ভাষার গতি যে নদীর ন্যায়, তাহা যে বাঁকে বাঁকে রূপ বদলাইতে পারে, এক নদীতে বহু নদী মিলিয়া যাইতে পারে তাহা সুবিদিত। বস্তুত, ভাষা নিত্যপ্রবাহিনী না হইলে তাহার মৃত্যু কার্যত নিশ্চিত। কিন্তু, এক নদীতে অন্য নদীর মিলিয়া যাওয়ার সহিত যেমন নদীতে কারখানার বর্জ্য আসিয়া পড়ার ফারাক আছে, তেমনই ভাষাতেও যাহাই আসিয়া পড়ে, তাহার সবটাই স্বাগত নহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিলেন। টেলিভিশন-রেডিয়োয় যে ইংরাজি ও হিন্দি শব্দবহুল বাংলা বলাই বর্তমানে দস্তুর, তিনি তাহাকেই ভাষাদূষণ বলিয়াছেন। সেই প্রবন্ধের প্রেক্ষিতে ঢাকা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া রায় দিয়াছে, ‘বেতার বা দূরদর্শনে বাংলা ভাষাকে ব্যঙ্গ করা বা বিকৃত উচ্চারণে প্রচার করা’ চলিবে না।
রায়টি স্বভাবতই কিছু প্রশ্নের জন্ম দিবে। বাংলা ভাষা তাহার বিবর্তনের পথে বহু দেশি-বিদেশি ভাষার শব্দকে আত্মস্থ করিয়াছে। ফার্সি হইতে পর্তুগিজ, হিন্দি হইতে ওলন্দাজ সব ভাষার শব্দই ক্রমে বাংলার নিজস্ব হইয়া গিয়াছে। ভাষার চলনও ইংরাজির দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছে। সেই বিবর্তন যদি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করিয়া থাকে, তবে বর্তমান যুগের সংযোজনে আপত্তির হেতু কি? দুই সংযোজনের চারিত্রিক পার্থক্যই আপত্তির হেতু। |
প্রথমত, ভাষার বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যে শব্দগুলি সংযোজিত হইয়াছিল, তাহা বিবর্তনের নিয়ম মানিয়া, অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে বাংলায় আসিয়াছে। এবং দ্বিতীয়ত, সেই শব্দগুলিকে, প্রয়োগভঙ্গিকে বাহির হইতে চাপাইয়া দেওয়া হয় নাই ভাষা নিজের প্রয়োজনেই তাহাকে আপন করিয়া লহিয়াছিল। কোনও শব্দের অভাব, কোনও ভাবপ্রকাশের মাধ্যমের অভাব সেই বিবর্তনের পথ খুলিয়া দিয়াছিল। বর্তমান সংযোজনগুলির ক্ষেত্রে এই কথা বলা চলে কি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একটি উদাহরণ দিয়াছেন ‘ফ্রেন্ডসরা, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফোর্টিনথ। সো মনে রেখো...’। এই বাংলা বাক্যটিতে, যদি আদৌ ইহা বাংলা পদবাচ্য হয়, যে কয়টি ভিন্ ভাষার শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, একটিরও কি প্রয়োজন ছিল? আরও একটি দূষণ চলিতেছে। ভুল শব্দ ব্যবহারের দূষণ। ‘শ্রমিকরা তাঁহাদের দাবিতে সোচ্চার হওয়ায় ব্যাপক অশান্তি হইল এবং মালিকপক্ষ পদক্ষেপ লওয়ায় শ্রমিক নেতা তাঁহার বক্তব্য রাখিলেন’ এই বাক্যটির মধ্যে চারটি ভুল রহিয়াছে। সোচ্চার শব্দটির অর্থ ‘পাখির সশব্দ মলত্যাগ’; ‘প্রভূত’ বোঝাইতে ‘ব্যাপক’ শব্দটি ব্যবহার করা চলে না; পদক্ষেপ ‘লওয়া’ সম্ভব নহে, তাহা করা যায়; এবং বক্তব্য ‘রাখা’ যায় না, তাহা পেশ করিতে হয়। এই ভুলগুলি, এবং এই রূপ আরও অনেক ভুল বাংলা ভাষায় এমনই গভীরে প্রবিষ্ট হইয়াছে যে সেগুলিকে ভুল বলিয়া চিহ্নিত করাই দুষ্কর হইতেছে। ইহাও দূষণ। মারাত্মক দূষণ। ভাষার নদী এখন বহুবিধ দূষণে আক্রান্ত। অবিলম্বে সংস্কার আরম্ভ না হইলে দুঃখিনী বাংলা ভাষা আরও বিপন্ন হইবে। |