এক দিকে ‘কঠোর’ হুঁশিয়ারি। অন্য দিকে আগামী ক’মাস বেতন জুগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২৮শের সাধারণ ধর্মঘটে সরকারি বাস ও ট্রামকর্মীদের হাজিরা নিশ্চিত করতে শুক্রবার এমন ‘জোড়া দাওয়াই’-ই দিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। যার জেরে বিতর্কের সৃষ্টি হতেও দেরি হল না।
মদনবাবু এ দিন পরিবহণকর্মীদের ‘সতর্ক’ করে জানিয়ে দেন, বন্ধের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার কেউ কাজে গরহাজির থাকলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। তাঁর সাফ ঘোষণা: ওই দিন কোনও ছুটি মঞ্জুর করা হবে না, এমনকী অসুস্থতার কারণ দেখিয়েও অনুপস্থিত থাকা যাবে না। “সে দিন কারও জ্বর হলেও দু’দিন আগে তা জানিয়ে দিতে হবে।” মহাকরণে এ দিন মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
বস্তুত মদনবাবু মনে করছেন, ধর্মঘটের দিন কাজে আসা নিয়ে গত চৌত্রিশ বছরে রাজ্যের মুখ্যসচিব এত নির্দিষ্ট করে সার্কুলার দেননি, যা এ বার জারি হয়েছে। তাঁর কথায়, “এত দিন সরকারই বন্ধ সমর্থন করত। কিন্তু মুখ্যসচিবের এ বারের সার্কুলার অত্যন্ত পরিষ্কার। মঙ্গলবার শিল্প ধর্মঘটের দিন কাজে না-এলে সার্ভিস রেকর্ডে ছেদ পড়তে পারে। আটকে যেতে পারে পদোন্নতি। পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে সরকার যে কোনও রকম কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে।” মুখ্যসচিব সমর ঘোষ অবশ্য উল্লিখিত সার্কুলারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওই দিন কেউ গরহাজির থাকলে অনুপস্থিতির কারণ যাচাই করে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
এবং এরই প্রেক্ষিতে পরিবহণমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্য ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে কর্মীমহলে। বিশেষত অসুস্থতার জন্যও ছুটি নেওয়া যাবে না, এবং অসুস্থ হলেও আগাম জানাতে হবে মন্ত্রীর মুখে এই জাতীয় মন্তব্যে কর্মীদের একাংশ রীতিমতো বিস্মিত ও বিভ্রান্ত। বিভিন্ন ইউনিয়নের নেতারাও এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একই ভাবে বন্ধের সঙ্গে সরকারি পরিবহণকর্মীদের বেতনের প্রসঙ্গ তুলে মদনবাবুর বক্তব্যও বিরোধীমহলের সমালোচনার মুখে পড়েছে। কী বলেছেন পরিবহণমন্ত্রী?
আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব ক’টি পরিবহণ নিগমে জানুয়ারি পর্যন্ত বকেয়া বেতনের টাকা পৌঁছে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মদনবাবু এ দিন বলেন, রুগ্ণ নিগমগুলোর পিছনে বছরে ছ’শো কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে কর্মীদের ছ’মাস বেতন জুগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার প্রেক্ষিতে কর্মীদের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী বেতন দেবেন, অথচ মরিয়া হয়ে নিগম না-বাঁচিয়ে বন্ধের রাজনীতি করব এমন চলতে পারে না। মনে রাখবেন, সরকার সব দিকে নজর রাখছে। যিনি কাজ করবেন, সরকার তাকে দেখবে। আশা করি, সবাই নিজেকে কাজের লোক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। আশা করি, ওই দিন পরিবহণকর্মীদের কেউই অসুস্থ হবেন না।” |
মদনবাবুর এই মন্তব্য ঘিরেও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। একে যুগপৎ ‘প্রচ্ছন্ন ধমকি’ এবং ‘বেতনের টোপে আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করছে বিরোধী রাজনৈতিক শিবির। সিটু’র রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, “পরিবহণকর্মীরা শুধু নিজেদের বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য ধর্মঘট করছেন না। ছাঁটাই, সরকারি পরিবহণের বেসরকারিকরণ-সহ অনেক দাবি তাঁদের আছে। ফলে বেতন দিয়ে ওঁদের আনুগত্য কেনা যাবে না। ওঁরা ধর্মঘট করবেনই।” বস্তুত ২৮শের ধর্মঘটের আহ্বায়ক ১১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন মনে করছে, ধর্মঘটের রাস্তায় গেলে যে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায় হয়, পরিবহণকর্মীদের তড়িঘড়ি বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণাই তার প্রমাণ।
তবে পাশাপাশি তারা এটাও বলছে, বেতন কর্মীদের ন্যায্য পাওনা। তার বিনিময়ে কর্মীদের হাত থেকে ধর্মঘটের মতো আর একটা ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। শ্যামলবাবুর ব্যাখ্যা, “১৯৮০ সালে তদানীন্তন বামফ্রন্ট সরকার সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘট করার অধিকার দিয়েছিল। সে আইন এখনও বলবৎ। অতএব ধর্মঘটী কর্মীদের সার্ভিস ব্রেক-সহ আরও নানা শাস্তিদানের হুমকি বেআইনি।” সিটুু নেতার কথায়, “মদনবাবুরা ওয়েস্ট বেঙ্গল সার্ভিস রুল-পার্ট ১, অ্যাপেনডিক্স-৬এ, ক্লজ-৪ দেখে নিন। তা হলেই বুঝবেন, ওঁদের হুমকি বেআইনি।” রাজ্য কো-আর্ডিনেশন কমিটির সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “অনেকে মন্ত্রী হয়ে এসেছেন। যা খুশি, তা-ই বলছেন, করছেন। অশালীন আচরণও করছেন। তাঁদের কিন্তু জনগণ ছুড়ে ফেলে দেবে।”
অসুস্থ হয়ে কেউ আসতে না-পারলে কী হবে? তা ছাড়া কেউ অসুস্থ হওয়ার কথা আগাম জানাবেনই বা কী করে?
পরিবহণমন্ত্রীর এ হেন মন্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তা বুঝতে পেরে এ দিন সন্ধ্যায় পরিস্থিতি সামাল দিতে নামেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বিষয়টি ‘ব্যাখ্যা’ করে সুব্রতবাবু বলেন, “যদি একটা গোটা দফতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তা হলে তো অন্য কথা! প্রতিটা কেস ধরে ধরে বিচার করতে হবে।”
এ দিকে সরকারি পরিবহণকে ‘হুমকি’ দিলেও ধর্মঘটে বেসরকারি পরিবহণ চালু রাখতে রাজ্য সরকারের কার্যত কোনও ভূমিকাই যে নেই, তা এ দিন পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। পরিবহণমন্ত্রী জানিয়েছেন, ধর্মঘটের দিন রাজ্য পরিবহণ দফতরের এক হাজার বাস রাস্তায় নামবে। যদিও বেসরকারি বাস বা ট্যাক্সি কত নামবে, তার কোনও হিসেব মন্ত্রী দিতে পারেননি। মদনবাবুর দাবি, “মঙ্গলবার রাস্তায় যথেষ্ট সংখ্যক বেসরকারি বাস-মিনিবাস, ট্যাক্সি থাকবে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।”
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা কী?
জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মন্ত্রী ধর্মঘটের দিন বাস বার করতে বলেছেন। আমরা ওঁকে জানিয়েছি, বাস বার করা-না করা শ্রমিকদের ইচ্ছে। যথেষ্ট যাত্রী না-থাকলে শ্রমিকেরাই বাস বার করবেন না।” বাস-মালিক সংগঠনের তরফে সাধন দাসের অভিযোগ: ধর্মঘটে রাস্তায় বাস ভাঙচুর হলে বিমা সংস্থা ক্ষতিপূরণ দিতে চায় না। পরিবহণমন্ত্রীর অবশ্য আশ্বাস: সিপিএম যাতে ‘ঝামেলা পাকাতে’ না-পারে, তাই প্রতিটি বাসডিপো ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিমল গুহ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার ট্যাক্সি পরিষেবা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা হবে।
আর রাজ্যের প্রায় ৭০ হাজার অটোর অন্তত ৬০ শতাংশের মালিক-চালক সিটু-সমর্থক বলে দাবি করে সিটু-সমর্থিত ‘কলকাতা অটো অপারেটর্স ইউনিয়নের’ সাধারণ সম্পাদক কিশোর ঘোষ এ দিন বলেন, “আমরা কেউ ধর্মঘটের দিন অটো বার করব না।” যে প্রসঙ্গে পরিবহণমন্ত্রী বলছেন, “অধিকাংশ অটোর অনুমোদিত সরকারি নথি নেই। এটা মাথায় রেখে ধর্মঘটের দিন সবাই অটো বার করবে।” অন্যথায় কী ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন?
মদনবাবুর জবাব, “আমার আগের মন্তব্যেই এর
উত্তর রয়েছে।”
অর্থাৎ, সে ক্ষেত্রে অবৈধ অটোরিকশার বিরুদ্ধে প্রশাসন অভিযানে নামবে বলেই ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। |