আগামী মঙ্গলবারের সাধারণ ধর্মঘট রুখতে কোমর বেঁধে নামল রাজ্য সরকার এবং প্রধান শাসক দল তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা করে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ওই ধর্মঘটকে সরাসরি ‘বেআইনি ও জনবিরোধী’ আখ্যা দিয়েছেন। ধর্মঘট
‘ব্যর্থ’ করতে দল ও সরকার রাস্তায় নামবে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “ধর্মঘটের দিন আমরা সকালে নামব না। দুপুরে এলাকাভিত্তিক রাস্তায় নামব!”
অফিস-কাছারিতে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়ে ধর্মঘটের মোকাবিলা করার জন্য শুক্রবার তৃণমূল এবং কংগ্রেস প্রভাবিত সরকারি কর্মচারীদের সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। তাঁর দলের শ্রমিক সংগঠনকেও পথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন মমতা। ধর্মঘট নিয়ে এ দিন মহাকরণে সুব্রতবাবু ছাড়াও শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, দলের অন্যতম শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, দোলা সেন প্রমুখের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের অন্দরে এঁরা সকলেই ভিন্ন ভিন্ন শিবিরের নেতা বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁদের সকলকে একজোট করে ধর্মঘট-মোকাবিলায় নামতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী।
কর্মচারী সংগঠনগুলির নেতাদের সঙ্গে প্রায় সওয়া ঘণ্টার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, এই ধর্মঘট ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। রাজ্যের কর্মসংস্কৃতিকে তা নষ্ট করবে। প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য তিনি কর্মচারী-নেতাদের কাছে আর্জি জানান। আশ্বাস দেন, প্রশাসনও তাঁদের সব রকম সাহায্য করবে।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের পরে মন্ত্রী সুব্রতবাবু বলেন, “২৮ তারিখ ধর্মঘটে শ্রমিক-কর্মচারী এবং অসংগঠিত মজদুরদের কোনও স্বার্থ যুক্ত নেই। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতেই এই ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। বিশেষ একটি রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গ) খারাপ বাতাবরণ তৈরি করতে জনগণের স্বার্থ এবং উন্নয়ন-বিরোধী এই ধর্মঘট।” একই সঙ্গে তিনি জানান, “আমরা এই ধর্মঘটকে ব্যর্থ করার ডাক দিয়েছি। শান্তিপূর্ণ মিছিল চলছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে বলে আমরা মাইক নিয়ে প্রচার করছি না। মিছিল করে জনগণকে অনুরোধ করছি।” |
সরকার এবং বিরোধীদের অনড় অবস্থানে গোটা দেশে ডাকা ধর্মঘটকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে ‘রাজনৈতিক পারদ’ চড়তে শুরু করেছে। ধর্মঘটকে ‘সফল’ করার আহ্বান জানানোর পাশাপাশিই অবশ্য শাসক পক্ষের ‘ফাঁদে পা’ না-দেওয়ার জন্য মানুষ এবং বাম কর্মী-সমর্থকদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। রাজ্য সরকার এবং প্রধান শাসক দল তৃণমূল যে ভাবে ২৮ তারিখের ধর্মঘটের ‘সক্রিয় বিরোধিতা’য় নেমেছে, তা নিয়ে এ দিন আলোচনা হয় বামফ্রন্টের বৈঠকে। বর্ধমানে ধর্মঘটের পক্ষে মিছিল করতে গিয়ে সিপিএমের দুই নেতা প্রদীপ তা এবং কমল গায়েন খুন হওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রন্ট নেতৃত্বের আলোচনায় এ দিন ঠিক হয়েছে, কোনও ভাবেই ‘প্ররোচনা’য় পা দেওয়া চলবে না। ফ্রন্টের বৈঠকের পরে বিমানবাবু বলেন, “প্রশাসনের অতি-সক্রিয় ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। দিকে দিকে তৃণমূলের প্যাডে ফরমান দেওয়া হচ্ছে, ধর্মঘটে যোগ দিলে ফল ভাল হবে না! আমরা এ সবের নিন্দা করছি। প্ররোচনায় পা দেওয়া যাবে না। কোনও সংঘাতমূলক পথে যাওয়া যাবে না।”
সরকার এবং শাসক দল যে ভাবে ধর্মঘট রুখতে উঠেপড়ে লেগেছে, প্রত্যাশিত ভাবেই তার কড়া সমালোচনা করেছে বিরোধী বামফ্রন্ট। বিমানবাবুর কথায়, “ধর্মঘট যত এগিয়ে আসছে, রাজ্য সরকারের তরফে দমন-পীড়নমূলক মনোভাব নেওয়া হচ্ছে। ধর্মঘট আটকানোর জন্য কালা ফতোয়া জারি করা হচ্ছে। মানুষ-মারা নীতির প্রতিবাদে, জীবন-যন্ত্রণা লাঘবের জন্য এবং তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের এই কর্মসূচিতে (ধর্মঘট) আমরা পাশে আছি।” সারা ভারতে ধর্মঘট হলেও এ রাজ্যের তৃণমূল নেতৃত্বাধীন সরকার কেন তা যেনতেন প্রকারে ‘ব্যর্থ’ করতে চাইছে, তা নিয়েও সরব হয়েছেন বিমানবাবু।
তাঁর বক্তব্য, ধর্মঘটের দাবিগুলি রাজ্যের বিরুদ্ধে নয়।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ধর্মঘটকারীদের মধ্যে থাকলেও আইএনটিইউসি-র রাজ্য শাখা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থাগুলিতে তাদের সংগঠনের কর্মীরা জোট শরিক তৃণমূলের মতোই ধর্মঘটে সামিল হবেন না। এই কথা তারা সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি সঞ্জীব রেড্ডিকে লিখিত ভাবে জানিয়েও দিয়েছে। শিল্প-কেন্দ্রিক বিষয়ে ধর্মঘটকে বামপন্থীরা কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী আন্দোলনে নিয়ে যাচ্ছেন বলে আগেই সরব হয়েছিলেন আইএনটিইউসি-র রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তিনি এ দিন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার পরিবহণ বাদ দিয়ে বাকি শিল্প ক্ষেত্রগুলিতে আইএনটিইউসি সামিল হবে। কিন্তু তার বাইরে স্কুল-কলেজ-অফিস-রাস্তাঘাট ‘স্তব্ধ’ করাকে তারা সমর্থন করবে না। সংগঠনের পরিবহণ কর্মীদের নিয়ে এক কনভেনশনে এ দিন প্রদীপবাবু বলেন, “পরিবহণ সংস্থাগুলি আর্থিক সঙ্কটে চলছে। তার উপরে ধর্মঘটে গেলে আরও ক্ষতি হবে।” তবে ধর্মঘটে অংশগ্রহণ নিয়ে রাজ্যে আইএনটিইউসি-র মধ্যেই কিছু ‘জটিলতা’ রয়েছে। ধর্মঘটকারী অন্য ১০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী এ দিন বলেন, “ধর্মঘট ভাঙতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে। প্রায় জরুরি অবস্থার মতো সরকারি কর্মীদের উপরে দমন-নীতি নামানো হচ্ছে! তবে এ সব দিয়ে দমানো যাবে না। মানুষ এ সব তুচ্ছ জ্ঞান করছেন। কারণ তাঁরা বহু সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।” শ্যামলবাবুরা জানান, ২৮ তারিখ ধর্মঘট সফল করতে শ্রমিক সংগঠনগুলি রাস্তায় নামবে।
সরকারও ছেড়ে কথা বলছে না। ধর্মঘটের দিন সরকারি কর্মচারীরা যাতে দফতরে আসতে পারেন, তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান পঞ্চায়েতমন্ত্রী। ধর্মঘটকে ‘আইন বিরোধী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “দলের মধ্যে যাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গেও আলোচনা করব। যাঁরা ধর্মঘটের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলব।” তবে সরাসরি ধর্মঘটকে সমর্থন করছে না, এমন কিছু ট্রেড ইউনিয়নের একাংশেরও বক্তব্য, মুখ্যসচিবের নির্দেশিকায় তারা ‘ব্যথিত’। তাদের মতে, ওই নির্দেশকায় মনে হচ্ছে, সরকার কর্মচারীদের ‘বিশ্বাস’ করছে না।
সরকারি কর্মীরা ধর্মঘটের দিন না-এলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সুব্রতবাবু বলেন, “সেটা বেআইনি কাজ করবেন! সে ক্ষেত্রে সরকার ‘কেস টু কেস’ বিচার করতে পারে।” তাঁর কথায়, “এক জন ব্যক্তি ছুটি নিলে এক রকম। কোনও বিভাগ গণছুটি নিলে আর এক রকম।” প্রশ্ন ছিল, তিনি দীর্ঘ দিনের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। ধর্মঘট করা কি আইনবিরুদ্ধ? আইএনটিটিইউসি-র সর্বভারতীয় সভাপতি সুব্রতবাবু বলেন, “ধর্মঘটের আইন আছে, অধিকার আছে, নিয়মকানুন আছে। ওদের (সিপিএমের) কারণে ধর্মঘট করতে হবে, এ রকম কোনও নিয়ম নেই। সরকারি কর্মচারীরা ধর্মঘট করতে পারেন কি না, তা নিয়ে আইনে নির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।” ধর্মঘটের দিন পর্যাপ্ত যানবাহন চলবে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় যথেষ্ট পুলিশ থাকবে বলে জানিয়ে দেন সুব্রতবাবু।
রাজ্যের আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক এ দিন জানান, ধর্মঘটের দিন সরকারকে জনজীবন সচল রাখতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে বলেছে আদালত। মুখ্যসচিব যে নির্দেশিকা জারি করেছেন, তা ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। মলয়বাবু ফের বলেন, “ওই দিন কোনও ছুটি অনুমোদন করা হবে না।” বস্তুত, ধর্মঘট নিয়ে দায়ের হওয়া জনস্বার্থের মামলাটি অর্থহীন এবং নিষ্প্রয়োজন বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আইনজীবী আবীর রঞ্জন নিয়োগীর দায়ের করা এই মামলার শুনানির পরে প্রধান বিচারপতি জে এন পটেল ও বিচারপতি সম্বুদ্ধ চক্রবর্তীর ডিভিশন বেঞ্চ কোনও নির্দেশ ছাড়াই মামলাটির নিষ্পত্তি করে দেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ধর্মঘটকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করার জন্য বিভিন্ন সংগঠনকে মামলার প্রতিলিপি পাঠাতে হবে। সব পক্ষের বক্তব্য শোনার পরেই আদালত তার মত জানাতে পারে। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল অনিন্দ্য মিত্র হাইকোর্টকে জানান, রাজ্যের মুখ্যসচিব ইতিমধ্যেই বিজ্ঞপ্তি জারি করে সব দফতরের কর্তাদের ধর্মঘটের দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। আদালত চাইলে সেই নির্দেশনামা তিনি পেশ করতে পারেন। এর পরেই ডিভিশন বেঞ্চ জানায়, ধর্মঘটের দিন জীবনযাত্রা সচল রাখে ত রাজ্য সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাই হাইকোর্টের কোনও নির্দেশের প্রয়োজন নেই। |