পার্ক স্ট্রিটের নিশিনিলয় সফরকারী এক তরুণীর সহিত কলিকাতায় যে অপকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে, তাহা চরম ধিক্কারযোগ্য। অভিযোগকারিণীর সহিত পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ যে আচরণ করিয়াছে, তাহাও নিন্দনীয়। কিন্তু সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক এবং উদ্বেগজনক হইল তদন্তের কাজ শুরু হওয়ার আগেই স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর আগ বাড়াইয়া ঘটনাটিকে ‘সাজানো’ আখ্যা দেওয়া এবং তাঁহার সরকারের ‘সুনাম’ কলঙ্কিত করার চক্রান্ত রূপে শনাক্ত করা। অথচ প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর হইতে এ ধরনের স্বতঃপ্রণোদিত, চটজলদি প্রতিক্রিয়ার কোনও প্ররোচনা ছিল না। তাঁহার সরকার বা দলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই কেহ করে নাই, ধর্ষিতা মহিলা তো ননই। পুলিশের তৎপরতার অভাব সম্পর্কে যেটুকু সমালোচনা হইয়াছিল, তাহাকে মৃদু বলিলেও অত্যুক্তি হয়। শত প্ররোচনা থাকিলেও, তদন্তের কাজ সম্পন্ন না হওয়া অবধি মুখ্যমন্ত্রীর বাক্সংযম অবলম্বন করা বিধেয়। অথচ তিনি বিনা প্ররোচনাতেই এমন সমস্ত উক্তি করিলেন, যাহা অকল্পনীয়। সমান আপত্তিকর পুলিশ কমিশনারের সাংবাদিক বৈঠক, যেখানে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর রাজনৈতিক বয়ানেরই প্রতিধ্বনি করেন, যাহা পুলিশ প্রশাসনের কর্তা হিসাবে তাঁহার করার কথা নয়। উপরন্তু রাজ্য সরকারের এক মন্ত্রী ধর্ষিতার চরিত্র এবং ‘অত রাত্রে দুই সন্তানের মা কেন নিশিনিলয়ে ছিলেন’ সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলিয়া যে মানসিকতার পরিচয় দেন, তাহা দ্বিগুণ দুর্ভাগ্যজনক।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ ভাবে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের ভূমিকা। তিনি ও তাঁহার অফিসাররা যে ভাবে এই তুমুল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিকূলতার আবহেও ধর্ষিতা মহিলার বয়ানকে ‘সরকারবিরোধী চক্রান্ত’ বলিয়া উড়াইয়া না-দিয়া গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করিয়াছেন, অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সহিত তদন্ত করিয়া দোষীদের শনাক্ত করিয়া, গ্রেফতার করিয়া আদালতে হাজির করাইয়াছেন, কোনও প্রশংসাই তাহার জন্য যথেষ্ট নয়। দময়ন্তী সেনের মতো অফিসাররাই এখনও পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে একমাত্র ভরসা ও আশার স্থল। তাঁহাদের সংবেদনশীলতা, কর্তব্যনিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অগ্রাধিকার, পক্ষপাত বা সংস্কার দ্বারা আচ্ছন্ন না-হইয়া সত্য উদ্ঘাটনের আপসহীন প্রয়াস রাজ্যকে এখনও কিছুটা বাসযোগ্য রাখিয়াছে। তিনি দেখাইয়া দিয়াছেন, প্রশাসকের আচরণ কেমন হওয়া উচিত। তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা কাহাকে বলে। সরকারি বিধি অনুযায়ী কঠোর ভাবে তিনি আপন নির্দিষ্ট কাজটি করিয়া গিয়াছেন। এ জন্য উপরমহলের বিরাগভাজন হইবেন কি না, তাহা ভাবেন নাই।
এক অর্থে, ইহাই এক জন প্রশাসনিক অফিসারের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত আচরণ, যে জন্য আলাদা করিয়া কোনও প্রশংসা তাঁহার প্রাপ্য হয় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘ কাল ধরিয়া রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে রাজ্যের প্রশাসন এমনই পক্ষপাতদুষ্ট, অকর্মণ্য, অসংবেদী হইয়া উঠিয়াছে যে এক জন তন্নিষ্ঠ অফিসারকে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বলিয়া মনে হয়। এই হস্তক্ষেপ এবং তাহার ফলস্বরূপ প্রশাসনিক দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার অধোগমন বিগত কয়েক দশকের পরিকল্পিত অনুশীলনের ধারাবাহিকতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরিবর্তন’-এর সরকারও এই অধঃপতনের জন্য পূর্বসূরিদের বিরুদ্ধে নিত্য তোপ দাগিয়া থাকে। কিন্তু গত আট-নয় মাসে রাজ্যের ‘সব সমস্যার সমাধান’ করিয়া ফেলিলেও এই সমস্যাটির সমাধানে তিনি যথেষ্ট তৎপর হইয়াছেন কি? যদি হইতেন, তবে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার যথাযথ তদন্তটি এমন বিরল ব্যতিক্রম হিসাবে চিহ্নিত হইত না, বরং স্বাভাবিক প্রশাসনিক কাজ হিসাবেই সম্পন্ন হইত। এবং সংবাদমাধ্যমের প্রবল চাপের প্রতিক্রিয়ায় নয়, লাঞ্ছিতা মেয়েটি পুলিশের কাছে অভিযোগ পেশ করিবার সঙ্গে সঙ্গে। এই ঘটনা কি প্রশাসনের সম্বিৎ ফিরাইবে? ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম হইতে প্রশাসনিক রীতি শিক্ষা লইবে? ভরসা কম। ব্যক্তিগত ব্যতিক্রমই বোধকরি একমাত্র ভরসা। |