দলের শুদ্ধকরণে নেমে ‘সাহস’ দেখাল সিপিএম। লক্ষ্মণ শেঠ, অনিল বসু, রাজদেও গোয়ালা, অমিতাভ নন্দীর মতো ‘বিতর্কিত এবং অস্বচ্ছ’ ভাবমূর্তির নেতাদের যেমন রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল, তেমনই দলের একাংশের কাছে ‘বীরে’র আখ্যা পাওয়া কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত সুশান্ত ঘোষকেও রাজ্য কমিটিতে নেওয়া হল না।
দলের একাংশের কাছে ‘ডাকাবুকো’ ভাবমূর্তির ওই নেতাদের বাদ দেওয়া নিয়ে রাজ্য কমিটিতে বিস্তর বিতণ্ডা হয়। শেষ পর্যন্ত রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী লক্ষ্মণবাবু এবং অমিতাভবাবুকে বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে। তাতেও ঐকমত্য না-হওয়ায় ভোটাভুটি হয়। তাতে দেখা যায়, দুই নেতাকে বাদ দেওয়ার পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য মত দিয়েছেন। সিপিএমের অন্দরে যে সিদ্ধান্তকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান-বসু-সূর্যকান্ত মিশ্র এই ‘ত্রয়ী’র জয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ওই নেতাদের বাদ দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো মত দিয়েছিলেন গৌতম দেবও। সিপিএমের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, সব সিদ্ধান্ত ‘সর্বসম্মতিক্রমে’ই নেওয়া হয়েছে। |
লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গেই পূর্ব মেদিনীপুরের অপর নেতা নির্মল জানাকেও রাজ্য কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় কোঙারও। বিভিন্ন সময়ে তাঁর মন্তব্য নিয়ে সিপিএম ‘বিড়ম্বনায়’ পড়েছে। বিনয়বাবুকে অবশ্য ‘সম্মাননীয় সদস্য’ হিসেবে রাজ্য কমিটিতে রাখা হয়েছে। বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমকেও রাজ্য কমিটির ‘সম্মাননীয় সদস্য’ করা হয়েছে। রাজ্য কমিটিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে প্রায় ১৫ বছর আগে বাদ-পড়া উত্তর ২৪ পরগনার নেপালদেব ভট্টাচার্যকে।
রাজ্য কমিটি গঠনে মানুষের কাছে শুদ্ধকরণের বার্তা দেওয়া জরুরি ছিল আলিমুদ্দিনের। নতুন রাজ্য কমিটি গঠনে তা দিতে পারা গিয়েছে বলেই দলের অধিকাংশ নেতা মনে করছেন। বিশেষত, যে নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সকলেই বুদ্ধবাবুর ‘অপছন্দে’র তালিকায় ছিলেন। ঠিক যেমন ছিলেন সুশান্তবাবুও। যে কারণে দলের একাংশের কাছে ‘বীরের মর্যাদা’ পেলেও পশ্চিম মেদিনীপুরের ওই নেতাকে রাজ্য কমিটি থেকে দূরেই রাখা হয়েছে। সুশান্তবাবুকে রাজ্য কমিটিতে নেওয়ার ব্যাপারে শুধু পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাই নয়, সম্মেলনের প্রতিনিধিদের একাংশও দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বুদ্ধবাবুদের পাল্টা যুক্তি ছিল, সুশান্তবাবু এখন জামিনে মুক্ত। অভিযোগ থেকে মুক্ত নন। অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলে তখন বিষয়টি দেখা যাবে।
নতুন রাজ্য কমিটির তালিকা বলছে, ১২ জন নতুন মুখ এসেছেন। পুরনো কমিটি থেকে মোট ২২ জন বাদ পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন ‘অস্বচ্ছ’ ভাবমূর্তির নেতারা, তেমনই রয়েছেন বয়সের কারণে ‘অসুস্থ ও অশক্ত’ নেতাদেরও একাংশ। ওই ধরনের সব নেতাকে অবশ্য বাদ দিতে পারেনি আলিমুদ্দিন। গত বারের চেয়ে রাজ্য কমিটির সদস্য সংখ্যা কমেছে তিন জন। মোট ৮৩ জনের রাজ্য কমিটিতে এখনও পর্যন্ত ৭৬টি স্থান পূরণ করা হয়েছে। খালি আছে সাতটি জায়গা। তার মধ্যে একটি পূর্ব মেদিনীপুরের। |
লক্ষ্মণবাবু এবং অমিতাভবাবুকে বাদ দেওয়া কিন্তু খুব সহজে হয়নি। দলের শীর্ষনেতৃত্বের একাংশ অমিতাভবাবুকে বাদ দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিধানসভা ভোটে হারের পর ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ উঠলেই অমিতাভবাবু সর্বত্র সিপিএম কর্মীদের গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁকে বাদ দিলে কর্মীদের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে। আবার লক্ষ্মণবাবুকে বাদ দিলে হলদিয়ায় দলের শ্রমিক সংগঠন ‘দুর্বল’ হওয়ার আশঙ্কা। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী, দীপক দাশগুপ্ত, অমিতাভ বসু-সহ একাধিক প্রভাবশালী সদস্য লক্ষ্মণ-অমিতাভকে বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করেন। কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুর যুক্তি ছিল, যে ভাবে নিচুতলা থেকে বার বার রাজ্য নেতৃত্বের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে, তাতে ওই দুই নেতার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিলেই বরং মানুষের কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে। ওই অভিমত সমর্থন করেন সূর্যবাবু, গৌতমবাবু, নিরুপম সেম, মহম্মদ সেলিমরা। একই ভাবে অনিল বসুকেও বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যিনি রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রকাশ্যেই ‘কুরুচিকর’ উক্তি করেছিলেন।
সম্মেলনে প্রতিনিধিদের সামনে রাজ্য কমিটির তালিকা পেশ করার পরেও আপত্তি ওঠে। আপত্তি তোলেন পূর্ব মেদিনীপুর এবং উত্তর ২৪ পরগনার নেতাদের একাংশ। তাঁদের মতে, লক্ষ্মণ-অমিতাভকে বাদ দিলে দলের নিচুতলার কর্মীদের একাংশের মনোবলে চিড় ধরবে। যখন শাসক দলের ‘সন্ত্রাসে’ বহু মানুষ ঘরছাড়া, তখন এই সিদ্ধান্তে হিতে-বিপরীত হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুদ্ধবাবুদের কাছে ‘নতিস্বীকার’ করতে হয় অন্যদের। কৃষকসভার নেতা ‘পলাতক’ তরুণ রায়কে অবশ্য রাজ্য কমিটিতে রাখা হয়েছে।
বয়সের জন্য রাজ্য কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন মালদহের জীবন মৈত্র, হুগলির বিনোদ দাস, পুরুলিয়ার নকুল মাহাতো, কোচবিহারের চণ্ডী পাল। এঁরা প্রত্যেকেই প্রাক্তন জেলা সম্পাদক। নতুন যাঁরা রাজ্য কমিটিতে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে যেমন হুগলি জেলার সম্পাদক রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন ছাত্রনেতা সায়নদীপ মিত্র এবং কলকাতা জেলা থেকে প্রাক্তন মন্ত্রী অনাদি সাহু। বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমানকেও রাজ্য কমিটির সদস্য করা হয়েছে। হুগলির অনিলবাবু এ বার সম্মেলনেই না-আসায় তাঁকে বাদ দেওয়া খুব কঠিন ছিল না। সুদর্শনবাবু জেলা সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই অনিলবাবু দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে ‘দূরত্ব’ বজায় রাখছিলেন।
দলের প্রবীণ নেতা জলপাইগুড়ির মানিক সান্যলের বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে কেলেঙ্কারির অভিযোগ ছিল। তাঁকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। পরে ওই জেলা থেকে প্রতিনিধি নেওয়ার জন্য দু’টি পদ শূন্য রাখা হয়েছে। |