শিবসেনারা এখন প্রেমদিবসের জয়গান গাইছে। না গাইলে এক ঝাঁক
যৌবন উল্টো দিকে ভোট দেবে। স্বার্থ বড় বালাই। লিখছেন
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় |
ভিলেনের কাছে মা গচ্ছিত এ চালের চেয়ে বড় কোনও চাল আজ অবধি কোনও শকুনি মামা দিতে পারেনি। অর্থাৎ কিনা প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গাটি খুঁজে বের করো এবং সেইখানে কষে চাপ দাও। কত রথী-মহারথী-অমিতাভ বচ্চন কাবু হল এ চালে! সত্য, ত্রেতা, কলি, গুগ্ল, সব্বাই জানে। শিবসেনাও জেনেছে সম্প্রতি।
হ্যাঁ, মরাঠা প্রতিপত্তি-সমৃদ্ধ শিবসেনা, এবং মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাও, গত বছর অবধি ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’কে একটি অশ্লীল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বলে গালমন্দ করেছিল। যুবসম্প্রদায়ের আত্মার শুদ্ধিকরণের দায় সম্পূর্ণ নিজেদের কাঁধে নিয়ে প্রেমিকপ্রেমিকাদের হেনস্থা করে, পিটিয়ে, পুলিশে দিয়ে, জোর করে সর্বসমক্ষে প্রেমকে বরণ করে নেওয়ার অপরাধ থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিল।
এ হেন শিবসেনা অ্যান্ড কম্পানি এ বার হৃদয় ছলোছলো করে বলল, তারা মোটেও ভ্যালেন্টাইনস ডে’র বিপক্ষে নয়। তরুণতরুণীরা নিজেদের মতো করে প্রেমদিবস উদ্যাপন করবে, এতে ক্ষতি কী? এখানেই থেমে থাকেনি ‘অশ্লীল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি’র প্রতি সমর্থন। নবনির্মাণ সেনার বিধায়ক বাল নন্দগাঁওকর উবাচ, ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা ভ্যালেন্টাইনস ডে উদ্যাপনের বিপক্ষে তো একেবারেই নয়। তরুণতরুণীদের মধ্যে তো এই দিনটা খুবই পপুলার। আমাদের পার্টির অধ্যক্ষ রাজ ঠাকরে যুবসম্প্রদায়ের ‘সেন্টিমেন্ট’ খুব ভালই বোঝেন।’!!!
রোসো রোসো! এ তো ওয়ান-ওয়েতে ইউ টার্ন!
বড়দের চোখ কপালে, সমাজবিজ্ঞানীরা তত্ত্ব খুঁজতে ব্যস্ত, আর যুবসম্প্রদায় জবরদস্ত হতভম্ব, কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না কার্ড কিনতে যাব কি যাব না, ভালুক কিংবা ফুল কেনার সময় আশেপাশে কোনও চোরাগোপ্তা সুপারি কিলার আছে না নেই ভাবতে গিয়ে ভেবলে যাচ্ছে বেচারারা। অবিশ্যি নিন্দুকরা অঙ্ক কষছে আসলি কানমলাটা আসছে কখন? এমনি এমনি তো প্রেম বিলোয় না সমাজ-গার্জেনের দল! |
এমনটা ভাবার কোনও কারণই নেই যে হঠাৎ এক দিন বিমল প্রভাতে শিবসেনা ও মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা মানুষের অধিকার বিষয়ে সচেতন হয়ে ও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সব্বার স্বাধিকার ও স্বতন্ত্র মনোভাব মেনে নিচ্ছে। আসল টিকি বাঁধা ছিল বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন-এর নির্বাচনের ফলাফলে। যে ফলাফল অনেকটাই নির্ধারণ করবে এই কচিকাঁচার দল, যারা কিনা ভ্যালেন্টাইনস ডে হইহই করে উদ্যাপন করতে চায়। কারণ, ভোটদাতাদের লাখ লাখ ওই যুবসম্প্রদায়। এ সময় ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে চটালে চলে! চোখের সামনে দিয়ে মা’কে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, ভেউ ভেউ করে কাঁদা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। চাও বা না চাও, মানতেই হবে এক একটি পেছন-পক্ব, কলেজগামী ঝিনচ্যাকের হাতেই রয়েছে বিভিন্ন পার্টির আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম। অতএব সমাজ-গার্জেনদের কাছেও এখন প্রেম ভারী পবিত্র এবং জরুরি অঙ্গ উহা ফুটে উঠুক পার্কে পার্কে, চকলেটে, ফুলে। ঝপাঝপ জ্বলে উঠুক নিয়ন-আমন্ত্রণ, মদন ও কিউপিড ডাবল ডিউটি দিক চরাচরে।
আসলে যা কানে পাক মেরে শিবসেনা ও মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাকে এমন ডিগবাজি খাওয়াতে বাধ্য করছে তা হল স্বার্থ। ঘা লাগলেই কোঁক করে ওঠে। নীতি, গার্জেনগিরি, পবিত্র ভাবনার উবে যেতে দু’সেকেন্ড সময় লাগে না। যা কাল অবধি ছিল কালো, আজ তা হয় অফ-হোয়াইট, যা কাল অবধি ছিল নিষিদ্ধ, তা আজ হঠাৎ হয়ে ওঠে ধর্মবাণী। আমরা জ্ঞান হওয়া ইস্তক স্বার্থের ট্রাপিজে বহু খেলা হতে দেখেছি, দেখে আসছি। সংসারে, সম্পর্কে, অফিসে, যৌনতায়, প্রেমে, প্রত্যাখ্যানে, হিংসায়। স্বার্থই হল আসল মানদণ্ড, ছোঁয়ালে বোঝা যায় চিড়বিড় কতখানি।
শিবসেনা আর মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাকেও ছুঁয়ে দিয়েছে স্বার্থ। গত বছর অবধি তারা সভ্যতা-সংস্কৃতির ভার কাঁধে নিয়ে দেদার শাসন চালিয়েছিল। তাদের মেজদাদা, ছোড়দাদা, ঠাকুরদাদারা যে ভাবে কব্জির জোরে ক্ষমতাকে গৃহপালিত, উপকারী ইয়ে হিসেবে পোষে, ঠিক তেমনটাই পুষে আসছিল। কিন্তু দড়াম করে ভোট খসে পড়ল আঁচলে, আর অমনি স্বার্থ এসে আটকে দাঁড়াল ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতির তড়পানি। যে স্বার্থ কেবল আমার কাজে লাগবে ভেবেছিলাম, সে কিনা দাগা দিয়ে, ডাবল ক্রস করে গণতন্ত্রকে বড়দাদা বলে মানতে বাধ্য করল। শিবসেনাদের সেই সেই ভাবধারাকে স্বীকৃতি দিতে হল যা তাদের ঐতিহ্যে, কৃষ্টিতে, হিস্ট্রিতে ম্লেচ্ছ।
চকিতে ব্যাকফুটে চলে গেল ক্ষমতা। আর গণতন্ত্র ধীরে মুচকি হেসে দখল নিল ক্ষমতার ছেড়ে দেওয়া জমি। এমন অবস্থায় ক্ষমতাকে যদি ফের চোগাচাপকান লাগিয়ে রেরে করে এগিয়ে আসতে হয়, তা হলে গণতন্ত্রের পায়ে তেল দিতেই হবে। যে গণতন্ত্র দেয় ভোটাধিকার। যে ভোট না হলে ক্ষমতা দখল করা মুশকিল।
ভারতীয় গণতন্ত্র ভারী চালাকচতুর লোক। সে সারা জীবন এ ভাবেই চলেছে। এমন অনেক ক্ষুদ্রতর বা বৃহত্তর স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে নিজেকে বদলেছে, সমাজকে বদলেছে, রাজনীতিকে বদলেছে। শিবসেনা পরের বছর আর যা-ই হোক এই ভাবে তরুণপ্রজন্মের ওপর ফের ডান্ডা তুলতে পারবে না। যদি বা বেচাল করেও তা হলে এই তেজ বা ফোঁস থাকবে না। খুব সম্ভবত তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় ভ্যালেন্টাইনস ডে মারফত তরুণ প্রজন্মকে ভয় দেখানোর পয়েন্টটা তত জোরদার থাকবে না আর। তার চেয়ে অনেক জোরদার হবে তাদের পরবর্তী নির্বাচনে জেতার জন্য ‘ভোটব্যাঙ্কের সমীকরণ’। গণতন্ত্রে থেকে তাকে তুচ্ছ করার ক্ষমতা কোনও বাপের ব্যাটার নেই।
আমাদের দেশে গণতন্ত্রের খুঁটি যাঁদের হাতে, তাঁরা অধিকাংশ সময় নিজের স্বার্থে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেন। মাঝে মাঝে গণতন্ত্র আর স্বার্থের পারস্পরিক নানান ছোট ছোট বাঁক, ছোট ছোট মোচড়ও আমরা দেখতে পাই। নীতি, সততা, আদর্শ, সব গড়াগড়ি খায়। হক কথা। কিন্তু স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে যদি বাধ্য হয়ে নিজেদের অন্যায়কে ন্যায়ের জামা পরিয়ে দিতে হয়, সেটা তো অসুররা জিতব জিতব করছে, এমন সময় মহাদেবের ত্রিনয়ন উন্মীলনের মতো। ন্যায় বলে শিবসেনার মত যাহাই হউক না কেন, ভ্যালেন্টাইনস ডে তরুণ প্রজন্মের পক্ষে ভাল না খারাপ, সেটা তাদেরই বুঝে নিতে দেওয়া ভাল। তারা বরং তাদের মতো করে জীবনটা যাপন করুক। তারা আই আই টি যাবে না উচ্ছন্নে, জাহান্নমে যাবে না ভক্তিগীতি গাইবে, সে না হয় তারাই বুঝে নিক। ব্যক্তিমর্যাদা ফের স্থাপিত হোক। নির্বাচন যদি তা করাতে পারে, তবে চিন্তাধারার বদলটা এগিয়ে যেতে পারে। মহারাষ্ট্রের এই ঘটনা আমাদের এইইইইটুকু হলেও গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতিকে ঠিক এই জন্যই কুর্নিশ। বহু কিছুই হবে না, কিন্তু দায়ে ফেলে গণতন্ত্রের হয়ে কিছু কিছু জিনিস সে করিয়ে নেবেই। |