাদের সবাইকে ডিঙোতে হবে ভবনদী। পদ শুনে মন উদাস হয়ে যায় সভার মানুষজনের। এ তো অলঙ্কারে ভরা মহাকাব্য নয়, বড় সহজ কথা, গভীর কথা।
বীণা পাদ তাঁর পদে শোনালেন বুদ্ধ নাটকের কথা।
নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই॥

সাধারণ মানুষের জীবন আর উৎসবের কথা ধরা পড়েছে এই পদে। তিন পদকর্তার নামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। এই পদকর্তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে দিন কাটান। তাঁদের সহকবিদের পদে তাই কত বিচিত্র কথা যে ধরা পড়ে! সে সব প্রতি দিনের ছোট ছোট বৃত্তান্ত। নগরের বাইরে যে ডোমনি থাকে তার কথা লেখেন কেউ, কেউ লেখেন উপপতিপরায়ণ বউটির কাহিনি দিনের বেলায় বউ নাকি কাকের ডাকেও ভয় পায়, আর রাত হলেই ‘কামরু জাঅ’। সেই বিপুল কামনা তার পতি নিবারণ করতে পারে না। সত্যি সত্যি চর্যার এই পদগুলি আধুনিক কবিদেরও মন ভোলায়। আধুনিক বাংলায় সেই পদ অনুবাদ করেন তাঁরা।
উঁচু উঁচু সব পাহাড়চূড়ায় সে এক শবরী বালা
ময়ূরপালক পরে আছে, তার গলায় রয়েছে গুঞ্জমালা।
মত্ত শবর জাগল শবর, ব্যস্ত করো না আমাকে আর
ও তো সুন্দরী সহজ রমণী, আপন ঘরণী ও যে তোমার
(শঙ্খ ঘোষের তর্জমা)
এই কবিসভা হয়তো সত্যি সত্যি বসেনি। তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর বেনের মেয়ে উপন্যাসে এই যে কাল্পনিক কবিসভার বিবরণ দিয়েছিলেন তা খুব একটা ভিত্তিহীন ছিল না। থাকার কথাও নয়, বাংলা ভাষার সেই আদিযুগের কথা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অজানা ছিল না। এ ভাষার আদিরূপ হিসেবে যে চর্যাপদ স্বীকৃত, তার পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন তিনিই। সেই আবিষ্কার বাংলা ভাষার একটা বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছিল। মোটামুটি হাজার বছর। চর্যাপদ সহস্রাবব্দ আগে তৈরি হয়েছিল।
ভাষার বয়স হিসেবে হাজার বছর খুব বেশি নয়। অর্থাৎ, ভাষা হিসেবে খুব একটা বুড়ো নয় বাংলা। তবে সেই আদিকাল থেকেই, মানে দশম শতাব্দী থেকেই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর এই বংশধরকে আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ যখন এই উপন্যাস লিখছেন, তত দিনে বাঙালি কবি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গিয়েছেন, বাংলা ভাষা হিসেবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠা তো এক দিনে জোটেনি।
ছবি: সুমন চৌধুরী
অষ্টাদশ পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, এ সব সংস্কৃত ভাষার বদলে বাংলা ভাষায় শুনলে নাকি নরকে যেতে হবে এমন শাসানি দিয়ে শ্লোক রচনা করেছিলেন মধ্যযুগের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। তবু কিন্তু বাংলা ভাষাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। রামায়ণ মহাভারত বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কথাই ধরা যাক না কেন! বাল্মীকি রামায়ণে যা আছে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে তার অনেক কিছু বাদ দিয়ে একগাদা রঙদার কাহিনি ঢুকে পড়ল। বালক হনুমান সূর্যকে ধরে ফেলল, লেজ পাকিয়ে সিংহাসন বানিয়ে অঙ্গদ রাবণের রাজসভায় বসে পড়ল। এ সবই বাংলা রামায়ণের কিস্সা। কৃত্তিবাসের পাঁচালী বেশ জনপ্রিয়, ফলে কৃত্তিবাসের পাঁচালীর মধ্যে অন্য কবি কথকরা তাঁদের পদ মিশিয়ে দিলেন। নানা রসিকতার মিশেল। এক রাবণ মায়াবলে অনেক হয়েছে, অঙ্গদ তখন ইন্দ্রজিৎকে ঠাট্টা করে বলছে কে তার আসল বাবা? অনেকটা গ্রাম্য যাত্রার মতো। তবে এ-ও তো বাঙালিয়ানার সিগনেচার, সংস্কৃত রামায়ণে মিলবে না।
শুধু তা-ই নয়, আরবি-ফারসি কাহিনিমূল থেকে নানা উপাখ্যান নিয়ে বাংলায় কাব্য লিখেছিলেন কবিরা, সে কাহিনিতে দেদার বৈষ্ণব পদাবলির মিশেল ঘটল। চন্দ্রাণী বলে এক রাজকুমারীর কথা লিখেছিলেন দৌলত কাজি। সেই চন্দ্রাণী গলার হার ছিঁড়ে মাটিতে মুক্তো ছড়িয়ে দিলেন আর ছেটানো মুক্ত তোলার ফাঁকে দেখে নিলেন সুপুরুষ লোরককে।
কাহিনিটি সুফি ধারা থেকে নেওয়া, কিন্তু চন্দ্রাণীর কায়দাটি হিন্দু কবি বিদ্যাপতির রাধার মতো। আসলে কবিদের মধ্যে যেমন হিন্দুরা ছিলেন তেমনই ছিলেন অহিন্দু বাঙালি কবিরা। মোটামুটি ১৩৫০ থেকে অষ্টাদশ শতক মধ্যযুগ বলে গণ্য হয়। এই পর্বে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের অনুবাদ যেমন হয়েছে, তেমনই লেখা হয়েছে ইউসুফ জোলেখা, লাইলী মজনু মহম্মদ সগীর, বাহরাম খান, দৌলত কাজী, এঁরা মধ্যযুগের বাঙালি কবি।
বাংলা ভাষার মধ্যে যেমন সংস্কৃত শব্দ ঢুকে পড়েছিল তেমনি নেওয়া হয়েছিল আরবি-ফারসি শব্দ। অন্য শব্দ ধার করে নিজের করে নিয়ে কী ভাবে বড় হয়ে উঠতে হয়, সে কায়দা বাংলা ভাষার কবিরা বেশ রপ্ত করেছিলেন। আধুনিক বাংলা ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সঙ্কটটা অবশ্য বেশ জটিল আকার নিয়েছিল। ইংরেজরা এ দেশে এসে বাংলা ভাষার চেহারা চরিত্র জরিপ করতে বসল। জরিপের কাজটা কেবল জ্ঞানচর্চার দায়িত্ব থেকে করেনি তারা, ভেদাভেদের রাজনীতি কায়েম করার দায়ও ছিল। বাংলা ভাষার চরিত্র কেমন বা কেমন হওয়া উচিত, তা বাতলে দেওয়ার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চেষ্টা করছিল তারা। সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার যোগ যত বেশি করে দেখানো যাবে, তত নাকি বাংলা ভাষার ভাল। আর প্রয়োজন মাফিক আরবি-ফারসি ভাষার শব্দকে বাংলা ভাষার শরীর থেকে নিকেশ করা চাই।
কেন এমন যুক্তি সাজানো হল? উত্তরটা এক দিক থেকে সোজা। ইংরেজরা এ দেশে ক্ষমতা দখল করার আগে শাসনভার মুখ্যত ছিল মুসলমানদের হাতে। ইংরেজ আমলে তাই সেই পুরনো শাসক মুসলমানরা প্রথম পর্বে ইংরেজবিমুখ, আর হিন্দুরা ইংরেজি শিখেটিখে চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি-ফারসি ভাষার যোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতায়িত করে তোলা হচ্ছে। এ কাজে সাহেবদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ে। উইলিয়াম জোন্স সংস্কৃতকে গ্রিক আর লাতিনের থেকেও উৎকৃষ্ট ভাষা বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরে উইলিয়াম কেরি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, বাংলা সংস্কৃতায়িত ভাষা। সাহেবদের সমর্থন পেয়ে কোনও কোনও হিন্দু বাংলা ভাষা আরবি-ফারসির অর্থাৎ মুসলমানদের কেউ না, এ কথা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগছেন। যেমন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার পারসীক অভিধান সংকলন করছেন। বাংলায় প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দের বদলে নাকি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতে হবে। জয়গোপালের সুপারিশ দোকান লেখা চলবে না, আপণ লিখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ১৮৩৭-এ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সাহেবরা ফারসির বদলে বাংলাকে আদালতের ভাষার স্বীকৃতি দেয়। তবে এ সংকীর্ণতা চলেনি।
বাংলা যে হিন্দু বা মুসলমানের ভাষা নয়, বাঙালির ভাষা, এই সত্যকে অস্বীকার করা যাবে না। বাংলা ভাষার মাধ্যমে ভেদবিভেদ সৃষ্টি করতে গিয়ে সাহেবরা যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনই বিফল হয়েছে সংকীর্ণমনা হিন্দু-মুসলমান। সংস্কৃতপ্রধান পণ্ডিতী বাংলা যেমন সাধারণ বাঙালি গ্রহণ করেননি, তেমনি আরবি-ফারসির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এ ভাষায় চলেনি। আর একটা কথা বিশেষ করে বলা দরকার। ধর্ম নয়, সংস্কৃতিই এই ভাষার প্রাণ। ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে অভ্রান্ত ভাবে। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানদের ওপর যখন বাংলার বদলে অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ হল, তখন বাঙালি ছেড়ে কথা কয়নি, ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। বাহান্ন’র বসন্তে বাংলা ভাষার জন্য সেই প্রাণদান বৃথা যায়নি। বাংলা ভাষা মাথা তুলেছে, কালক্রমে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষার অধিকার লাভ করেছে। এখন বাংলা ভাষায় কথা বলেন বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, ত্রিপুরা, অসমের বরাক উপত্যকা, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি অঞ্চলের বহু মানুষ। এ ছাড়াও দেশেবিদেশে ছড়িয়ে আছেন বাংলাভাষীরা। অপরাপর ভাষার বহু মানুষ এই ভাষা শেখেন।
মাঝে বাঙালিদের মধ্যে কেউ কেউ একটা ভুল করে ফেলেছিলেন। অন্যান্য ভারতীয় ভাষার থেকে, যেমন অহমিয়া, ওড়িয়ার থেকে বাংলা সেরা, এমনটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। অহমে এবং ওড়িশায় সেখানকার ভাষার বদলে বাংলা ভাষা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন কোনও কোনও বাঙালি। এটা অন্যায়। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বার বার বাঙালিকে সচেতন করে দিয়েছিলেন, অন্য প্রদেশের মানুষদের যেন বাঙালিরা খাটো চোখে না দেখেন, তাঁদের নিয়ে রসিকতা না করেন। বাঙালি কথা শোনেনি। ফকীরমোহন সেনাপতি তাঁর আত্মচরিত-এ লিখেছিলেন এক দাম্ভিক বাঙালি পণ্ডিতের কথা। এই পণ্ডিত ওড়িশায় থেকে সেখানকার ভাষাকে অবজ্ঞা করতে দ্বিধা করেননি। প্রশ্ন হল, নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে অন্যের ভাষাকে খাটো করতে হবে কেন! সব ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে নানা ভাষার মানুষ বাস করেন। পশ্চিমবঙ্গ তাঁদেরও, আবার বাঙালিদেরও। একে অন্যের ভাষাকে সম্মান করুন। ভালবেসে অপর ভারতীয় ভাষা শিখুন। ভাষার শতফুল ফুটলেই তো বসন্ত ঝলমল করে উঠবে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.