ঐক্যের বার্তা দিতে মঞ্চ মহাকরণ
সাফল্য তাঁর একার নয়, ঘোষণা দময়ন্তীর
প্রতিটি সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বাসে-ট্রেনে সর্বত্র তাঁর দক্ষতা নিয়ে আলোচনা। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের ‘দেওয়াল’ জুড়ে প্রশস্তির ছড়াছড়ি। সোমবার সেই গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনকেই ‘থমথমে মুখে’ মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে বেরোতে দেখা গেল।
পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ-কাণ্ডের তদন্তে ‘সাফল্য’ যে তাঁর একার নয়, সামগ্রিক ভাবে কলকাতা পুলিশের ‘দলগত কৃতিত্ব’ তা জানাতেই এ দিন মুখ খোলেন দময়ন্তী। মহাকরণে যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিমের পাশে দাঁড়িয়ে গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “আমি খুব ‘ডিস্টার্বড’। আমি বহু বছর কলকাতা পুলিশে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছি। কখনও কোনও সিদ্ধান্ত একা নিইনি। পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে আমরা কাজ করেছি। আমার অধীনে একটা গোটা দল এই ঘটনার তদন্ত করেছে। আমি আমার দলের বাইরে গিয়ে একা কিছু করিনি। আমার এই অবস্থানের কথাই মুখ্যমন্ত্রীকে এ দিন জানাতে এসেছিলাম।” সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বল্প সময়ের উপস্থিতিতে ‘আমি খুব ডিস্টার্বড’ কথাটা অন্তত চার বার বলেন দময়ন্তী। টিভি-তে বা সামনে দাঁড়িয়ে দময়ন্তীকে যাঁরা দেখেছেন তাঁদের চোখেও তাঁকে ‘ক্লান্ত-বিধ্বস্ত’ মনে হয়েছে।
পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্ত চলাকালীন অভিযোগকারী মহিলাকে কার্যত ‘অবিশ্বাস’ করে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী থেকে পুলিশ কমিশনার। ঘটনার রহস্যভেদে দময়ন্তীর সাফল্যের পরে স্বাভাবিক ভাবেই সেই বিবৃতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার জবাব দেওয়ার কাজটি এ দিন করেন শামিম। তিনি বলেন, “আমি যত দূর জানি, মুখ্যমন্ত্রী কখনও কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। এ ক্ষেত্রেও করেননি।”
তদন্ত নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে লালবাজারের কর্তাদের একাংশের বিরোধ নিয়ে যে জল্পনা উঠে এসেছে, তা খণ্ডন করতে শামিম বলেন, “কলকাতা পুলিশে ‘গ্রুপইজম’-এর কথা উঠেছে। এবং তাতে আমার নামও জড়িয়েছে। কলকাতা পুলিশ একটা পরিবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে। এখানে কেউ একা কোনও সিদ্ধান্ত নেয় না। তাই কাউকে ছোট বা বড় করার প্রশ্নই নেই। পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে দলবদ্ধ হয়ে সকলে কাজ করছে।”
মহাকরণে দময়ন্তী সেন। সঙ্গী জাভেদ শামিম।

আমি খুব ডিস্টার্বড।
শামিম এবং দময়ন্তী দু’জনেই জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ডাকেননি। তাঁদের দাবি, সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার তদন্ত নিয়ে লেখালেখিতে বিব্রত হয়ে তাঁরা নিজেরাই পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ চেয়েছিলেন। যদিও এই দাবি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে পুলিশের একাংশ বলছে, সম্ভবত খুব তাড়াহুড়ো করেই আসতে হয়েছিল দময়ন্তীকে। তা না হলে উর্দির বদলে সাধারণ পোশাকে (সালোয়ার-কামিজ) তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আসার কথা নয়।
এ দিন সকালে শামিম ও দময়ন্তী মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে ঢোকার আগে পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা ও স্পেশাল কমিশনার শিবাজি ঘোষ মমতার ঘরে ঢুকেছিলেন। বেলা ১২টা থেকে মিনিট কুড়ি ওই দুই পুলিশকর্তা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা কথা বলেন। এই বৈঠক চলাকালীনই শামিম-দময়ন্তী মহাকরণে ঢোকেন। কিছু ক্ষণ বাদে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে তাঁদের ডাক পড়ে। ওঁরা দু’জনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়েও পচনন্দা ও শিবাজি উপস্থিত ছিলেন।
ফলে প্রশ্ন থাকছে, সত্যিই শামিম-দময়ন্তী নিজেরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, না লালবাজারের ওই দুই শীর্ষকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে মুখ্যমন্ত্রীই তাদের ডেকে পাঠান? পুলিশের একাংশও বলছে, মুখ্যমন্ত্রীই শামিম-দময়ন্তীকে ডেকেছিলেন। পুলিশের ঐক্যবদ্ধ ছবিটা তুলে ধরার জন্য তাঁরা দু’জনে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গেলে সেখানে পুলিশ কমিশনার বা অন্য কোনও কর্তার উপস্থিত থাকার দরকার পড়ত না বলে তাঁদের দাবি।
তা ছাড়া, পুলিশ-মহলের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, কলকাতা পুলিশ যে সব সময়ে এক হয়ে কাজ করছে সংবাদমাধ্যমকে তা বোঝানোর দায়িত্বই বা হঠাৎ শামিম-দময়ন্তীকে নিতে হল কেন? তা-ও আবার মহাকরণে দাঁড়িয়ে। তাঁরা বলছেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা পুলিশ কমিশনার পচনন্দাই তো সেই কাজটা করতে পারতেন। তা ছাড়া, কোনও ঘটনার পুলিশি তদন্তের সাফল্যের ক্ষেত্রে যাঁর নেতৃত্বে তদন্তটা হচ্ছে
তাঁর মুখে আলো পড়াটাও নতুন কিছু নয়। লালবাজারের এক কর্তাই বলেন, “ক্রিকেটে টিম ইন্ডিয়ার সামগ্রিক সাফল্যে অধিনায়ক হিসেবে সৌরভ-ধোনিদের যেমন নাম উঠে আসে, এ ক্ষেত্রেও গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তীকে নিয়ে তা-ই হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনার ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করার পরেও গোয়েন্দা বিভাগ লেগে থেকে তদন্তে ধর্ষণের প্রমাণ বার করেছে। তাই তদন্তের বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।”
চার পুলিশকর্তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে কী কথা হয়েছে, তা অবশ্য কেউই বলতে চাননি। তবে মুখ্যমন্ত্রী শামিম-দময়ন্তীকে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছেন বলে সরকারি সূত্র জানাচ্ছে। পরে মুখ্যমন্ত্রীকে ওই বৈঠকের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “সব রুটিন মিটিংয়ের কথা আপনাদের বলতে হবে নাকি?”
দময়ন্তী এ দিন ‘পরিবারের মতো এক হয়ে’ কাজ করার কথা বললেও কলকাতা পুলিশের শীর্ষ স্তরে মতান্তর নিয়ে জল্পনা আরও প্রবল হয়েছে। তার মূল কারণ, যে চার পুলিশ কর্তাকে ঘিরে ‘মতান্তর’-এর প্রসঙ্গ এ ক’দিনে উঠে এসেছে, তাঁরা এ দিন এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এবং বৈঠক শেষে সকলেই থমথমে মুখে মুখ্যমন্ত্রীর ঘর থেকে বেরোন।
সোমবার মহাকরণে পচনন্দা।
পুলিশ সূত্রের দাবি, পার্ক স্ট্রিট থানার কাছ থেকে ঘটনার বিষয়ে শুনে স্পেশ্যাল কমিশনার শিবাজিবাবুই প্রথমে মুখ্যমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন, ঘটনাটি ‘সাজানো’। কিন্তু তদন্ত চলাকালীন ওই কথাটাই যে মহাকরণে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে বলে দেবেন, তা কেউ ভাবেননি। পুলিশ সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, এর পর মুখ্যমন্ত্রীর মত প্রতিষ্ঠা করতেই পুলিশ কমিশনার তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন। সে দিনই গোয়েন্দা বিভাগ সবে ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে। তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে বলে গোয়েন্দাপ্রধান ‘আত্মবিশ্বাসী’ থাকলেও পুলিশ কমিশনার তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আদৌ ঘটনাটি ঘটেছে কি না, তা জানতে চান বলে জানাচ্ছে পুলিশ মহলের একাংশ। বলা হচ্ছে, ওই ঘটনায় সিপিএম নেতা হাসিম আবদুল হালিমের ছেলে ফারুখ হালিমের নাম উঠে আসার বিষয়টি কেন রিপোর্ট করা হয়নি, তা-ও জানতে চাওয়া হয়। মহাকরণের একটি সূত্র আবার বলছে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীই হালিমের বিষয়টি দেখতে নির্দেশ দেন।
পুলিশের একটি সূত্রের খবর, ফারুখ প্রসঙ্গে দময়ন্তী পুলিশ কমিশনারকে বোঝান, তদন্তে জানা গিয়েছে ফারুখ মহিলাকে রাতে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ফারুখের সঙ্গে ওই মহিলার যোগাযোগ হয়। তাই এই ঘটনায় ফারুখ একটা অংশমাত্র। তার বেশি কিছু নয়।
লালবাজার সূত্রের দাবি, এর পরে পচনন্দা গোয়েন্দা বিভাগের ‘পারদর্শিতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুললে দময়ন্তী তাঁর প্রতিবাদ করেন। লালবাজারের আর একটি সূত্র বলছে, শিবাজিবাবুও একটা পর্যায়ে তদন্ত নিয়ে গোয়েন্দা বিভাগকে সতর্ক হয়ে এগোতে বলেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘সাজানো ঘটনা’ বলার পরে তদন্তে অন্য কিছু বেরোলে তা রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে ভাল হবে না বলেও মন্তব্য করেন এক পুলিশকর্তা।
কিন্তু দময়ন্তী এই মত মানতে চাননি বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বৈঠক শেষে পচনন্দা এ দিন মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গেও বৈঠক করেন। পরে লালবাজারে ফেরার সময়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি আগের করা মন্তব্য (সরকারকে হেয় করার চেষ্টা হচ্ছে) প্রত্যাহার করে নেবেন? আপনি কি ইস্তফা দেবেন? পচনন্দা জবাব না-দিয়ে কোনও মতে গাড়িতে উঠে চলে যান।
তাঁকে সামনে রেখে সংবাদমাধ্যমে ‘বীরপুজো’-র বিষয়টিতেও এ দিন আপত্তি তুলেছেন দময়ন্তী। তাঁর বক্তব্য, “আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যে ভাবে কথা হচ্ছে, তাতে আমার পেশাদারিত্বকেই খাটো করা হয়, পেশাদার হিসেবে আমার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। এতে আমি খুবই ব্যথিত।” সংবাদমাধ্যমে পুলিশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে লেখালেখির জন্য তদন্তের কাজে ক্ষতি হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।

— নিজস্ব চিত্র
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.