বিজেপিতে নেতা অনেক, ভরসা কিন্তু একটিই নাম |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • লখনউ |
ঘুটঘুটে অন্ধকার সিড়ি। কোনও রকমে হাতড়ে দেড় তলার ঘরটিতে পৌঁছনো।
মিটমিটে টিউব লাইট। একটি চেয়ার। ঘুণ ধরা পুরনো আসবাব। টেবিলফ্যান। একটা ছোট খাট। বোধ হয় জিরোনোর জন্য। আর রাশি রাশি পাণ্ডুলিপি। বইয়ের পাহাড়। অবিন্যস্ত। ধুলোর পলেস্তরা। হলদে। স্যাঁতস্যাঁতে।
চেয়ার আগলে এক অশীতিপর প্রবীণ। আনন্দ মিশ্র। ‘রাষ্ট্রধর্ম’ পত্রিকার সম্পাদক। রোজ এখনও চেয়ারটির ওজন মাপেন। “আজ যে চেয়ার দখল করে বসে আছি, পয়ষট্টি বছর আগে এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। আমি তো তাঁর নখের যোগ্য নই। প্রতি মুহূর্তে ভাবি, অটলজির কাঁধ আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে যদি না-ও পারি, খাটো যেন না হয়। ছ’বছর আগে শেষ দেখা। আমাকে দেখে একগাল
হেসে বললেন, ‘নমস্কার’। আমি বললাম শুধু আশীর্বাদ করুন। তারপর সেই যে তিনি অসুস্থ হলেন...,” গলা ভিজে আসে প্রবীণের।
পরিচয়পত্র সংখ্যা XGF092877। বাবার নাম কৃষ্ণবিহারী বাজপেয়ী। ভোটের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি। বুথ ‘নগর নিগম দফতর’। ত্রিলোকী নাথ রোড। অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভোটার স্লিপটি এখন বিজেপি-র লখনউ দফতরের জিম্মায়। অসুস্থ বাজপেয়ী। এই লখনউয়ের সাংসদ ছিলেন তিনি। লখনউ থেকেই দিল্লির গদি। প্রায় ছ’দশকের নিবিড় আত্মীয়তা। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর কত বার ভোট হল, তিনি আসতে পারেননি। এ বারেও পারবেন না। চোখের সামনে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। তবু আছেন শহর জুড়েই।
বরাদরি চকে নবাবি তহজিবে। আমিনাবাদের বাজারে। বড়া ইমামবাড়া, ভুলভুলাইয়াতে। পুরনো বন্ধুদের আড্ডায়। বিকেলের টহলে। রাজনীতির বিশ্লেষণে। সুস্বাদু খাওয়ার গন্ধে। গোলাপ-চামেলির পাপড়িতে। কবি সম্মেলনে। লখনউ এখনও অটলময়।
বিজেপি-ও তাই এই জাদুকরের ভরসায়। অটলের অভাব জাগানোর চেষ্টায়। লখনউয়ের তহজিব বলে, ‘পহেলে-আপ’, ‘পহেলে-আপ’। আর বিজেপি-র তহজিব, ‘পহেলে-অটলজি’। তাই নিবার্চনী ইস্তাহার হোক বা তারকা প্রচারকের তালিকা। বাজপেয়ীর নাম এখনও শীর্ষে। শুধু লখনউ কেন, গোটা উত্তরপ্রদেশে বিজেপি-র মুখ অটলই। পোস্টারে, ব্যানারে, গানে, কবিতায়, প্রচারে, অটল-কুর্তায়। এক বাক্যে সকলেই মনে করেন, মায়া-রাজ্যের মায়াজালে জাদু দেখাতে পারেন ওই এক জনই। যাঁকে কেউ ধর্ম বা জাতপাতের রাজনীতিতে আড়ষ্ট হতে দেখেননি, কোনও ভূগোলের গণ্ডিতেও বেঁধে রাখেননি। তিনি যথার্থই জাতীয় স্তরের নেতা। লখনউ জয় করেই যিনি দিল্লির পথ এঁকেছেন। বিজেপি তো এখন সেই স্বপ্নই দেখছে। হাতে-কলমে যিনি সে কাজটি করেছেন, তাঁকে ছাড়া আর উপায় কী দলের?
গত লোকসভায় আর ভোটে না লড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ভরতের মতো লখনউয়ের পাদুকা সামলেছেন লালজি টন্ডন। বাজপেয়ীর নামেই। নিজে না লড়লেও বাজপেয়ী সে বার ভোটারদের আবেদন করেছিলেন। লালজির মতে, অটলকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা কারও ছিল না। অনেকেই সে চেষ্টা অবশ্য করেছিলেন। কর্ণ সিংহ থেকে রাজ বব্বর, সঞ্জয় দত্ত। এমনকী, মল্লিকা শেরাওয়াতও! মল্লিকা বাজপেয়ীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছিলেন, লখনউ থেকে জিতে দেখাবেন। পরে আর এ মুখো হননি! প্রবীণ সম্পাদক আনন্দ মিশ্রের কথায়, “গোটা বিজেপি নেতৃত্ব অটলজিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করছেন। তিনি অবসর নেওয়ার পর থেকে যতগুলি ভোট হয়েছে, সবাই বাজপেয়ীর নামেই জিতেছেন। এ বারও যদি বাজপেয়ী একটি বার আবেদন করতে পারতেন, তা হলে ভোটের মোড় ঘুরে যেত।”
শুধু বিজেপি কেন, রাজনৈতিক বিরোধীরাও বাজপেয়ীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ২০০৪ সালে বাজপেয়ীর শেষ বার লড়াইয়ে সমাজবাদী পার্টির হয়ে টক্কর দিয়েছিলেন মধু গুপ্ত। এক লক্ষ ভোট পেয়েও দু’লক্ষের বেশি ভোটে হেরেছিলেন অটলের কাছে। আজও তিনি কবুল করেন, “বাজপেয়ীর মতো ব্যক্তিত্ব হয় না। তিনি যে এক মহান ব্যক্তিত্ব, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। প্রতিপক্ষ হলেও কখনওই ব্যক্তিগত আক্রমণ করেননি আমাকে।”
বিজেপি-তে নেতার অভাব নেই। নেতায় নেতায় লড়াইয়েরও অভাব নেই। কিন্তু বাজপেয়ীর মতো নেতা আর কে হলেন? শত্রু-মিত্র সবার কাছে সমান গ্রহণযোগ্য এই নেতাই তাই সঙ্কটে দলের একমাত্র ভরসা। |