মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে নিয়ে কেন্দ্রবিরোধী একটি মঞ্চ তৈরির যে চেষ্টা চলছে, তাতে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব খুব বেশি আহ্লাদিত হতে পারছেন না। মমতা কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর আঘাত হানায় বিজেপির শীর্ষ নেতারা খুশি ঠিকই, কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যেটা করছেন তাতে বিজেপির লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হতে পারে। আর যা-ই হোক, মমতা যে এনডিএ-তে সামিল হবেন না, তা তাঁরাও বুঝতে পারছেন। আর সে কারণেই মমতার এই জোট গড়ার চেষ্টায় অস্বস্তিতে বিজেপি। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মমতার উদ্যোগে সাড়া দিয়ে নীতীশ কুমার, জয়ললিতা, নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নায়ডু-র মতো নেতারা যদি ওই মঞ্চে আসেন, তা হলে তাঁদের এনডিএ-তে ফেরার সম্ভাবনা কমে যায়। নীতীশ এনডিএ-তে আছেন। জয়ললিতা-চন্দ্রবাবু-নবীনকে এনডিএ-তে ফেরানোর জন্য নেতারা সক্রিয়। মমতার উদ্যোগে সেই চেষ্টা ভেস্তে যেতে পারে।”
আর ভবিষ্যতে মমতার এনডিএ-তে ফেরার সম্ভাবনা?
সম্প্রতি মমতার মায়ের মৃত্যুর পরে বিজেপি নেতা রাজীবপ্রতাপ রুডি ও শাহনওয়াজ হুসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পশ্চিমবঙ্গে যান। পরে রুডির সঙ্গে দেখা করে মমতা তাঁকে একটি ছবি উপহার দেন। সেটি দিল্লিতে কনস্টিটিউশন ক্লাবে সাজিয়ে রেখেছেন রুডি। ওই ঘটনার পর দিল্লির সংবাদমাধ্যমে জল্পনা শুরু হয় তবে কি মমতা ফের এনডিএ-র দিকে ঝুঁকছেন? জবাবে বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “নেড়া বেলতলায় একবারই যায়। আমরা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, অনেক কষ্ট করে মমতা তাঁর সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ককে সুসংহত করেছেন। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটও অনেক বেশি। তিনি এনডিএ-তে গিয়ে এটা ঠেকে শিখেছেন। ওই একই কারণে চন্দ্রবাবুরও এনডিএ-তে ফেরা কঠিন। তবে আমরা মমতাকে এনডিএ-তে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাব।”
মহারাষ্ট্রের পুর-নির্বাচনে কংগ্রেস-এনসিপি জোটের বিপর্যয়ের পরে মমতার নেতৃত্বাধীন এই আঞ্চলিক শিবির আরও উৎসাহিত। এখন উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের ফল কী হবে, তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। অনেকেই মনে করছেন, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস যদি ভাল ফল করে, যদি মুলায়মের সঙ্গে তারা গাঁটছড়া বাঁধে এবং তাতে যদি মমতার প্রাসঙ্গিকতা কমে, তা হলে নবীন-নীতীশদের সঙ্গে সমন্বয় আরও বাড়াবেন মমতা। আবার উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস বিপর্যস্ত হলেও এই আঞ্চলিক নেতারা তেড়েফুঁড়ে উঠবেন। অর্থাৎ ভোটের ফল যা-ই হোক, মমতার নেতৃত্বে অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেস জোট গড়ার চেষ্টা বাড়বে বই কমবে না।
অনেকেই মনে করছেন, মমতা ধীরে ধীরে কংগ্রেসের সঙ্গে সংঘাত বাড়াতে পারেন। এবং তা ধাপে ধাপে করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। প্রথমেই ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রত্যাহার তিনি না-ও করতে পারেন। কিন্তু প্রয়োজনে মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে সমর্থনের কৌশল নিতে পারেন তিনি। অন্য দিকে মুলায়মকে সঙ্গে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কংগ্রেস কিন্তু মমতাকে একতরফা ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে না। আবার মমতাও বিরোধ বাড়ালেও পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভাঙতে চাইছেন না।
নীতীশ যেমন বিজেপির উপর নির্ভরশীল না থেকে একক ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। বিহারে তাঁর দলের শক্তিও বেশি। কিন্তু বিহারে বিজেপির যে ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, তা হারাতে চান না বলে এখনই জোট ভাঙতে চাইছেন না তিনি। তবে ধীরে ধীরে বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে চাইছেন। মমতাও একই ভাবে কংগ্রেসের উপর নির্ভরতা ছেড়ে নিজের দলকে একক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু কংগ্রেসের যে ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে, দু’পক্ষের বিরোধে তা ধ্বংস হলে বড় ভুল হবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
ইউপিএ-র প্রথম পর্বে কমিউনিস্টদের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধে খুশি হয়েছিল বিজেপি। তখন কমিউনিস্টরা বিজেপির সঙ্গে হাত না মেলালেও সামগ্রিক ভাবে দুর্বল হয়েছিল কংগ্রেস। সেই একই অঙ্কে ইউপিএ-র দ্বিতীয় ইনিংসেও কংগ্রেসের সঙ্গে শরিকদের সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে বিজেপি খুশি হয়। কিন্তু অমর সিংহ যখন জয়ললিতা, মুলায়ম সিংহ, চন্দ্রবাবু নায়ডুকে নিয়ে চতুর্থ ফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখন তারা খুশি হয়নি। এ কথা সকলেরই জানা যে, চতুর্থ ফ্রন্ট কখনওই একক ভাবে সরকার গড়তে পারবে না। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস বা বিজেপি কোনও একটি বড় দলের ছাতার তলায় তাদের যেতেই হবে। যদি ওই ফ্রন্ট বিজেপি-বিরোধী হয়, তা হলে তারা কংগ্রেসের দিকেই ঝুঁকবে। আর সেটাই বিজেপির চিন্তা।
মমতা অবশ্য এখনই এত কিছু ভাবছেন না। তৃণমূল সূত্র বলছে, আপাতত মমতা বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন রাজ্যের কণ্ঠকে দিল্লি পৌঁছে দিতে চাইছেন। ভোটের রাজনীতির সঙ্গে এখনই এটাকে তিনি যোগ করবেন না, বলছেন তৃণমূলেরই এক শীর্ষ নেতা। তাঁর মন্তব্য, “সেতু আসার আগেই, সেতু অতিক্রম করার কথা কেন ভাবছেন?” আর বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণীর মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি তৃণমূল ও কংগ্রেস জোটের বিরোধিতা করবে, কারণ তারা রাজ্যে বিরোধী দল। কিন্তু মমতার একটি লড়াকু, সৎ ভাবমূর্তি রয়েছে। রাজ্যে ৩৪ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের অবসান কিন্তু মমতার নেতৃত্বেই ঘটেছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব সর্বদা সেই বাস্তবতাকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে স্বীকার করে।” |