কেন্দ্র তথা কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে নানা বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে সাম্প্রতিক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে এ বার আসরে নামছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। আগামী পরশু বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতার বৈঠক হতে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রেসিডেন্ট কমিশনার ভাস্কর খুলবে জানিয়েছেন, “মুখ্যমন্ত্রী আগামিকাল রাতে দিল্লি আসবেন এবং পরশু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন।” সেই রাতেই মমতা কলকাতায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র এনসিটিসি গঠন নিয়ে বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মমতা। সমালোচনা করেছেন জিটিএ-বিল নিয়ে কেন্দ্রের ভূমিকারও। তাঁর যুক্তি, কেন্দ্রের ঢিলেমির জন্যই এই চুক্তি রূপায়ণে দেরি হচ্ছে। একই ভাবে ফরাক্কার জলের ক্ষেত্রে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ কী ভাবে বঞ্চিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ অনেক বেশি জল পেয়েছে, তা-ও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন তিনি। তিস্তা-চুক্তি এবং ছিটমহল হস্তান্তরের বিষয় নিয়েও মমতার সঙ্গে কেন্দ্রের বিরোধ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই কলকাতায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনিও মমতাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে অনুরোধ করেছেন। এই বিষয়গুলি ছাড়া আর একটি বিষয় নিয়েও কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠেছে। তা হল অর্থনীতি। বারবার মমতা জানাচ্ছেন, প্রকল্পভিত্তিক অর্থ সাহায্যের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের বেতন, কেন্দ্রীয় ঋণের সুদ ও ভর্তুকি দিতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দেনা হয়েছে রাজ্যের, সে বিষয়েও তিনি কেন্দ্রের সাহায্য চান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, দীর্ঘদিনের জমে থাকা আর্থিক দেনার যে সুদ মেটাতে হয়, তা তিন বছরের জন্য স্থগিত রাখা হোক। তা হলেই বেহাল আর্থিক পরিস্থিতি অনেকটা সামলে ওঠা যাবে। |
কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের বাজেটের আগে শরিক দলের সঙ্গে জমে ওঠা এত বিরোধ নিয়ে অস্বস্তিতে কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাই বিতর্কগুলির অবসান ঘটাতে মমতার সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহেই কিন্তু এই বৈঠকটি হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পুলক চট্টোপাধ্যায়ও বেশ কিছু দিন ধরে চাইছিলেন, বৈঠকটি হোক। পুলকবাবুও এই বৈঠকটি হওয়ার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে ভোটগণনা ৬ মার্চ। ভোটের ফল যা-ই হোক, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব কিন্তু কখনওই চাইছেন না যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইউপিএ থেকে বেরিয়ে যান। বরং কংগ্রেসের রণকৌশল হল, যদি ভবিষ্যতে মুলায়ম সিংহ যাদব কংগ্রেসের জোটে সামিলও হলেও মমতাকে কোনও ভাবেই ইউপিএ থেকে বিদায় জানানো হবে না। মমতার ১৯ জন সাংসদের সমর্থনের মূল্য এখনও কংগ্রেসের কাছে অনেকটাই। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির নির্বাচনও জুলাই মাসে। সেই নির্বাচনেও কংগ্রেসের প্রার্থী যে-ই হোন না কে, তৃণমূলের সমর্থন বিশেষ ভাবে জরুরি। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় তৃণমূলের বিধায়কের সংখ্যা অনেক। যা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে দাঁড়াবে এ বার। তা ছাড়া মমতা যে ভাবে নীতীশ কুমার, চন্দ্রবাবু নায়ডু, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়েক প্রমুখ আঞ্চলিক নেতাদের সংগঠিত করেছেন এবং সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাতে কংগ্রেসের পাল্টা রণকৌশল হল, যে ভাবেই হোক মমতাকে ইউপিএ শিবিরে ধরে রাখা। জয়রাম রমেশ গত কাল পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও তাই রাজ্যের জন্য সদয় হওয়ার ইতিবাচক বার্তা দিয়ে এসেছেন।
কংগ্রেসের বড় অংশের আশঙ্কা, শরিক দলের সঙ্গে এই বিরোধ আসন্ন বাজেট অধিবেশনেও ছায়া ফেলতে পারে। তা হলে গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পাশ করানো ফের কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এর আগে লোকপাল বিল ও খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে ইউপিএ-সরকার যে হাত পুড়িয়েছে, তা আর তারা করতে চায় না। তাই প্রধানমন্ত্রী নিজে মমতার সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়গুলির মীমাংসা করতে চাইছেন এবং মমতার বক্তব্য শুনতে চাইছেন। এর আগে গত অক্টোবরে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পৃথক ভাবে বৈঠক করেছিলেন মমতা। বিষয় ছিল, রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য। তার পরে মুখ্যমন্ত্রী কয়েক বার দিল্লিতে এলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়নি। সেই অর্থে বেশ কিছু দিন পরেই মমতা-প্রধানমন্ত্রী বৈঠক হচ্ছে।
ফরাক্কার জল নিয়ে মমতা যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, সেই যুক্তি ঠিক বলেই মানছে কেন্দ্র। জাহাজ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে ‘ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি’ আগেই কেন্দ্রকে জানিয়েছিল। কিন্তু জলসম্পদ মন্ত্রক নড়াচড়াই করেনি। দুই মন্ত্রকের সমন্বয়ের এই অভাবে বাংলাদেশ যে বেশি জল পেয়েছে শুধু তা নয়, কলকাতা বন্দরও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এখন গোটা বিষয়টা বুঝতে পেরে মমতার সঙ্গে আলোচনা করে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চলেছেন। জলসম্পদ মন্ত্রক ইতিমধ্যেই ফরাক্কায় একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। তারা ফিরে এসে রিপোর্ট দেবে। তিস্তা চুক্তির বিষয়টি নিয়েও মমতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলতে পারেন। কেন্দ্রের যুক্তি হল, তিস্তা-চুক্তি না হলেও বাংলাদেশ কিন্তু তিস্তার জল পাচ্ছে। নদীতে জল থাকলেই বাংলাদেশ জল পাবে। বরং ঠিকমতো চুক্তি রূপায়ণ হলেই কে কত জল পাবে, তা ঠিক হবে। যাতে আখেরে লাভ হতে পারে পশ্চিমবঙ্গেরই। |