|
|
|
|
নেতাইয়ের ‘ভুল’ কবুলে অনীহাই রাখল সিপিএম |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে পুরসভা ও পঞ্চায়েতের কাজে ঘাটতি, ধর্মঘট-বিরোধিতা থেকে শিক্ষায় ‘দলতন্ত্র’ অজস্র প্রশ্নে ‘ভুল’ স্বীকার করে নিয়েছে সিপিএম। রাজ্য সম্মেলনে বিগত দিনের ‘রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক’ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে চুলচেরা আলোচনা হলেও আড়ালেই থেকে গেল নেতাই-কাণ্ড! জঙ্গলমহলে ‘সশস্ত্র শিবির’ গড়ে তোলা নিয়ে বাম সরকারের জমানায় তুমুল বিতর্ক হলেও নেতাইয়ের ঘটনার জন্য ‘ভুল’ স্বীকারের রাস্তায় হাঁটেনি সিপিএম! অথচ নেতাই-এ সিপিএমের শিবির থেকে গুলি চালনায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছিলেন কয়েক জন মহিলা-সহ অন্তত সাত নিরীহ গ্রামবাসী।
বর্ধমানে দলের দুই নেতা নিহত হওয়ার ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ‘পরিকল্পিত, নৃশংস’ আক্রমণ চালানোর অভিযোগে সরব হয়েছে অধুনা বিরোধী সিপিএম। তৃণমূলের নেতা ও মন্ত্রিসভার কয়েক জন সদস্য পাল্টা দাবি করেছেন, তাঁরা ‘গণরোষে’র শিকার। এই আবহেই প্রশ্ন উঠছে, নেতাইয়ের ঘটনায় কেন ‘সত্য’ কবুল করেনি সিপিএম? তখনও সামনে আনা হয়েছিল ‘গণপ্রতিরোধে’র তত্ত্ব। বর্ধমানের সঙ্গে নেতাইয়ের ফারাক একটাই সিপিএম জঙ্গলমহলে ‘গণপ্রতিরোধে’র কথা বলেছিল মাওবাদীদের বিরুদ্ধে। যদিও তার ‘শিকার’ হন নেতাইয়ের মানুষ। আর বর্ধমানের ক্ষেত্রে সেই ‘গণপ্রতিরোধের দাওয়াই’-ই প্রয়োগ করা হয়েছে সিপিএমের বিরুদ্ধে!
রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, বর্ধমানে লড়াই হয়েছে দু’দল দুষ্কৃতীর। ঘটনাচক্রে, এক দলের আশ্রয় তেরঙা ঝান্ডার নীচে। অন্য দলের মাথার উপর লালঝান্ডা। কিন্তু তা কোনও ‘রাজনৈতিক লড়াই’ নয়। রাজ্যের এক মন্ত্রীর কথায়, “এটা তো বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়। এটা নেহাতই দু’দল দুষ্কৃতীর মারপিট। এর মধ্যে রাজনীতি নেই। গুন্ডামি আছে!” নেতাইয়ে ‘লড়াই’ হয়নি। সিপিএমের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হার্মাদদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল সাধারণ গ্রামবাসীর।
সিপিএমের সদ্যসমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনের ‘খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টে’ নেতাইয়ের নামই ছিল না! শুধু বলা হয়, ‘জঙ্গলমহল এলাকার একটি ঘটনাও নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিএম-বিরোধী প্রচারে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করে। জনগণের ব্যাপকতম অংশের রাজনৈতিক, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক সক্রিয়তা ছাড়া যে গণপ্রতিরোধের আবশ্যিক প্রাক্শর্ত পূরণ করতে অক্ষম, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। সন্ত্রাস মোকাবিলায় গণপ্রতিরোধের রূপ কী হবে, তা গণতান্ত্রিক অধিকার ও পরিবেশের জন্য গণজমায়েত ও তার মোকাবিলায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উপরে নির্ভর করে’। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এই ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রতিরোধের কথাই বর্ধমানের ঘটনার পরে শোনা গিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মুখে!
শুধু রাজ্য সম্মেলনের দলিলই নয়, সেখানে বক্তা ৬৪ জন প্রতিনিধির আলোচনাতেও নেতাই-প্রসঙ্গে সমালোচনা আসেনি বলেই সিপিএম সূত্রের খবর। তাঁর আগের অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সম্মেলনের জবাবি ভাষণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছেন, ধর্মঘট-বিরোধিতায় তাঁর অতীতের মন্তব্য ‘ভুল’ ছিল। কিন্তু তিনিও নেতাই প্রসঙ্গে কোনও কথা বলেননি। যদিও বাম জমানার শেষ দিকে জঙ্গলমহলে ‘গণপ্রতিরোধে’র নামে ‘সশস্ত্র শিবির’ চালানো এবং আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে দলের অন্দরে সরব ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু ও তা নিয়ে কারাট-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধও দেখা দিয়েছিল। বুদ্ধবাবু বিবৃতি দিয়ে মতবিরোধের তত্ত্ব খারিজ করেন। সম্মেলনের জবাবি বক্তৃতায় বিমান বসুও ওই ঘটনা নিয়ে মুখ খোলেননি। নেতাইয়ের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের সম্মেলনে দীপক সরকার-বিরোধী গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত কিছু প্রতিনিধি ‘গণপ্রতিরোধের লাইন’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
নেতাই নিয়ে ‘আত্মসমালোচনা’ কেন নেই? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, “নেতাইয়ের ঘটনা দুঃখজনক হলেও পরিকল্পিত নয়। স্থানীয় স্তরে ভুল হয়ে থাকলে তা নিয়ে রাজ্য স্তরে সব সময় আলোচনার কিছু নেই।” সে ক্ষেত্রে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসাবে নেতাইয়ের ‘ভুল’ স্বীকার করা হল না কেন? এর সদুত্তর নেতৃত্বের কাছে নেই। বরং, ‘গণপ্রতিরোধে’র তত্ত্ব যে সিপিএম ছাড়বে না, তার ইঙ্গিত রয়েছে খসড়া প্রতিবেদনেই ‘ক্রমবর্ধমান হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে ব্যাপকতম গণসমাবেশ ও গণপ্রতিরোধ কত দ্রুত গড়ে তোলা যায়, ২০১২ সাল হবে তার প্রস্তুতিপর্ব’। |
|
|
|
|
|