কলকাতায় চিদম্বরম, নয়াদিল্লিতে অম্বিকা সোনি। জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র বা এনসিটিসি গঠন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ছয় মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনার ‘জবাব’ দিলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। কিন্তু একই সঙ্গে কংগ্রেস নেতৃত্ব বুঝিয়ে দিলেন, এই নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘বিরোধ’কে বড় করে দেখাতে তাঁরা নারাজ। বরং গত কাল কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকের পর এ ব্যাপারে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও আশঙ্কা থাকলে অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে তা দূর করতে সচেষ্ট হবে কেন্দ্র।
শনিবার মধ্যমগ্রামের বাদুতে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ড’-এর (এনএসজি) আঞ্চলিক কেন্দ্রের উদ্বোধনে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। সেখানে এনসিটিসি নিয়ে সরাসরি কিছু না বললেও তিনি জানিয়ে দেন, “দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ভাগ করা আছে।” এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন মমতা। আমন্ত্রণপত্রে লেখা ছিল, প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন তিনি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যাননি। প্রশাসন সূত্রের খবর, এনসিটিসি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বিরোধের জেরেই ওই অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মমতা। রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে অনুষ্ঠানে পাঠিয়ে দেন তিনি। |
এনএসজি হাবের উদ্বোধনে মধ্যমগ্রামে চিদম্বরম। ছবি: সুমন বল্লভ |
কেন্দ্রীয় সরকার এনসিটিসি গঠনের যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে, তা অনুযায়ী ১ মার্চ থেকে ওই কেন্দ্র চালু হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই মমতার নেতৃত্বে দিল্লির সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েছে বিহার, ওড়িশা, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুর মতো কয়েকটি অ-কংগ্রেসি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। এই নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের যুক্তি, এনসিটিসি গঠন করে কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত করার চেষ্টা করছে। মমতাও এই নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এই প্রসঙ্গে দিল্লিতে আজ কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনি বলেন, “কেন্দ্র কোনও ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করছে না। নতুন কোনও আইনও প্রণয়ন করছে না। অপরাধ দমন সংক্রান্ত বর্তমান আইনের আওতাতেই কেবল প্রশাসনিক নির্দেশের মাধ্যমে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চাইছে।” সেই সঙ্গে সোনি এ-ও জানিয়ে দেন, “সন্ত্রাসের বিষয় নিয়ে রাজনীতিকরণ করা উচিত হচ্ছে না।”
অন্য দিকে, বাদুতে এনসিটিসি নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য না করলেও চিদম্বরম বলেন, “দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ভাগ করা রয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে। সংবিধান অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের। কিন্তু বৈদেশিক আক্রমণ ও জঙ্গি হানার মতো অভ্যন্তরীণ অশান্তির মোকাবিলা করার দায়িত্ব রয়েছে কেন্দ্রের উপর। এ ভাবেই জাতীয় সুরক্ষায় দুই সরকারের ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সংবিধান প্রণেতারা।” চিদম্বরম জানান, জঙ্গি হানা, সন্ত্রাস ও নকশাল-সমস্যা মোকাবিলায় রাজ্যগুলিকে সাহায্য করবে কেন্দ্রই।
এনসিটিসি নিয়ে বিতর্কের মধ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও ভারসাম্য রাখতেই এ দিন বারবার মমতার প্রশংসাও করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, “নতুন সরকারের আমলে জঙ্গলমহলে মাওবাদী-সমস্যা কমেছে। কেন্দ্রের সুরক্ষা বিষয়ক পরামর্শ মেনে উপদ্রুত ওই এলাকায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করছে রাজ্য। রাজ্যের অন্য প্রান্তেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।” অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জটিল বলে উল্লেখ করে চিদম্বরম বলেন, “এ রাজ্যে পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করেছে কেন্দ্র। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করেও ভাল লাগছে।”
একই ভাবে দিল্লিতে এ দিন কংগ্রেসের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারিও বোঝাতে চেয়েছেন, এনসিটিসি নিয়ে মমতা যে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন, তার মধ্যে রাজনীতি খোঁজার কোনও কারণ নেই। তাঁর কথায়, “কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনও বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিলেই, তাতে রাজনীতির রঙ চড়ানোর নিষ্প্রয়োজন। জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র গঠনের ক্ষেত্রে কিছু আপত্তি তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতেও বিস্ময়ের কিছু নেই।”
মণীশের সাফ কথা, “কেন্দ্র-রাজ্য কোনও বিরোধ নেই। রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে মমতার কোনও আশঙ্কা থাকলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে কথা বলে তা দূর করার চেষ্টা করবেন।” একই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, যে সব রাজ্য প্রশ্ন তুলছে, তাদের সবার সঙ্গেই আলোচনা করবে কেন্দ্র। চিদম্বরমের মতোই তাঁরও বক্তব্য, “সন্ত্রাসবাদ দমন দেশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে।”
তবে প্রকাশ্যে না বললেও কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে মমতা যে ভাবে সরব হয়েছেন, তা স্রেফ রাজনৈতিক। তৃণমূলের মনে আশঙ্কা রয়েছে যে উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটে কংগ্রেস ভাল ফল করলে বিভিন্ন বিষয়ে অনমনীয় অবস্থান নেবে। তাই আগেভাগেই কংগ্রেসকে চাপে রাখার জন্য একটি প্রেক্ষাপট তৈরি করে রাখতে চাইছেন তিনি।
স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি বা মুখপাত্র জগৎপ্রকাশ নাড্ডা আজ এনসিটিসি নিয়ে কেন্দ্রের সমালোচনা করেন। তাঁদের দাবি, আন্তঃরাজ্য কমিটির বৈঠক ডাকুক কেন্দ্র। সেই সঙ্গে অভিযোগ, এনসিটিসি-র গঠনের আগে রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেনি কেন্দ্র। কিন্তু কংগ্রেসের এক নেতার বক্তব্য, আসলে বিজেপি ঘোলা জলে মাছ ধরতে চাইছে। তাই কৌশলে শুধু এই অভিযোগই তুলছে যে, এ ব্যাপারে কেন্দ্র রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা করেনি কেন? কিন্তু একবারও রাজ্যের অধিকারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ নিয়ে সরব হচ্ছেন না। কারণ, বাজপেয়ী জমানায় বিজেপি যে পোটা প্রণয়ন করেছিল, তাতেও বলা হয়েছিল যে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এজেন্সি চাইলে রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই কোনও সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার, তল্লাশি ও জেরা করতে পারে।
|