যে একাধিক বিষয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মতভেদ তৈরি হয়েছে, আজ তার অন্তত তিনটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে আলোচনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই তিনটি বিষয়, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র বা এনসিটিসি গঠন, ফরাক্কা এবং জিটিএ বিল নিয়ে মমতার দাবি মেনে নিলেন প্রধানমন্ত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে যে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় স্তরে সব থেকে বেশি বিতর্ক, সেই এনসিটিসি গঠন নিয়ে ‘সব রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে’ এবং রাজ্যগুলির উদ্বেগ দূর করেই কেন্দ্র এগোবে বলে মমতাকে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
আজকের এই বৈঠকটিকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছে রাজনৈতিক শিবির। কারণ গত কয়েক মাস ধরে কেন্দ্র এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্পর্কের গুমোট ক্রমশই বেড়ে চলেছিল। একের পর এক বিষয় নিয়ে নয়াদিল্লির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা সরকারের বৃহত্তম শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এই তিক্ততার আবহেই আজ প্রায় চার মাস পর মুখোমুখি বৈঠকে বসলেন মনমোহন-মমতা। রাজনৈতিক সূত্রের খবর, এর পর দু’তরফের মধ্যে মতপার্থক্যের পূর্ণাঙ্গ নিরসন না হলেও, গুমোট অনেকটাই কাটল।
এই তিনটি বিষয় ছাড়াও আরও একাধিক ক্ষেত্রে এখনও কেন্দ্র-রাজ্যের মতভেদ আছে। তার মধ্যে তিস্তা এবং রাজ্যের অর্থ সাহায্য দাবি গুরুত্বপূর্ণ। এ দিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে বেরিয়ে এসে মমতা অবশ্য বলেন, “রাজ্যের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসিনি। এই তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতেই এসেছিলাম।” রাজ্যের প্রশাসনিক সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র এখনও তিস্তা নিয়ে তাঁর রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীকে
দেননি। তাই আলোচনায় বিষয়টি ওঠেনি। |
বস্তুত, নিজের আলোচ্যসূচি সুনির্দিষ্ট করেই গত কাল গভীর রাতে দিল্লিতে পা রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নথিপত্রও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে এনসিটিসি তো ছিলই। সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে তিনি ফরাক্কা এবং জিটিএ-র বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন। আজ প্রথমেই ফরাক্কার জলের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে দিনের পর দিন বঞ্চিত হয়েছে, তা তথ্য ও পরিসংখ্যান-সহ মমতা তুলে ধরেছেন মনমোহন সিংহের সামনে। ফরাক্কা ব্যারাজে গত বছর দু’টি স্লুইস গেট অকেজো হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত ৩৩ হাজার কিউসেক জলের পরিবর্তে প্রায় ৮২ হাজার কিউসেক জল চলে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ফরাক্কার জল নিয়ে মমতা যে প্রশ্নটি আজ তুলেছেন তাকে যুক্তিযুক্তই মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী। মমতার কথায়, “এর ফলে আমাদের জলের স্তর এতটাই নেমে যাচ্ছে যে এর পর এনটিপিসি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। পানীয় জলের সমস্যা শুরু হচ্ছে। হলদি, ভাগীরথীর মত নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। জাহাজ চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আসন্ন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি আমি।” মন্ত্রিসভার দুই সদস্যকে তিনি ‘ঘটনাস্থলে’ পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা ফিরে এসে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, সেটিও আজ মনমোহন সিংহের হাতে তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী।
রাজনৈতিক সূত্রে বলা হচ্ছে, জাহাজ মন্ত্রক এ বিষয়ে আগেই জলসম্পদ মন্ত্রককে জানিয়েছিল। কিন্তু জলসম্পদ মন্ত্রক বিষয়টি নিয়ে গা করেনি। তবে আজ বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ বুঝতে পেরেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে মার্চের মধ্যেই ফরাক্কা ব্যারেজের দু’টি স্লুইস গেট মেরামত করা হবে। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ইতিমধ্যেই ১৬ এবং ১৩ নম্বর গেট দু’টি মেরামতের কাজ শুরু করে দিয়েছে।’
একই ভাবে আজ এনসিটিসি গড়ার বিষয়টি নিয়েও স্বর কিছুটা নরম করেছে কেন্দ্র। এটি গঠন করা হলে কী ভাবে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত নেমে আসবে, তা আজ প্রধানমন্ত্রীর সামনে বিশদে তুলে ধরেছেন মমতা। কেন্দ্রীয় সরকার এনসিটিসি গঠন নিয়ে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, সেই অনুযায়ী ১ মার্চ থেকে ওই কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা। কিন্তু এক ডজনেরও বেশি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরোধিতায় গত কয়েক দিন ধরে সক্রিয় থেকেছেন মমতা। গত মঙ্গলবার এ ব্যাপারে মমতা-সহ সাত জন মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠিয়ে আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন মনমোহন। আজ মমতার সঙ্গে সেই ‘আলোচনার’ পর পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট, অদূর ভবিষ্যতে এনসিটিসি চালু হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রীকে আমি জানিয়েছি, এই এনসিটিসি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে হাঁটে। কারণ এই সংস্থাকে ইউএপিএ-তে রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই যে কোনও সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা বা তল্লাশি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া যে কোনও সময় রাজ্যের সম্মতি ছাড়াই রাজ্য পুলিস বাহিনীকে কেন্দ্র চেয়ে পাঠাতে পারে। এই সব ক’টি বিষয়ই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী।”
মমতাকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে ইতিমধ্যেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করে সহমত তৈরির জন্য। মমতা বলেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, এক দিকে এই আলোচনার প্রক্রিয়া চালানো এবং অন্য দিকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে এনসিটিসি গঠন করা এই দু’টি বিষয় একসঙ্গে চলতে পারে না। তাতে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।”
বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিবৃতিতেও এ কথা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, এনসিটিসি গঠন করার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা হবে না। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে কী ভাবে সমস্ত রাজ্যের সঙ্গে সহমতের ভিত্তি গড়ে তোলা যায়, তা খুঁজে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ইউএপিএ-র যে ধারা নিয়ে রাজ্যগুলি আপত্তি তুলেছে, তা ব্যাখ্যা করার জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিব ও পুলিশের ডিজিদের বৈঠক ডাকা হবে।
এনসিটিসি এবং ফরাক্কা ছাড়া তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আজ কেন্দ্রের উপর চাপ তৈরি করেছেন মমতা, সেটি হল জিটিএ বিল। কেন্দ্রের ঢিলেমির জন্যই যে গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগছে, তা বিশদে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় পাশ হওয়ার পর গোর্খাল্যান্ড আঞ্চলিক প্রশাসন বা জিটিএ বিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করে এখনও রাষ্ট্রপতির কাছে অনুমোদনের জন্য বিলটি পাঠায়নি। দার্জিলিঙে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর ৭ মাস কেটে গিয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক প্রশাসন গঠন করা সম্ভব হল না।” মমতার বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে দু’দিনের মধ্যে বিষয়টি মিটে যাবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। অন্য দু’টির মতো এ ক্ষেত্রেও বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে দ্রুত প্রক্রিয়াটি শেষ করা হবে। |