আন্দোলন মানেই কি ‘কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ অথবা ‘সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে’র স্লোগান? সিপিএম মানেই কি তাত্ত্বিক বচন আর কঠিন তৎসম শব্দে লেখা নথি?
পশ্চিমবঙ্গে ‘বিরোধী’ সিপিএমকে ভাবাচ্ছে এই প্রশ্ন। আম জনতার লব্জ খুঁজে বার করতে এখন মাথা ঘামাতে হচ্ছে তাদের! এবং সেই দাবি উঠেছে সিপিএমের অন্দরেই। সদ্যসমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিদের একাংশের আক্ষেপ, সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণার কাছাকাছি স্লোগান দিয়ে আন্দোলন গড়তে পারলে সিপিএম প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধ-শতবর্ষ পরে কমিউনিস্ট পার্টি ‘মহীরুহে’ পরিণত হতে পারত! কিন্তু তাত্ত্বিক মোড়ক থেকে কথা বলায় সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সিপিএম রয়ে গিয়েছে ‘বনসাই’ হয়ে!
সেই ‘আক্ষেপ’ থেকেই সদ্যসমাপ্ত রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিদের একটি বড় অংশ প্রস্তাব দিয়েছেন, স্লোগান নিয়ে নতুন করে ভাবুক দল। এমন মন্ত্র হাজির করা হোক, যাতে যুব সম্প্রদায় এবং সমাজের নানা অংশের মনের কাছাকাছি যাওয়া যায়। অর্থাৎ সমাজে যা ‘বিকোয়’, সেই পণ্য নিয়ে নামা হোক বাজারে।
স্বাভাবিক। চোখের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখছেন তাঁরা।
তৃণমূল নেত্রীর ‘মা-মাটি-মানুষ’ স্লোগানকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যেরা ‘যাত্রাপালা’ বলে একদা কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু মমতার ওই স্লোগান বা ‘পরিবর্তনে’র সহজ-সরল ডাকই যে মানুষের কাছে পৌঁছেছিল, তার প্রমাণ সিপিএম হাড়ে-হাড়ে পেয়েছে। দলের অন্দরের মনোভাব আঁচ করে সাড়া দিয়েছেন পুনর্নির্বাচিত রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু। সম্মেলনের জবাবি ভাষণে তাঁর পরামর্শ, বাঁধা গতের আন্দোলন থেকে বেরোতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারা পাল্টাতে হবে। সব জনগোষ্ঠীর জীবন-যন্ত্রণা থেকে তুলে আনতে হবে আন্দোলন। তাতে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দলের ভিত্তিও প্রসারিত হবে। |
চিরাচরিত সিপিএম |
• স্কুল, কলেজ জীবনের মাধ্যমে ছাত্রদের নিয়ে দেশের
নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, মেহনতী জনতার প্রকৃত মুক্তি
সমাজবাদ, সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শোষণে
শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
(এক রাজ্য নেতার মৃত্যুতে শোক-প্রস্তাবে) |
|
নতুন সিপিএম |
• রায়গঞ্জে বেল, মাজদিয়ায় জেল।
(দুই কলেজের ঘটনা নিয়ে)
• কলকাতা হবে লন্ডন, কৃষকের হাতে লণ্ঠন।
(কৃষকদের সঙ্কট নিয়ে) |
|
বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “এটা শুধু বাজার নয়, আদানপ্রদানেরও মূল শর্ত। যে মানুষ যে ভাষা বোঝেন, তাঁর সঙ্গে সেই ভাষাতেই তো কথা বলতে হবে! সেই দিক থেকে এই উদ্যোগ ভাল। স্বাভাবিকও বটে।” বস্তুত, স্লোগান নিয়ে ‘নতুন ভাবনা’ কার্যকর হতে শুরু করেছে বলেও সিপিএম নেতৃত্ব মনে করছেন। বিদায়ী রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক প্রবীণ সদস্য উদাহরণ দিয়েছেন, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সম্মেলনে যাওয়ার পথে রাস্তায় সিপিএমের পতাকা নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মিছিলে একটি প্ল্যাকার্ড চোখে পড়েছিল ‘কলকাতা হবে লন্ডন, কৃষকের হাতে লণ্ঠন’! ওই নেতার মনে হয়েছিল, পুঁজিবাদ এবং নব্য উদারনীতির প্রভাবে কৃষি ক্ষেত্রের সঙ্কট বোঝাতে তাঁরা যত শব্দ ব্যয় করেন, তার চেয়ে অনেক সহজে কৃষকের কাছে পৌঁছনো যাবে এই স্লোগানে। তার পর থেকে ওই স্লোগান বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেদার ব্যবহার করা হচ্ছে। শিলুবাবুও মানছেন, যে অংশ ‘টার্গেট’, তাঁদের জন্য কঠিন শব্দের বিবৃতির চেয়ে ‘কৃষকের হাতে লণ্ঠন’ অনেক উপযুক্ত স্লোগান।
খবরের কাগজের শিরোনাম থেকে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে রায়গঞ্জ ও মাজদিয়ার কলেজের ঘটনার প্রেক্ষিতে স্লোগান তুলে আনা হয়েছে ‘রায়গঞ্জে বেল, মাজদিয়ায় জেল’! ব্রিগেড সমাবেশে রবিবারই বাঁকুড়া জেলা থেকে কিছু সমর্থক এসেছিলেন, যাঁদের মাথার টুপিতে লেখা ‘দম রাখো, খেলা ঘুরবে’! এই শব্দচয়ন সিপিএমের ব্যাকরণে ‘অভিনব’ বইকি!
রাজ্য সম্মেলনেও এই নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রতিনিধির মতে, কৃষক আন্দোলনের বিপুল ‘সম্ভাবনা’ কাজে লাগাতে ‘আকর্ষণীয় স্লোগান’ চাই। দলের মুখপত্রের তরফে এক প্রতিনিধি বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম’ ভাবতে হবে আর তার জন্য লাগবে নতুন স্লোগান। ‘মূল স্রোতে’র সংবাদমাধ্যমকে ‘বুর্জোয়া’ বলে দূরে ঠেলে না-রেখে পেশাদারি কায়দায় ‘মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট’ করতে হবে। নিটোল পরিকল্পনা করে সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং ব্লগ ব্যবহার করলে আরও অনেক মানুষের কাছে পৌঁছনো যাবে। যে কাজ সিপিএমের কিছু প্রযুক্তি-সড়গড় নেতা ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত স্তরে হাতে নিয়েছেন। প্রসঙ্গ উঠেছে কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক দূর করারও। যে ‘ফারাক’ থাকলে স্লোগান কখনও জনগণের মনোগ্রাহী হয় না। যেমন, সিটুর এক প্রতিনিধি বলেছেন, ‘শিল্পের জমিতে শিল্প চাই’ এই স্লোগান দিলেও বাম-জমানাতেই বন্ধ কারখানার জমিতে নির্মাণ শিল্পের ব্যবসা হয়েছে। তা হলে মানুষ কেন সিটুর কথা বিশ্বাস করবেন?
শিলুবাবুর অবশ্য প্রশ্ন, “উদ্যোগটা ভাল। কিন্তু যথেষ্ট কি? বিপণনের ক্ষেত্রে যখন একটা পণ্য বাজারে ব্যর্থ হয়, তখন অনেক সময়ই প্যাকেজিং বদলানো হয়। নতুন স্লোগান করলেই মানুষ সিপিএমকে আবার বিশ্বাস করবে কি না, বাজারের অভিজ্ঞতায় তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকেই। যদি নতুন স্লোগানের পাশাপাশি নতুন মুখ নিয়েও তাঁরা মানুষের কাছে যেতেন, তা হলে বোধহয় বিষয়টা আরও বিশ্বাসযোগ্য হত।”
অর্থাৎ, নতুন স্লোগান সেই বিমানবাবুর মুখেই থেকে গেলে তার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ে বিপণন বিশেষজ্ঞ! |