রাজনীতির ‘দুর্বৃত্তায়নে’র যে সংস্কৃতি এ রাজ্যে কায়েম করেছিল শাসক সিপিএম, পালাবদলের পর তারই ‘মাসুল’ দিতে হচ্ছে তাদের। কার্যত সর্বসমক্ষে, দিনের বেলায় বর্ধমানে তাদের দুই নেতার খুন হওয়ার ঘটনায় দলের একাংশের কাছে তা মোটামুটি স্পষ্ট। প্রাথমিক শোক, ক্রোধ এবং বিহ্বলতা কাটার পর রাজনৈতিক ময়নাতদন্তে নেমে সেই ‘সত্য’ উড়িয়ে দিতে পারছেন না দলের নেতারা।
বুধবার বর্ধমানের উপকণ্ঠে ‘গণরোষে’র ফলে খুন হতে হয়েছে সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তা’কে। তাঁর সঙ্গেই খুন হয়েছেন দলের সত্তরোর্ধ্ব নেতা কমল গায়েন। মূলত শ্রমিক ফ্রন্টের নেতা হলেও দলের অন্দরে প্রদীপবাবুর সামগ্রিক পরিচিতি ছিল ‘দাপুটে এবং ডাকাবুকো’ নেতা হিসেবেই। নিহত প্রদীপবাবুর মেয়েও বলেছেন, “এই পরিস্থিতিতে এলাকায় বেরোনোর মতো মানুষ তিনি একাই ছিলেন।” সিপিএম নেতারাই জানাচ্ছেন, কমলবাবুর মৃত্যু হয়েছে কার্যত বেঘোরে। আক্রমণকারীরা মারতে চেয়েছিল প্রদীপবাবুকেই। যে কারণে তাঁর নিষ্প্রাণ দেহেও উপর্যুপরি আঘাত করেছে হামলাকারীরা।
ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে তৃণমূলের চার জনকে পুলিশ গ্রেফতার করলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বিষয়টি সিপিএমের ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে’র ফল। রাজ্য মন্ত্রিসভার এক বর্ষীয়ান সদস্যের কথায়, “যাদের ধরা হয়েছে, তারা তৃণমূল হলেও শোনা যাচ্ছে, হামলাকারীদের মধ্যে অনেকে ছিল, যারা সিপিএম থেকে ইদানীং আমাদের দলে ভিড়েছে।”
অর্থাৎ, তারা এখন ‘তৃণমূল করে’। যা থেকে স্পষ্ট যে, শাসক শিবিরও এই ‘সত্য’ প্রকারান্তরে মেনে নিচ্ছে, সিপিএমের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ‘দায়’ পেয়েছেন (মতান্তরে, নিয়েছেন) মমতা। রাজ্য মন্ত্রিসভার এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের কথায়, “দেউলিয়া রাজকোষের মতোই সিপিএমের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নও আমাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। এই বিষয়টায় আমাদের অনেক সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সিপিএমের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা বেনোজলের মতো আমাদের দলে ঢুকেছে। আমাদের আরও কঠোর
হওয়া উচিত ছিল। বিশেষত, যখন আমরা পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছি।” |
সিপিএমের একাংশের তরফে (তাঁদের মধ্যে দীপক সরকারের মতো জেলা সম্পাদক পদমর্যাদার নেতাও রয়েছেন) বরাবর প্রদীপবাবুর মতো নেতাদের ‘দলের সম্পদ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বস্তুত, সিপিএমের নেতারা জানাচ্ছেন, এলাকায় কোনও অপারেশন হলে সাধারণত এই ধরনের নেতারা আড়াল থেকে বিষয়টি ‘সংগঠিত’ করেন। কিন্তু প্রদীপবাবু নিজেই এলাকায় চলে যেতেন। সে কারণে স্থানীয় স্তরে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু একই কারণে তিনি বিরোধীদের মূল টার্গেট ছিলেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন যে প্রদীপবাবু ‘দাপুটে’ ছিলেন, ক্ষমতা বদলের পর তাঁকে সেই ‘দাপটে’রই বলি হতে হল! তিনি যে দলের ‘স্ট্রং-ম্যান’ ছিলেন, তা স্বীকার করে নিয়েই সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, “মানছি, প্রদীপবাবুর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ছিল। তাঁর স্বভাবই ছিল গোলমালের ঘটনায় সামনে থেকে গিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। দলীয় কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু তার মানেই কি তাঁকে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে?”
প্রসঙ্গত, সিপিএমের এই ‘স্ট্রং-ম্যান’দের তালিকায় যেমন রয়েছেন প্রাক্তন মন্ত্রী, অধুনা গড়বেতার বিধায়ক, কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত সুশান্ত ঘোষ, তেমনই রয়েছেন তপন ঘোষ-সুকুর আলিরা। রয়েছেন গোঘাটের অভয় ঘোষ। রয়েছেন আরামবাগের অনিল বসু এবং হলদিয়ার
লক্ষ্মণ শেঠ (শেষ দু’জন সদ্য রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। কিন্তু সিপিএমের ভরাডুবি না-হলে তা-ও সম্ভব হত কি না, তা নিয়ে দলেই যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে)। ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ এই নেতাদের বরাবর অপছন্দের তালিকাতেই রেখেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশ। কিন্তু এলাকায় এলাকায় তাঁদের ‘দাপট’ দলের একাংশের কাছে আবার তাঁদের ‘অপরিহার্য’ করেছে। নন্দীগ্রাম ‘পুনর্দখলের’ মতো বিভিন্ন ঘটনার সময় এই ধরনের নেতাদের নেতৃত্বেই ঝাঁকে ঝাঁকে বহিরাগত সশস্ত্র অপরাধীদের নিয়ে আসা হয়েছে। জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এলাকা দখলের জন্য তাঁরা একের পর এক ‘বাহিনী’ নামিয়েছেন। যার বড় অংশ সরবরাহ করা হয়ে এসেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন ‘কুখ্যাত’ এলাকা থেকে।
দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পর রাজ্যে শাসক বদলানোয় সেই ‘বাহিনী’র অধিকাংশই এখন তৃণমূলে। যে কারণে বর্ধমানের ঘটনায় ধৃতরা তৃণমূলের বলে জানার পর মহাকরণে রাজ্যের মন্ত্রী (যিনি একই সঙ্গে মমতার যথেষ্ট ‘আস্থাভাজন’ও) ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, “রাজ্যে পরিবর্তনের পর এখন তো সকলেই তৃণমূল!”
ফিরহাদ বিলক্ষণ জানেন, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মমতা ক্ষমতায় আসার পর সিপিএমের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা দ্রুত শিবির বদলে তৃণমূলে এসেছে। যে পর্ব শুরু হয় লোকসভা ভোটের পরেই। এমন নয় যে, তা জানতেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।
তৎকালীন বিরোধী দলনেতা এবং অধুনা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় একাধিক সভায় তখন বলেওছিলেন, “দলে একটা ছাঁকনি প্রয়োগ করতে হবে বেনোজল ঠেকাতে।” পার্থবাবু এ দিনও বলেন, “১৯৭৭ পরবর্তী সময় পুরোটাই সন্ত্রাস-হত্যার ইতিহাস।” যা তিনি বলেননি, সেই ‘ইতিহাসে’র ‘দায়’ এখন তাঁদের উপরেও বর্তেছে।
কিন্তু দলেরই শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের ‘অনাগ্রহে’ সেই ছাঁকনি আর লাগানো যায়নি। ফলে দলে দলে প্রাক্তন সিপিএম তৃণমূলে নাম লিখিয়েছে। জেলা সফরে গিয়ে যাদের দেখে দলের প্রবীণ সাংসদরাও বিস্মিত হয়েছেন। দলের অন্দরে এরা ‘রেড তৃণমূল’ বলে পরিচিত (ঠিক যেমন পূর্ণেন্দু বসু বা দোলা সেনের মতো মন্ত্রী-নেত্রীরা পরিচিত আড়ালে পরিচিত ‘এফআরসিএস’ বলে। অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্রে যেমন বিলিতি ডিগ্রিধারী বহিরাগতদের কদর বেশি, তেমনই দোলা-পূর্ণেন্দুদের মতো বহিরাগতদেরও দলে কদর বেশি)। আর প্রথম থেকে তৃণমূলে-থাকা নেতা-কর্মীরা পরিচিত ‘গ্রিন তৃণমূল’ বলে। মতান্তরে, এই দু’পক্ষকে ‘নব তৃণমূল’ ও ‘আদি তৃণমূল’ও বলা হয়।
বিধানসভা ভোটের পর থেকেই দলের অন্দরে ‘রেড তৃণমূলে’র সঙ্গে ‘গ্রিন তৃণমূলে’র লড়াই তুঙ্গে। সিপিএম থেকে-আসা দুর্বৃত্তরা নতুন জমানাতেও শাসকদলের ‘মদতপুষ্ট’। বস্তুত, সেই কারণেই তাদের দলবদল। তারা এখনও সশস্ত্র। এমন নয় যে, দলের নেতারা তা জানেন না।
বস্তুত, দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “হার্মাদবাহিনী কাজে লাগিয়ে সিপিএম এতদিন রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রেখেছিল। আমাদের নেত্রী কখনও বোমা-গুলি-বন্দুকের রাজনীতি করেননি। করতেও চান না। কিন্তু সিপিএমের সঙ্গে লড়তে গেলে নিজেদেরও শক্তিশালী করতে হবে।”
ফলিত স্তরে এর সব চেয়ে বেশি প্রয়োগ সম্ভবত দেখা গিয়েছে জঙ্গলমহলে। যেখানে সিপিএমের ‘হার্মাদবাহিনী’র মোকাবিলায় তৈরি হয়েছে তৃণমূলের ‘ভৈরববাহিনী’। মোটরবাইক, অস্ত্র, কপালে ফেট্টি সব একই রকম আছে। শুধু ফেট্টির লাল রং বদলে গিয়ে তেরঙা হয়েছে।
পালাবদলের পর ‘প্রতিহিংসার রাজনীতি’ বন্ধে পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর এবং দলের নেতাদের দাবি, “সেই কারণেই রাজ্যে রক্তগঙ্গা বয়ে যায়নি।” কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, প্রদীপবাবুদের নিয়ে এখনও পর্যন্ত মোট ৫৮ জন খুন হলেন শাসক দলের হাতে। যে অভিযোগ মানতে নারাজ মমতা।
কিন্তু বর্ধমানের ঘটনা দেখিয়ে দিল, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ‘উত্তরাধিকার’ প্রাক্তন শাসক থেকে বর্তমান শাসকে বর্তেছে। রাজনৈতিক হিংসার ‘ঐতিহ্য’ জারি রয়েছে রাজ্যে। রবীন্দ্রনাথও থামাতে পারেননি। |