প্রবন্ধ ৪...
শুধু জমি নয়, অস্বচ্ছ চিন্তাও এ রাজ্যে বিনিয়োগের ঝুঁকি
প্রবীণ মানুষ। বিশ্বদর্শন হয়েছে কর্মসূত্রে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। কিন্তু পায়ের তলায় সর্ষে। সম্প্রতি গুরগাঁও থেকে দিল্লি ফেরার পথে টোল গেটের ভিড় দেখে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। “পশ্চিমবঙ্গেও তো এই ভাবে রাস্তা হতে পারে।” রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পরিকাঠামো গড়তে যে ভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের কথা বলছেন, সেটাই ছিল এই চিন্তার প্রেক্ষিত। কিন্তু পিতৃপ্রতিম আত্মীয়টি পরমুহূর্তেই বিষণ্ণ। রাস্তায় বিনিয়োগকে লাভজনক করে তোলার পূর্বশর্তই হল আশেপাশের অঞ্চলে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। যদি গাড়ির ভিড় না হয় তা হলে টোলের বাক্সও ভরবে না। দিল্লিকে ঘিরে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, রাস্তার চাহিদা তার জন্যই। এই ভিড় না পেলে, বেসরকারি বিনিয়োগ আসবে না।
ভেঙে পড়া রাজকোষ এড়িয়ে রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগকেই বাঁচার রাস্তা ভাবছে নতুন সরকার। এটা ভুলে গিয়ে যে, দিল্লিকে ঘিরে পরিকাঠামোয় প্রাথমিক বিনিয়োগ কিন্তু সরকারই করেছে। দিল্লির সীমানার রাজ্যগুলিও এই যজ্ঞে কম-বেশি অংশীদার। সে হরিয়ানাই হোক বা উত্তরপ্রদেশ। যে ক’টি রাজ্য আজ বিনিয়োগে এগিয়ে, তাদের পরিকাঠামো-ভাবনা বিনিয়োগ দানা বাঁধার অনেক আগে থেকেই শুরু।
পৃথিবীর কোনও দেশেই ব্যবসা সম্পূর্ণ সরকারের সাহায্যরহিত হয়ে বাঁচতে পারে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, ব্যবসা এখানে যতটা ভোট কেনার যন্ত্র ততটা উন্নয়নের সঙ্গী হতে পারেনি রাজনীতির কারণে। এ রাজ্যে গত তিন দশকে লগ্নিকারী ছিলেন ব্রাত্য। গত এক দশকে কোষাগার শুকিয়ে যাওয়ার পরে হঠাৎ সরকারের মনে হল, “তাই তো, কারখানা ছাড়া চাকরি কোথা থেকে হবে?” রাতারাতি লগ্নিকারীদের জন্য পাতা হল লাল কার্পেট। ১৯৯৫-৯৬ থেকে শুরু হল “গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গ’-র স্লোগান।
২০১১-র ভোটে বামফ্রন্ট বিদায়ের পর, নতুন সরকার এল। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তায় বিনিয়োগ নিয়ে কোনও নতুন দিশা তো পাওয়াই গেল না, উল্টে এমনিতেই শিল্প নিয়ে ঘেঁটে-থাকা বাঙালি-যুক্তি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গ লগ্নির জন্য আরও অগম্য হয়ে উঠল।
কেন? অনেকেই বলছেন, জমি একটা বড় কারণ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের লগ্নি-বিরোধী ভাবমূর্তির পিছনে আরও বড় কারণ বোধ হয় রাজনৈতিক চিন্তায় শিল্প নিয়ে স্বচ্ছ ভাবনার অভাব। শিল্পমহল শঙ্কিত, বিনিয়োগ করার পরে সরকার তার ভাবনা যদি হঠাৎ বদলে ফেলে? বা তীব্র সংশয় তৈরি করে প্রকল্প নিয়ে? যেমন হয়েছে জিন্দলদের ইস্পাত প্রকল্পের জমি ঘিরে। এর ছাড়পত্র নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ঘনিয়ে উঠেছিল তা কিন্তু গোটা দেশ নজরে রেখেছিল। “জিন্দলদেরও কি টাটার দশা হবে?” এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিল সবার মনেই। বিরোধীর আসনে এবং প্রশাসকের ভূমিকায় বর্তমান সরকারের শিল্পভাবনায় খুব একটা ফারাক করতে পারছেন না উদ্যোগীরা।
গত বছর বিজয়ার অনুষ্ঠানে শিল্পপতিরা বলেছিলেন জমিটা সমস্যা, কিন্তু তা এড়ানোরও উপায় আছে। এই রাজ্যে যেখানে জমি কৃষির অনুপযুক্ত সেখানে শিল্প হতে পারে। কিন্তু সেখানে পরিকাঠামো এতটাই দুর্বল যে কারখানায় টাকা ঢালা সম্ভব নয়। সরকার যদি পরিকাঠামো গড়ার দায় নেয়, শিল্প নিশ্চয়ই সেখানে যাবে। তার উত্তরে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন শিল্পপতিরা কেন পরিকাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করবেন না?
এ থেকে শিল্পপতিরা কী পড়লেন? রাজ্য সরকার চাইছে পরিকাঠামোয় বেসরকারি বিনিয়োগ। এমন সব জায়গায় যেখানে উন্নয়নের আঁচ এখনও সে ভাবে পৌঁছয়নি। সরকার কেন চাইছে পরিকাঠামোয় বেসরকারি বিনিয়োগ? কারণ কোষাগারে টাকা নেই। কোষাগারের সমস্যা মেটানোর জন্য রাজ্য সরকার কি কর বসাতে আগ্রহী? কর না বসানোয় সরকারের রাজনৈতিক লাভ আছে। রাজনৈতিক লাভ তো শিল্পে বিনিয়োগ এলেও হবে, সব দলই তাই চায়। এই বার শুরু হচ্ছে সরকারের শিল্পভাবনা নিয়ে বড় বিনিয়োগের দুশ্চিন্তার জায়গা। পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ করলে কত দিনে সে টাকা উঠবে টোল বসিয়ে তার কোনও ঠিক নেই। কারণ শিল্পহীন অঞ্চলে রাস্তার সেই ব্যবহার কে করবে যা থেকে বিনিয়োগের টাকা উঠেও লাভ হবে কিছু। এইখানে দরকার সরকারের ‘গ্যারান্টি’। কিন্তু সেই ‘গ্যারান্টি’ কি সরকার রাখতে পারবে?
কোষাগারের যা অবস্থা তাতে তো সরকারি কর্মীদের বেতন চোকাতেই প্রশাসন নাজেহাল। এক বার টাকা ঢেলে ফেললে বলাও যাবে না, “তোমার হ্যাপা তুমি সামলাও, আমি পাততাড়ি গোটালাম।” সরকার কর বাড়াচ্ছে না জনমোহিনী নীতির স্বার্থে। আবার স্বীকারও করছে টাকা নেই! একই সঙ্গে পরিকাঠামোর প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করছে না! আবার, বিকল্পও কিছু ভাবছে না। তা হলে কি এই সরকার শিল্পের পক্ষে নির্ভরযোগ্য?
মেনে নেওয়া গেল টাকা নেই। তা হলে তো অন্য ব্যবহার থেকে অন্তত বোঝা যাবে শিল্প নিয়ে রাজ্যের চিন্তা গভীর। কিন্তু সেখানেও খুব একটা আশ্বাস পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। কয়েক মাস ধরে তোলাবাজিতে অতিষ্ঠ রাজারহাট-সেক্টর ফাইভ-এর তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। যেখানে পুলিশের হস্তক্ষেপ দরকার সেখানে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সমাধানসূত্র খোঁজা হচ্ছে। আর এই সব ঘটনাও শিল্পের স্বার্থে সরকারের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নচিহ্নটি গভীর করে তুলছে। আর ততই বড় বিনিয়োগ টানার সম্ভাবনা কমছে।
এর ফলে এ রাজ্য অবশ্যই বড় বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন গাড়ি শিল্প। টাটারা চলে যাওয়ার পর, তাদের পিছনে গুজরাতে ফোর্ড সহ একাধিক গাড়ি সংস্থা বিনিয়োগ করেছে। আমরা যদি ভাবি, আগামী দিনে এঁরা আসতেও পারেন, ভুল ভাবব না। কিন্তু তা পরবর্তী দশ বছরে হবে না। কারণ, এই সংস্থাগুলি সবই যে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়েছে তা আগামী দশ বছরে কথা ভেবেই।
তার মানে কি বিনিয়োগ হবে না? হবে। কিন্তু তাতে শিল্পহীনতার দুর্নাম ঘুচবে না। ছোটখাটো খুচরো বিনিয়োগে উন্নয়ন অভিমুখী শিল্পযজ্ঞ সম্ভব নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.