শুরুটা হয়েছিল সিঙ্গুরে। তার পরে নন্দীগ্রাম। আর থামেনি কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন। ওড়িশার কলিঙ্গ থেকে উত্তরপ্রদেশের নয়ডা ক্রমশ ছড়িয়েছে কৃষিজমি নিয়ে সমস্যা। বাংলাদেশের শিলাইদহে এসে দেখলাম, জমি অধিগ্রহণের সমস্যায় আক্রান্ত স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও!
তবে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটা বড় খুশির খবর হল, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি এলাকায় জমি অধিগ্রহণের সমস্যা মেটাতে এগিয়ে এসেছে আদালত। শেখ হাসিনা সরকারকে ওই এলাকায় জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ফলে বেঁচেছেন রবীন্দ্রনাথ। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে ঢাকার সরকারও।
সমস্যা কী নিয়ে? আসলে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি মূল সড়ক থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সার্কিট হাউস থেকে কুঠিবাড়ি আসার রাস্তাটা আক্ষরিক অর্থেই ‘অলিগলি চলি রাম’। আগাগোড়া খানাখন্দে ভরা। বড় গাড়ি বা বাসের পক্ষে ওই অলিগলি দিয়ে কুঠিবাড়ি পৌঁছনো এক কঠিন অভিযান! এই অবস্থায় কুঠিবাড়িকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অঙ্গ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল মূল সড়ক পর্যন্ত প্রায় ছয় একর জমি অধিগ্রহণ। ১৯৯৯ সালে কুঠিবাড়িকে বিশ্ব ঐতিহ্য ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তার পরেই জমি অধিগ্রহণের নোটিস দেয় সরকার।
সেই নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে এক রিট আবেদন দায়ের করা হয়। প্রাথমিক শুনানির পরে হাইকোর্ট জমি অধিগ্রহণের উপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। |
এই সেই কুঠিবাড়ি, যেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। স্বাভাবিক ভাবেই এই মামলার পরিণতি নিয়ে ঢাকার রবীন্দ্র অনুরাগীদের মধ্যে ছিল তুমুল আগ্রহ। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী ও জাহাঙ্গির হোসেনকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চ বুধবার রায় দিয়েছে, সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে পারবে।
শিলাইদহের এই দোতলা বাড়িতে আছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত তিনটি পালকি। আছে তাঁর আসবাবপত্র, নানা ব্যবহৃত সামগ্রী। বাড়ির পিছনে ছিল টেনিস খেলার কোর্ট। বাড়ির চার দিকে বাগান। অযত্ন লালিত। মূল ভবনের কাছেই সে দিনের রান্নাঘর। বাড়ির সামনে সবুজ লন। চার দিকের পাঁচিলটি পদ্মার ঢেউয়ের আদলে তৈরি করা হয়েছিল। সামনের প্রধান ফটক পর্যন্ত লম্বা রাস্তা। এখনও বকুল ফুলের গন্ধে সন্ধ্যায় কুঠিবাড়ি ম ম করে। তবে সে দিন পদ্মা নদী এই কুঠিবাড়ির ঠিক পিছন দিয়ে বয়ে যেত। এখন পদ্মা অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে।
শুধু রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি নয়, শিলাইদহের আর এক আকর্ষণ লালন ফকিরের আখড়া। কুঠিবাড়ির কাছেই এই আখড়া। রয়েছে লালনের মাজার আর হরেক স্মৃতিচিহ্ন। সেই আখড়া দেখতেও এখানে দলে দলে মানুষ আসেন। কুঠিবাড়ির বাইরে যেমন তৈরি হয়েছে পাকাপাকি বাজার, ঠিক তেমনটাই তৈরি হয়েছে লালনের আখড়ার কাছেও। সেই বাজারে সারা ক্ষণ বাজছে লালনের গান। বিক্রি হচ্ছে কুষ্টিয়ার গামছা থেকে মাটির অলঙ্কার।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি আর লালনের আখড়া দেখতে বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই, বিদেশের পর্যটকও আসেন নিয়মিত। পঁচিশ বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ অথবা লালনের স্মৃতিতে কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল-সাধকদের মেলা দেখতে ভিড় কিছু কম হয় না। তাই গোটা এলাকার সৌন্দর্যায়নে এই জমি অধিগ্রহণ সরকারের কাছে ছিল এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।
হাসিনা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, “রবীন্দ্রনাথ এবং লালন দু’জনেই বঙ্গ সংস্কৃতির বিরাট অবলম্বন। বাঙালি জাতিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে এই দুই মরমিয়া সাধক আমাদের সাহায্য করেন সর্বদা। এই এলাকাকে তাই আমরা আরও সমৃদ্ধ ও পর্যটনমুখী করে তুলতে চাই। আদালতের এই নির্দেশ সেই কাজে আমাদের সাহায্য করবে।’’ আর বাংলাদেশের তথ্যসচিব হেদায়াতুল্লা আল মামুনের কথায়, “আমরা বুদ্ধ সার্কিটের মতো করেই এখানে টেগোর সার্কিট গড়তে চাইছি। যাতে পর্যটকদের সুবিধা হয় এমন ব্যবস্থা করতে চাইছি পরিকাঠামোগত এবং সৌন্দর্যায়নের দিক থেকে। রাস্তাটির মান এখন ভাল নয়। ঢাকা সরকারও এই পরিকাঠোমো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে।”
আদালতের রায়ে রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তি’ পেয়েছেন বটে, কিন্তু দেশের অন্যত্র জমি নিয়ে হাসিনা সরকারের উদ্বেগ কমেনি। জমি-সমস্যা এতটাই বেড়েছে যে, এক সময় উদারীকরণের হাওয়ায় অনুমতি পাওয়া বেশ কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ আটকে গিয়েছে। খোদ বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের নামে নতুন বিমানবন্দর তৈরির কাজও আটকে রয়েছে জমি-সমস্যায়। সেই জটও কাটানোর চেষ্টা চলছে। |