মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সাজানো ঘটনা’-র তত্ত্ব কার্যত নস্যাৎ করে পুলিশ জানিয়ে দিল, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডে ‘ধর্ষণের ঘটনা’ই ঘটেছে। এবং শনিবার সারাদিনের চেষ্টায় তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। মূল অভিযুক্তকে এখনও ধরা না গেলেও সকলেরই আসল পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে পুলিশ।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটে নাইট ক্লাব থেকে বেরোনোর পরে ‘লিফট’ দেওয়ার নাম করে গাড়িতে তুলে এক মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পরে মহাকরণে দাঁড়িয়ে তা ‘সাজানো ঘটনা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। লালবাজারে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দাও বলেছিলেন, “রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য ইচ্ছে করে ভুল খবর রটানো হচ্ছে।” শনিবার সন্ধ্যায় ধর্ষণ-কাণ্ডের কিনারার কথা জানাতে পচনন্দা অবশ্য সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি। তবে গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন স্পষ্ট বলেন, “এটা সাজানো ঘটনা নয়। অভিযোগকারী মহিলা ধর্ষিত হয়েছিলেন। তবে কয়েকটি বিষয় তিনি গুলিয়ে ফেলায় বিভ্রান্তি ছড়ায়।”
কিন্তু কীসের ভিত্তিতে পুলিশ বলছে যে, ধর্ষিত হয়েছিলেন অভিযোগকারিণী?
গোয়েন্দাপ্রধানের জবাব: “ধর্ষণের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই ডাক্তারি পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে না। কিন্তু তদন্তে ধর্ষিতা মহিলার বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ। মহিলার বয়ানের ভিত্তিতেই মামলা রুজু করা হয়েছে। ধৃতরাও গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনাটি মেনে নিচ্ছে।” এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ দিন তিন যুবককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানায়, ধৃতরা হল, সুনীত বজাজ, নিশাত আলম ওরফে তুসি ওরফে রুমান খান এবং নাসির খান। আরও বেশ কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, প্রধানত ঘটনার রাতে নাইট ক্লাবের গেটের মুখে সিসিটিভি-র ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখেই প্রকৃত অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়। সেই সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে অভিযুক্ত সন্দেহে যাদের আটক করা হয়েছিল, সেই শরাফত আলি ও আজহার আলি ‘পুরোপুরি নির্দোষ’ বলে গোয়েন্দাপ্রধান তাঁদের ‘ক্লিন চিট’ দিয়েছেন। |
গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “ধৃতদের মধ্যে কড়েয়া রোডের বাসিন্দা ২৫ বছরের রুমান নাম ভাঁড়িয়ে নিজেকে লাভি গিদওয়ানি বলে পরিচয় দিয়েছিল। ২১ বছরের সুনীতের রুপোলি রঙের ‘হন্ডা সিটি’তেই ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে। সুনীত এবং রুমানও গাড়িতে ধর্ষণের ঘটনাটি স্বীকার করেছে। ওই গাড়িটা বাজেয়াপ্তও করা হয়েছে।” কলকাতা থেকে পালানোর মতলবে হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার পথে ওই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয় বলে পুলিশের দাবি। রাতে মধ্য কলকাতার এক অঞ্চল থেকে নাসিরকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তদন্তের স্বার্থে ধর্ষণকারীর নাম না বলা হলেও রাতে পুলিশ সূত্রেই জানানো হয়, নাসিরের ভাই কাদির ধর্ষণকারী। দময়ন্তীদেবী বলেন, “আসল দুষ্কৃতীরা শরাফত, আজহার, লাভিকে চিনত। ইচ্ছে করে তাদের নাম ভাঁড়িয়েই অপরাধ করে। তারা সম্ভবত জানত না, লাভি এখন কানাডায়। রুমান বিবাহিত। রুমান ও তার সঙ্গীরা বাড়িতে লুকিয়ে অন্যের ভেক ধরে নাইট ক্লাবে মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।”
প্রাথমিক ভাবে যে তিন জনকে পুলিশ অভিযুক্ত বলে সন্দেহ করেছিল, সেই লাভি গিদওয়ানি, শরাফত, আজহারদের পরিবারের কাছে এ দিন ক্ষমা চেয়েছেন অভিযোগকারী মহিলাও। গোয়েন্দাপ্রধানের সাংবাদিক-সম্মেলনের কিছু ক্ষণ বাদে অভিযোগকারিণী আরও বলেন, “ধর্ষণের পরে কে আমার চরিত্র নিয়ে কী বলেছিলেন, সে কথা এখন মনেও রাখতে চাই না। শেষ পর্যন্ত সত্য উদ্ঘাটন হওয়ায় আমি খুশি। পুলিশের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অবশেষে নিজেকে সর্ব অর্থেই জয়ী বলে মনে হচ্ছে।” ঘটনার রাতে যিনি ওই মহিলাকে সাহায্য করেছিলেন, সেই ফারুখ হালিমও বলেছেন, “সত্যটা শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এল, পুলিশকে সে জন্য ধন্যবাদ।”
এই ধর্ষণ-কাণ্ডকে যে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তা নিয়ে অবশ্য একটি কথাও বলতে চাননি অভিযোগকারিণী। কিন্তু রাজ্যের বিরোধী-শিবির থেকে শুরু করে তৃণমূলের জোট-শরিক কংগ্রেস, সব মহলই মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে সরব হয়েছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “যিনি পুলিশমন্ত্রী তিনিই মুখ্যমন্ত্রী। সাধারণত ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হলেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশমাফিক অভিযোগকারীর বক্তব্য অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্য করা উচিত হয়নি।” সেলিমের কথায়, “এক মন্ত্রী খেলাচ্ছলে মহিলার চরিত্র নিয়েও মন্তব্য করেছিলেন। বলা হয়েছিল, মহিলা মনগড়া অভিযোগ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আনা হয়েছিল। যিনি সততার প্রতীক, তাঁর কাছ থেকে এমন মনগড়া কথা আশা করা যায় না। রাজ্যের মহিলাদের কাছেও মুখ্যমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হবে।” তৃণমূলের জোট-শরিক কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “তদন্ত শেষের আগেই মুখ্যমন্ত্রী কী ভাবে বললেন যে, মহিলার অভিযোগ বানানো? তদন্ত শেষ না করে মহিলার উপরে দোষ চাপানো ন্যায়সঙ্গত হয়নি।”
মুখ্যমন্ত্রীর তরফে অবশ্য এ দিন ওই ঘটনা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল নেতার বক্তব্য, “পুলিশি তদন্ত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, পুলিশ দফতরও মুখ্যমন্ত্রীর অধীন। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে যে তদন্ত প্রভাবিত হয়নি, তা স্পষ্ট। তেমন কোনও অভিপ্রায়ও মুখ্যমন্ত্রীর ছিল না।”
অভিযোগকারী মহিলা এখনও আতঙ্কের মধ্যে আছেন বলে এ দিনই প্রকৃত অভিযুক্তদের শনাক্তকরণের জন্য তাঁকে লালবাজারে নিয়ে যায়নি পুলিশ। কিন্তু অভিযুক্তদের ছবি দেখে তিনি চিনতে পেরেছেন। রাতে ধৃত তিন অভিযুক্তর ডাক্তারি পরীক্ষাও হয়েছে।
তবে আসল অভিযুক্তদের চিনতে না-পেরে ভুল লোককে কী ভাবে শনাক্ত করলেন অভিযোগকারিণী?
এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “ভুল করে যাঁদের ধরা হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে আসল অভিযুক্তদের চেহারার খুবই মিল। নাইট ক্লাবে খুব কম আলো ছিল বলে মহিলা ভুল করেন। তা ছাড়া ওই ঘটনার পরে মহিলা প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে ছিলেন।” পুলিশের আরও বক্তব্য, প্রথমটা মহিলা ভাবেন, তাঁর বোনের কলসেন্টারের কর্মী এক যুবকের এই ঘটনার পিছনে কোনও ভূমিকা রয়েছে। আর আসল অভিযুক্তরা নাম ভাঁড়ানোর ফলে শরাফত, আজহার, লাভির নামগুলো তাঁর মাথায় ছিল। তাই ফেসবুকে অভিযোগকারী মহিলার পরিচিত যুবকের বন্ধু-তালিকায় ওই তিনটি নাম দেখেও অভিযোগকারিণী বিভ্রান্ত হন।
তা হলে, কী ভাবে ধরা পড়ল ‘আসল’ দুষ্কৃতীরা?
গোয়েন্দাপ্রধান বলেন, “ঘটনার রাতে নাইট ক্লাবটির গেটের সিসিটিভি-র কিছু ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছিল। প্রযুক্তির সাহায্যে সেই ছবি উন্নত করার চেষ্টা হয়। তাতেই দেখা যায়, অভিযোগকারিণী মহিলা কয়েক জন যুবকের সঙ্গে একটি গাড়িতে উঠছেন। ওই যুবকদের চেহারা ও পোশাক দেখেই তাদের চিহ্নিত করা হয়।” নাইট ক্লাবটিতে নিয়মিত যাতায়াতকারী কয়েক জন ব্যক্তি ও ‘বাউন্সার’দের সঙ্গে কথা বলেও তাদের হদিস মেলে। তদন্তের কয়েকটি খুঁটিনাটি দিক বার করা এখনও বাকি বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দাপ্রধান। তদন্ত শেষ হলেই অভিযুক্তরা কে কার নাম ভাঁড়িয়েছিল বা মহিলাকে কারা ফোনে হুমকি দিয়ে অভিযোগ তুলতে বলেছিল, তা পরিষ্কার হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। |