চলতি সফরের প্রথমার্ধে অস্ট্রেলীয় পেস বোলিং যদি নাগাড়ে আক্রমণে বিধ্বস্ত করে থাকে ধোনির ভারতকে। সফরের দ্বিতীয়ার্ধে ধোনির সংসারকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে বোর্ডের রোটেশন নীতি।
বুধবার অস্ট্রেলিয়ায় ফোন করে জানা গেল, ধোনি বনাম সহবাগ বিতর্কে শিবির এখন প্রকাশ্যে ক্ষতবিক্ষত। এ দিন ব্রিসবেন থেকে সিডনি উড়ে গেল টিম। দলের সফরসূচির ভাষায় ট্র্যাভেল ডে। যে দিন শুধুই ভ্রমণ, কোনও বৈঠক হয় না। বৈঠক হবে বৃহস্পতিবার দুপুরে। আর সরাসরি আলোচনা হল না বলেই যেন আরও বেশি ভেতরে ভেতরে গুমরে থাকল টিম। এ দিকে সহবাগের মুখ খোলার জের নিয়ে ক্রিকেট বোর্ডের প্রশাসনিক মহলে তীব্র আলোচনা হল চেন্নাই থেকে নয়াদিল্লি। মুম্বই থেকে ইনদওর। অনেকেরই মনে হচ্ছে মিডিয়া ম্যানেজার জি এস ওয়ালিয়া কেন সহবাগকে থামালেন না? তা হলে বিতর্ক এই পর্যায়ে যেত না। শোনা যাচ্ছে ওয়ালিয়া সাফাই দিয়েছেন সহবাগের মতো সিনিয়র ক্রিকেটারকে তিনি থামাবেন কী করে? বোর্ড কর্তাদের একটা অংশ মনে করে প্রাথমিক গণ্ডগোলটা করেছেন ধোনি। রোটেশন পদ্ধতির কথা এত খুলেআম তাঁর বলার প্রয়োজন ছিল না। আর সহবাগ! তিনিও দায়ী। এত খোলামেলা তাঁর মুখ খোলা উচিত হয়নি।
রবিবার সিডনির অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে আর একপ্রস্ত বিতর্ক দানা বাঁধার আশঙ্কা ব্যাটিং ইউনিটের ত্রিমূর্তিকে নিয়ে। তাঁদের মধ্যে কে বসবেন তা নিয়ে। বোর্ড কর্তাদের স্থির বিশ্বাস সহবাগের ম্যাচ ফিটনেস নেই। সমস্যা হল তিনি শুধু উড়ে গিয়ে গাব্বায় ক্যাচই ধরেননি, ফিজিও তাঁকে ফিট সার্টিফিকেটও দিয়েছেন। টিম ফিজিও যদি মহাতারকাদের ফিট সার্টিফিকেট দিয়ে দেন তখন খালি চোখে যা-ই মনে হোক, সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাস্তা খোলা থাকে না। |
সহবাগ বনাম ধোনি বিতর্ক উত্তুঙ্গ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে দেখে পারতপক্ষে যিনি মিডিয়ার সামনে আসেন না সেই বোর্ড প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাসন এ দিন মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন। সংবাদসংস্থায় বলেছেন, “ধোনি বনাম সহবাগ নিয়ে জল্পনা খুব বাড়াবাড়ি। আমাদের কাছে এমন কোনও খবর নেই। উদ্বিগ্ন হওয়ারও কিছু নেই।” শ্রীনিবাসন আরও বলেছেন, “মিডিয়া ম্যানেজারকে আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি যা লেখা হয়েছে তা বাড়াবাড়ি।” বিসিসিআই ভাইস প্রেসিডেন্ট রাজীব শুক্লও দাবি করেছেন, “দলে কোনও বিভেদ নেই। মিডিয়ার একটা অংশ এ সব প্রচার করছে। আমরা টিমের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখছি।” ঘটনা হল দুই কর্তাই বুধবার ফোনে ওয়ালিয়াকে ধমকেছেন যে, তিনি কেন ব্যাপারটা এই পর্যায়ে যেতে দিলেন। কেন তিনি সহবাগকে আগে থামাননি। শুক্ল আবার দাবি করেছেন, রোটেশন পদ্ধতি বলে বোর্ড কিছু দেয়নি। চূড়ান্ত একাদশ ঠিক করছে ট্যুর ম্যানেজমেন্ট কমিটি। যার মধ্যে থাকেন অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক ও কোচ। এটাও ঠিক দাবি নয়। রোটেশন পদ্ধতি বোর্ডেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তবে তা নিয়ে এই পরিমাণ নেতিবাচক বিতর্ক তৈরি হবে বোর্ড ভাবেনি। তাই সচেতন ভাবে দায়ভার নেওয়া থেকে দূরে থাকছে।
এরই মাঝে বুধবার নতুন বিতর্ক হতে যাচ্ছিল সুরেশ রায়নাকে নিয়ে। ব্রিসবেন টিম হোটেল থেকে ভারতীয় প্লেয়ারদের নিয়ে বিমানবন্দরের দিকে বাস ছাড়ার কথা ছিল সকাল দশটায়। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পাঁচেক বাদেও একমাত্র রায়না নামেননি। নিজের ঘরে নাকি তখনও ঘুমোচ্ছিলেন। তাঁকে ফেলে রেখেই তখন কোচ রওনা হয়ে যায় বিমানবন্দরের দিকে। রায়না পরে দৌড়তে দৌড়তে ট্যাক্সি করে কোনও মতে প্লেন ধরেন। সাম্প্রতিক কালে বিদেশে কোনও ক্রিকেটারের এ ভাবে বাস মিস করা বেনজির। অনেকের মতে টিমের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে নেমেছে এটা তার আরও এক প্রতীক।
সৌরভের আমলে কেন, তার পরেও নিয়ম ছিল কোনও ক্রিকেটার কোনও অনুষ্ঠান থেকেও দেরি করে বাসে উঠলে তাকে জরিমানা করা হত। এমনকী তেন্ডুলকরকেও নিয়মের ঊর্ধ্বে রাখা হয়নি। রায়নার ক্ষেত্রে জরিমানার কোনও খবর এখনও জানা যায়নি। এমনিতেও তিনি টিমের খুব প্রিয়পাত্র। অধিনায়কের তো বটেই। টিম এখন এমন অবস্থায় যে ২৬ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি বাকি দুটো ম্যাচে না জিতলে সোজা দেশে ফেরার বিমান ধরতে হবে। উপর্যুপরি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছেন রায়না ও রোহিত শর্মা। ৬ ম্যাচে রায়নার রান ১৩৪। গড় ২২। রোহিত করেছেন ৫ ম্যাচে ৭৯। গড় ১৫।
এঁদের যা পারফম্যান্স বাকি দুই ম্যাচে মনোজ তিওয়ারির নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকারই কথা নয়। যেখানে নিজের খেলা শেষ ওয়ান ডে ম্যাচে তিনি সেঞ্চুরি করে বসে আছেন। অথচ ধোনি এখনও বলে যাচ্ছেন রায়না বল করতে পারে। ওকে রাখাটা সুবিধে। রেকর্ড জানাচ্ছে রায়না ৬ ম্যাচে ১২ ওভার বল করেছেন। মাত্র এক উইকেট। গড় ৫৮। ওয়ান ডে বিচারে যা কল্পনার অতীত খারাপ। অস্ট্রেলিয়ায় গোটা ওয়ান ডে সিরিজে বসে বসে ক্লান্ত মনোজের মনে হতেই পারে এর চেয়ে দেশে ফিরে বিজয় হাজারে ট্রফি খেললে তিনি অন্তত ম্যাচ প্র্যাক্টিসে থাকতেন।
ভারতের চলতি অস্ট্রেলিয়া সফর দেশের সর্বকালীন দুঃস্বপ্নের ক্রিকেট সফরের মধ্যে ক্রমশ ঢুকে পড়ছে। আজও সর্বকালের সবচেয়ে দুঃস্বপ্নের সফর ধরা হয় চুয়াত্তরের ইংল্যান্ড সফরকে। ওয়াড়েকরের নেতৃত্বে ওই সফরে ০-৩ হেরে ফিরেছিল দল। লর্ডসে অলআউট হয়ে গিয়েছিল ৪২ রানে। মাঠের বাইরে ঘটেছিল একরাশ অবাঞ্ছিত বিতর্ক। এ বারের সফরে ক্রমাগত তারই ছায়াপাত। অস্ট্রেলিয়ায় গত বারের ওয়ান ডে সিরিজ যিনি অনেক বেশি কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জিতিয়েছিলেন, তিনি ধোনির এই দলেও আছেন।
কিন্তু তিনি সচিন তেন্ডুলকর ওয়ান ডে সিরিজের শেষে এসে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিয়েছেন। রোটেশন পদ্ধতি মেনে নিতে পারছেন না। ভাবে-ভঙ্গিতে বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট বিরক্ত। বিরক্তি সরিয়ে মন দিয়েছেন অনুশীলনে। টিমমেটদেরও কারও কারও মনে হচ্ছে তিনি যেন বরাবরের সচিন নন। একই সঙ্গে তাঁদের মনে হচ্ছে এখনও এই পড়ন্ত ফর্মেও ধোনির ভারতের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের তিনিই অন্তিম আশা! |