না-আছে বাস ইউনিয়নের দখল। না-আছে আগের মতো পকেটের জোর।
রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আজ, রবিবার প্রথম ব্রিগেডে ‘শক্তিপরীক্ষা’ দিতে গিয়ে তাই সাধারণ ট্রেন-বাস আর পার্টিকর্মীদের পায়ের জোরের উপরেই ভরসা রাখছে ‘বিরোধী’ সিপিএম। প্রতিটি শাখা ও লোকাল কমিটিকে আগাম বলে দেওয়া হয়েছে, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অক্ষম এবং অসুস্থ মহিলা ছাড়া কেউ যেন দলের ‘রিজার্ভ বাসে’ চেপে ব্রিগেডে না আসেন। বাকিদের সাধারণ বাসে-ট্রেনে কলকাতায় পৌঁছে মিছিল করে ব্রিগেডে যেতে হবে।
সিপিএমের হিসেবে, এই মুহূর্তে দলের প্রায় ৯৭% শতাংশ কর্মী দলের ‘বিরোধী’ ভূমিকার সঙ্গে পরিচিত নন। অর্থাৎ, শাসক থাকাকালীন পাওয়া সুযোগ-সুবিধাতেই তাঁরা এখনও অভ্যস্ত। কিন্তু দল এখন বিরোধী ভূমিকায় এবং নেতারা চাইছেন ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ তাঁদের যে সঙ্কটে ফেলেছে, নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখুন। এ বার যেমন ‘অনাড়ম্বর’ ভাবে রাজ্য সম্মেলন হয়েছে, কর্মীরাও তেমনই পায়ে হেঁটে সমাবেশে আসুন। |
যে সমস্ত জায়গায় সিপিএম কর্মীদের উপর হামলা হচ্ছে বা দলের লোকেরা ঘরছাড়া, সেখানকার কর্মীদের বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে ব্রিগেডে আসতে বারণ করেছেন রাজ্য নেতৃত্ব। এলেও অনেক বেশি গোপনীয়তা রক্ষা করে আসতে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। তেমনই রয়েছে বীরভূম, নদিয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং কোচবিহারের একাংশ। দলের এক নেতার কথায়, “ইতিমধ্যেই আমাদের কর্মীদের ব্রিগেডে আসা আটকাতে অনেক জায়গায় হামলা-হুমকি শুরু হয়েছে। তাই দলীয় নেতৃত্ব এ ব্যাপারে কিছুটা সাবধানী।” বস্তুত, এতে সিপিএম দু’রকম ‘লাভ’ দেখছে। এক দিকে তারা যেমন নিচুতলার কর্মীদের কাছে এই বার্তা পাঠাচ্ছে যে, তাঁদের ভালমন্দ নিয়ে শীর্ষ নেতারা চিন্তিত। অন্য দিকে তেমনই ব্রিগেড সমাবেশ তেমন ‘সফল’ না-হলে তারা বলতে পারবে, তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’ এড়াতে তাঁরাই কর্মীদের আসতে বারণ করেছিলেন।
শনিবারই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বিনয় কোঙার বলেছেন, “এই ব্রিগেডের পথ ফুল-বিছোন নয়। রক্তাক্ত।” বিনয়বাবুর আরও অভিযোগ, রানি রাসমণি অ্যভিনিউয়ে এ দিন তাঁদের সারা রাত ব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। যা, সিপিএমের মতে, ‘পক্ষপাতদুষ্ট’।
গত প্রায় দু’দশক বাস-বোঝাই কর্মী নিয়ে সিপিএমকে ব্রিগেড ভরাতে দেখেছেন রাজ্যবাসী। কিন্তু দল সূত্রেরই খবর, চাইলেও এখন আর আগের মতো প্রচুর বাস জোগাড় করতে পারছেন না জোনাল বা লোকাল কমিটির নেতারা। রাজ্য সম্মেলনের হিসেব বলছে, ক্ষমতা হারানোর পর থেকে প্রায় ২৮০ টি ইউনিয়ন হাতছাড়া হয়েছে সিপিএমের। এর মধ্যে অধিকাংশই বেসরকারি বাস-মিনিবাস ইউনিয়ন। রাজ্যের বেশির ভাগ বড় রুটের বাস ইউনিয়নগুলিতেই এখন ‘পরিবর্তনের হাওয়া’। ক্ষমতায় না-থাকায় সরকারি বাস ভাড়া পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তবে ব্রিগেড নিয়ে ‘আড়ম্বর’ যে রাজ্যবাসীর চোখে লাগছে, তা কার্যত গত বছরই বুঝেছিল সিপিএম। ২০১১ সালের ব্রিগেডেও নিচুতলার কর্মীদের যতটা সম্ভব কম বাস ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজ্য নেতৃত্ব। তবুও ‘সুদিন’ থাকায় সেই নির্দেশ অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি।
পাল্টে গিয়েছে কর্মীদের জমায়েতের জায়গাও। আগে ব্রিগেড ভরাতে দূরদূরান্তের সিপিএম কর্মীরা সল্টলেক স্টেডিয়াম বা ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের মতো জায়গায় আগের দিনই এসে জড়ো হতেন। কিন্তু এ বার আর সেই সুযোগ নেই। সিপিএমের এক নেতার কথায়, “বিপদ এড়াতে এ বার কর্মীদের এক জায়গায় জড়ো না হয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে নিজেদের মতো করে ব্রিগেডে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাতে কোনও ভাবে সঙ্কটের সময়ে পাড়ায় সিপিএম কর্মী হিসেবে দাগী হতে না-হয়। যে রীতি চালু ছিল সত্তরের দশকের সিপিএমে। নিজেদের মতো করে কলকাতায় পৌঁছে তাঁরা রাজ্য নেতৃত্বের স্থির করে দেওয়া জায়গা থেকে মিছিল করে ব্রিগেডের দিকে যাবেন।”
পুরনো আরও একটা রীতি এ বার ফিরছে সিপিএমে। তা হল, বাইরে থেকে আগত কমরেডদের জন্য পাড়া থেকে রুটি-সব্জি বা গুড় সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া। ২০১১ সালে ভোটের আগের ব্রিগেডে এই রীতি কিছুটা হলেও ফিরে এসেছিল। এ বারে অতীতের ব্রিগেডের স্মৃতি উস্কে তা ফিরতে চলেছে আরও বেশি মাত্রায়। সিপিএম সূত্রের খবর, রাজ্য সম্মেলনের পরে ব্রিগেডে সভা হবে কি না, তা নিয়ে দলের একাংশে দ্বিধা ছিল। শেষ পর্যন্ত তা কাটিয়ে ব্রিগেড ভরানোর চ্যালেঞ্জই গ্রহণ করেছেন সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব। |