ছুটি মঞ্জুরি বিতর্ক
বনধ আর সম্মেলনে তুলনাই হয় না, মত রাজ্যের
সার্বিক জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে সীমাবদ্ধ স্থানে আয়োজিত কোনও কর্মী সংগঠনের নিজস্ব সম্মেলনের আদপেই তুলনা হতে পারে না বলে মনে করে রাজ্য সরকার। যে কারণে গত ডিসেম্বরে তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের রাজ্য সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের ‘বিশেষ ছুটি’ মঞ্জুরির মধ্যে তারা কোনও অন্যায় দেখছে না। আর এই যুক্তিতেই সরকারের দাবি, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি বামপন্থীদের ডাকা ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিত কর্মীদের ছুটি মঞ্জুরিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারা কোনও অন্যায় করেনি।
কিন্তু সরকারি কর্মীদের রাজনৈতিক দল প্রভাবিত সংগঠনের সম্মেলনে যোগদান কিংবা রাজনৈতিক দলের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে ‘সামিল’ হওয়া দু’টোতেই তো রাজনীতি জড়িত! তা হলে দুই ক্ষেত্রে সরকারের দু’রকম নীতি কেন?
মহাকরণের বক্তব্য: দু’টি ক্ষেত্রে রাজনীতি জড়িত হলেও জনজীবনে প্রভাবের নিরিখে দু’টি সম্পূর্ণ আলাদা। প্রথমটির কোনও প্রত্যক্ষ প্রভাব জনমানসে পড়ে না। অপরপক্ষে ধর্মঘট-বনধে নাগরিক পরিষেবা ব্যাহত হয়, স্তব্ধ হয়ে যায় জনজীবন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি যে পরিস্থিতির প্রথম মুখোমুখি হতে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার। পূর্বতন বাম জমানায় এমন সব ‘হরতালের’ দিনে সরকারি কর্মীরা কাজে না-এলেও ‘সবেতন ছুটি’ ভোগ করতেন। কারণ, বামফ্রন্ট সরকার ঘোষিত ভাবেই ছিল কর্মচারীদের ‘ধর্মঘটের অধিকারের’ পক্ষে।
কিন্তু রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূলের দাবি, তারা বনধ-ধর্মঘট ডেকে রাজ্য অচল করার ‘সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে। তাই সাম্প্রতিক কালের মধ্যে তারা ও পথে হাঁটেনি। এমনকী, সরকারে এসেও দলের মুখ্যমন্ত্রী থেকে শ্রমমন্ত্রী, সকলেই সরকারি কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন। মহাকরণের মতে, সরকারি কর্মীরা নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের স্বার্থে সংগঠন করতে পারেন, কিন্তু পুরোদস্তুর ‘ট্রেড ইউনিয়ন’ করা তাঁদের মানায় না। কারণ, সরকারি অফিস কারখানার গেট নয়। তাই নাগরিককে সরকারি পরিষেবাদানের দায়িত্ব যাঁদের, সেই সরকারি কর্মচারীরা স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত করা বনধ-আন্দোলনে সামিল হতে পারেন না বলে সরকার মনে করে।
এবং এই মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই মহাকরণ ঘোষণা করেছে, ধর্মঘটের দিন অনুপস্থিত সরকারি কর্মচারীদের ছুটি মঞ্জুর করা হবে না। কারণ, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সে দিন সরকারি কর্মীদের হাজিরা নিশ্চিত করতে চায় রাজ্য। যে সিদ্ধান্ত ঘিরে ইতিমধ্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। সরকারি কর্মীদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের’ অভিযোগ তুলেছে বামপন্থীরা। গত ডিসেম্বরে মহাজাতি সদনে আয়োজিত তৃণমূল কর্মী সংগঠনের চার দিন ব্যাপী রাজ্য সম্মেলনের প্রসঙ্গও উঠে আসছে। বিরোধী মহলের প্রশ্ন: ধমর্ঘটের দিন অনুপস্থিত থাকলে ছুটি মঞ্জুর না-করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে সরকার, তারাই কী ভাবে ওই সম্মেলনে উপস্থিত দেড় হাজার কর্মীকে ‘বিশেষ ছুটি’ দিল?
প্রশাসন অবশ্য এর মধ্যে কোনও বিরোধ বা অন্যায় দেখছে না। রাজ্যের এক মুখপাত্রের কথায়, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে দু’টোকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বনধ-ধর্মঘটের প্রভাব সর্বাত্মক। যাঁরা তা সমর্থন করেন না, তাঁরাও এর শিকার হন। সম্মেলনে যোগদানের সঙ্গে এর কোনও তুলনাই হয় না। সম্মেলন একটা ঘেরাটোপে, সমমনোভাবাপন্ন লোকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বাইরে প্রভাব পড়ে না।” সরকারি মতের সমর্থনে তৃণমূল কর্মী সংগঠনগুলোরও বক্তব্য: ধর্মঘট হল কল-কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডের অন্যতম হাতিয়ার, যা কোনও মতেই সরকারি কর্মীদের আন্দোলনের কর্মসূচি হতে পারে না। সংগঠনের সম্মেলনকে এর সঙ্গে এক করে দেখা ঠিক নয় বলে তৃণমূল কর্মী-নেতাদের দাবি। দু’টোর ‘পার্থক্য’ বোঝাতে গিয়ে রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও বৃহস্পতিবার বলেন, “স্রেফ ধর্মঘটের একটা নোটিস দিয়ে দিলেই তো সব হয়ে যায় না!”
মন্তব্যটির ব্যাখ্যাও দিয়েছেন শ্রমমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “সম্মেলন হল কোনও সংগঠনের গণতান্ত্রিক প্রয়াস। আগাম তা জানালে সরকার প্রতিনিধিদের জন্য ছুটি মঞ্জুর করে। এটাই চালু নিয়ম। কিন্তু ধর্মঘট করবে বলে সরকারের কাছে যে নোটিস দেওয়া হয়েছে (রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির দেওয়া), তাতে নিয়ম মানা হয়নি।” কেন? পূর্ণেন্দুবাবুর যুক্তি, “নিয়মানুযায়ী নোটিস পেলে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি তা খতিয়ে দেখে। ধর্মঘটীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। এতে মাসখানেক লাগে। এ বারের ধর্মঘটের নোটিস নিয়ে এ সব কিছুই হয়নি।”
ছুটি না-মঞ্জুরের আগাম ঘোষণা হয়ে গেলেও ২৮শে কাজে না-এলে নতুন সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ধর্মঘটে অনুপস্থিত সরকারি কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ নিয়ে বাম আমলেও কম শোরগোল হয়নি। সরকারি তথ্য বলছে, ২০০৪-এর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে যথাক্রমে এসইউসি এবং তৃণমূলের ডাকা বনধে গরহাজির রাজ্য-কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তা সত্ত্বেও গরহাজির কর্মীরা সবেতন ছুটি পেয়েছিলেন। ২০০৮-এ বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটের দিন কাজে না-এলে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, তদানীন্তন মুখ্যসচিবের জারি করা নির্দেশিকায় তার উল্লেখই ছিল না! এ বার অবশ্য ছুটিতে ‘নিষেধাজ্ঞা’ দিয়ে মুখ্যসচিবের নির্দেশিকার পাশাপাশি শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে ধর্মঘট বিরোধিতায় তাঁরা রাস্তায় নামবেন। অন্য দিকে ধর্মঘটকারীদের তরফে এআইটিইউসি-র গুরুদাস দাশগুপ্ত প্রশ্ন তুলেছেন, “কোন আইনে মুখ্যসচিব বলতে পারেন যে, ছুটি নিলে ‘ব্রেক অফ সার্ভিস’ও হতে পারে? তা হলে তো ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করতে হয়! তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা এক বার করেছিলেন। পরে তাঁকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল!”
২৮শে ফেব্রুয়ারির পরে কী হয়, সেটাই এখন দেখার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.