‘ভুল’ স্বীকার নিজেরও
ক্ষমতায় ফেরা নয়, ‘মলিনতা’ দূর করার দাওয়াই বিমানের
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পর বিমান বসু। সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে ‘ভুল’ স্বীকারের রাস্তায় হাঁটলেন দলের রাজ্য সম্পাদকও। তাঁদের দলে ‘মলিনতা’র প্রবেশ ঘটেছে বলে সম্মেলনের জবাবি ভাষণে স্বীকার করে নিলেন বিমানবাবু। পাশাপাশিই, ‘ভুল’ কবুল করলেন সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর মন্তব্যের জন্য।
সেই সঙ্গেই দলের প্রতি বিমানবাবুর বার্তা দ্রুত আবার ক্ষমতায় ফেরা নয়, ‘মলিনতা’ দূর করাই আপাতত লক্ষ্য। যে লক্ষ্যে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের আচরণ শোধরাতে বিমানবাবুর নিদান, ‘মিডিয়ার খোরাক হওয়া উচিত নয়’! মঞ্চে বসে তিন দিন ধরে প্রতিনিধিদের সমালোচনা শোনার পরে শনিবার জবাবি ভাষণের শেষ লগ্নে আবেগে কেঁদে ফেলেছেন সত্তরোর্ধ্ব বিমানবাবু। রুদ্ধকণ্ঠে বলেছেন, বহু আক্রমণেও ‘লাল পতাকা কেউ ছাড়বে না’।
শাসক জোটের দুই শরিক কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের জবাবে আলিমুদ্দিনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে হাতের বিচিত্র মুদ্রা সহযোগে শাড়ি-সংক্রান্ত একটি মন্তব্য করেছিলেন বিমানবাবু। তাঁর সেই মন্তব্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রচারিত হতেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। দলের ‘চাপে’ দ্রুত ওই মন্তব্যের জন্য ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে বিবৃতি দেন বিমানবাবু। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর আচরণ নিয়ে সিপিএমের অন্দরে প্রশ্ন অব্যাহত থেকেছে। রাজ্য
রাজ্য সম্মেলনে
বিমান বসু। নিজস্ব চিত্র
সম্মেলনেও ওই বিষয়ে সরব হন প্রতিনিধিরা। সেই সূত্রেই সম্মেলনের শেষ দিনে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের উপস্থিতিতেই জবাবি বক্তৃতায় নিজের মন্তব্যের প্রসঙ্গ নিজেই উত্থাপন করেন বিমানবাবু। প্রতিনিধিদের বলেন, তিনি কোনও ‘সাফাই’ দিচ্ছেন না। ‘ত্রুটি’ হয়েছিল মেনে নিয়েই বলছেন, আর হবে না। সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর ওই মন্তব্য করা ‘ভুল’ হয়েছিল। তবে বিমানবাবু জুড়তে ছাড়েননি, চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়ার সময় তাঁর মন্তব্য একটি ক্যামেরায় ধরা পড়ার পরে তারাই সিডি সরবরাহ করে বাকি সব চ্যানেলকে! বিমানবাবু ভাষণে এমনও বলেছেন যে, ‘ব্যক্তিগত ভাবে’ অপরকে ‘আঘাত’ করা উচিত নয়। নেতৃত্ব সম্পর্কে বা অন্য বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করার সময় সতর্ক থাকা উচিত। সিপিএম সূত্রের মতে, যে সতর্কবাণীর লক্ষ্য আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো কেউ কেউ।
মোট ৬৪ জন প্রতিনিধির বক্তব্যের শেষে শুধু নিজেরই নয়, গোটা দলের হয়ে আত্মসমালোচনাই বিমানবাবুর জবাবি বক্তৃতার নির্যাস। ক্ষমতা হারানোর পর প্রথম রাজ্য সম্মেলনে প্রতিনিধিদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দলীয় শীর্ষ নেতৃত্ব তথা বিগত বামফ্রন্ট সরকারের শীর্ষ মন্ত্রীদের। দলের সেই ক্ষোভের মোকাবিলায় নিজেদের ভুল-ক্রুটি কবুল করে নেওয়ার পথে হেঁটেছেন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। তবে বিগত সরকারের কাজ নিয়ে বুদ্ধবাবু শুক্রবারই একপ্রস্ত ব্যাখ্যা দেওয়ায় বিমানবাবু জোর দিয়েছেন দল ও সংগঠনের কাজে। তবে দু’জনের স্বীকারোক্তির তফাত ‘ভুল’ কবুল করে প্রতিনিধিদের করতালিতে বিপুল অভিনন্দন পেয়েছেন বুদ্ধবাবু। যা বিমানবাবুর ক্ষেত্রে ঘটেনি! প্রতিনিধিদের রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, সমালোচনায় যত ‘ধারাল আক্রমণ’ হয়, ত্রুটি দূর করার জন্য ততই ভাল!
বিগত সরকার ও দলের সম্পর্ক নিয়ে একটি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ স্বীকারোক্তি বিমানবাবুর তরফে পেয়েছেন প্রতিনিধিরা। রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, সরকার দলকে চালাত নাকি দল সরকারকে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। বিমানবাবুর ব্যাখ্যা, রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে সরকার নিয়েই ৭০% আলোচনা হত। তাই দলের সঙ্গে আলোচনা না-করে সরকার কাজ করেছে, এ কথা ঠিক নয়। তবে দল ও সরকারের ‘সমন্বয়ে’র যে অভাব দেখা দিয়েছিল, তা মানতে ‘আপত্তি নেই’। জবাবি বক্তৃতায় বিমানবাবু সব চেয়ে বেশি বলেছেন দলের ভিতরের ‘মলিনতা’ দূর করার প্রসঙ্গে। বলেছেন, সিপিএম ‘চোরে ভর্তি’ নয়। ‘বদ লোকেদের আখড়া’ও নয়। কিছু ‘খারাপ লোক’ আছে। তাঁর বিশ্লেষণে, এটা জুতো আবিষ্কারের মতো হঠাৎ কোনও আবিষ্কার নয়! ঘটছে বলেই তিনি বলছেন। ‘বদ লোক’ তাড়াতে অন্তঃপার্টি সংগ্রাম শুরু করতে বলেছেন রাজ্য সম্পাদক। মেনে নিয়েছেন, বেশ কিছু সর্বক্ষণের কর্মীর জীবনযাপন আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ‘ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে’ এনজিও-র সঙ্গে যোগাযোগ বরদাস্ত করা হবে না। ‘সামাজিক স্বার্থে’ কোনও এনজিও-র সঙ্গে কাজ করতে গেলেও সংশ্লিষ্ট কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হবে। দলীয় কর্মীদের প্রতি তাঁর সরাসরি আহ্বান দলের মধ্যে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তথ্য দিন। প্রয়োজনীয় তথ্য পেলেই তাড়িয়ে দেওয়া হবে!
গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের সমস্যা সিপিএমকে ভোগাচ্ছে বলেও কবুল করেছেন বিমানবাবু। দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছেন, উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় রাজ্য নেতৃত্বের হস্তক্ষেপেই নতুন জেলা সম্পাদক করা হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনায় গৌতম দেবকে সম্পাদক হিসাবে ‘চাপিয়ে’ দেওয়া নিয়ে সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছিল। বিমানবাবুর ব্যাখ্যা, অমিতাভ বসু ২০০৯ থেকেই অব্যাহতি চাইছিলেন। পরিস্থিতি বুঝে ‘সঙ্গত কারণে’ই গৌতমবাবুকে জেলা সম্পাদক করা হয়েছে। হুগলিতে অনিল বসু ও সুনীল সরকার দু’জনেই মনে করছিলেন, তাঁরা জেলা সম্পাদক হতে পারেন! নিষ্পত্তি না-হওয়ায় রাজ্য কমিটির নেতাদের নির্দিষ্ট সুপারিশের ভিত্তিতেই নতুন জেলা সম্পাদক হিসাবে সুদর্শন রায়চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করা হয়।
রাজ্যে হারানো জমি পুনরুদ্ধারের জন্য বিরোধী সিপিএমের সামনে প্রথম সুযোগ আসবে পঞ্চায়েত ভোটে। বিমানবাবু সম্মেলনে জানিয়েছেন, ওই ভোটের প্রস্তুতির লক্ষ্যে কনভেনশন করবেন। বলতে হবে, শাসক জোটের ‘আক্রমণ’ এবং মাথার উপরে ‘আমলাতন্ত্র’ চাপিয়ে দেওয়া, এই জোড়া চাপের মধ্যে পঞ্চায়েতগুলিকে কাজ করতে হচ্ছে। তবে বিমানবাবুর ‘হুঁশিয়ারি’, কত তাড়াতাড়ি আবার ক্ষমতায় ফেরা যায়, তা দলের লক্ষ্য হতে পারে না। গত পঞ্চায়েত ভোটের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে বিমানবাবু বলেছেন, শুধু জেলা পরিষদ জিতেই উদ্বাহু নৃত্য করার ব্যাপার ছিল না! কারণ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে কংগ্রেস ও তৃণমূল বহু আসন পেয়েছিল। তার চেয়েও বড় কথা, তৃণমূল স্তরে দলের জনভিত্তি যে ধাক্কা খাচ্ছে, সেই ‘বার্তা’ স্পষ্ট হয়ে যায়।
আরও একটি পঞ্চায়েত ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে বিমানবাবুর অবশ্য ‘বার্তা’: তাড়াতাড়ি ক্ষমতায় ফেরাই লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য তাড়াতাড়ি ‘মলিনতা’ দূর করা। তার জন্য ‘বদ কাজের সঙ্গে যুক্ত লোকেদের তাড়াতে হবে’। উপর থেকে নিচু তলা পর্যন্ত সর্ব স্তরে এই ‘শুদ্ধকরণে’র কাজে বিরোধী সিপিএম কতটা ‘সফল’ হয়, প্রশ্ন সেটাই!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.