রবিবাসরীয় গল্প
আলোকপুরী
তটা কাল শাড়ি, গয়না, রূপচর্চা আর দেশভ্রমণ নিয়েই ছিল সুচেতনা। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে সংসারের পঞ্চাশ ভাগ কাজ যেন কমে গেল ওর। জুয়েলারির দোকান, বিউটি পার্লারের জায়গায় ঢুকে পড়ল আশ্রম। সুচেতনা দুম করে দীক্ষা নিয়ে নিল। ওর গুরুদেব বলেছেন জীবনে সব সময়ে এমন কাজে রত থাকবে, যে কাজ মানুষের মনে আলো ফেলবে।
অবিনাশ বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তা হলে এর জন্যে এখন তুমি কী করবে ঠিক করলে?
সুচেতনা মিষ্টি হেসে বলেছিল, ভাবছি একটা স্কুল করব।
স্কুল! যে মানুষটা জীবনের অর্ধেকের বেশি ভোগবিলাসের মধ্যে কাটিয়ে দিল, সে কিনা এই বয়সে এসে স্কুল করবে! হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল অবিনাশ।
সুচেতনা আরও মিষ্টি করে হেসেছিল, তুমিই বলো মানুষকে শিক্ষাদানের থেকে আর কী বড় হতে পারে তার মনে আলো ফেলার জন্যে?
অবিনাশ কিছুই বলতে পারেনি। শিক্ষা পেলেই আলো পড়বে মানুষের মনে! সুচেতনা কি জানে কত শিক্ষিত লোক কত ধরনের ক্রাইম করছে? ওর গুরুদেব কি এক বারের জন্যেও বোঝেননি তাঁর বাণী তিনি কোন পাত্রে রাখলেন?
অবিনাশ সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক। অনেক বিতর্কসভায় সফল। কিন্তু ভুল করেও সুচেতনার সঙ্গে বিতর্কে জড়ায় না, বিতর্কে না গিয়ে একটু অন্য রকম খেলার চেষ্টা করল অবিনাশ। বলল, স্কুল করবে ভাল কথা, কিন্তু তার জন্যে তো অনেক জায়গার দরকার, সে কথা ভেবেছ?
আমি কি তোমার মতো ব্যাগ না নিয়ে বাজারে চলে যাই? সেই ভাবনা আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে।
ভাবা হয়ে গিয়েছে! তা স্কুলটা তৈরি হবে কোথায়?
কেন? কুসুমতলায়।
কুসুমতলায় আলো ফেলার প্রোজেক্ট তৈরি হবে!
কৌতুকের হাসি হাসল অবিনাশ। কিন্তু জায়গাটা কোথায় বুঝতে পারেনি।
অবিনাশের চোখের ভাব পড়ে ফেলেছিল সুচেতনা, বলল, বুঝতে পারছ জায়গাটা কোথায়?
না।
পুরুলিয়ায় বাবার একটা জমি ছিল না, সেই যে মামলায় জিতিয়ে দেওয়ার জন্যে মক্কেল বাবাকে খুশি হয়ে স্বত্ব লিখে দিয়েছিল।
মনে করার চেষ্টা করল অবিনাশ। কিন্তু পারল না। শ্বশুরমশাই পাকা উকিল ছিলেন। অনেক কঠিন মামলা জিতে অনেক রকমের উপহার পেয়েছেন। সেই সবের দায়িত্ব একমাত্র জামাই অবিনাশকে নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু ও সবে কোনও দিন স্বাদই পায়নি অবিনাশ। তারও তো টাকা পয়সা কম কিছু নেই। কলেজ থেকে যা পায় তার অর্ধেকের বেশি পায় সমাজতত্ত্বের ওপরে নিজের লেখা বইয়ের লভ্যাংশ থেকে। তাই অনেক বলেও শ্বশুরমশাই তাঁর সম্পত্তির ব্যাপারে যুক্ত করতে পারেনি অবিনাশকে।
এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অবিনাশের মনে পড়ল এক বার শ্বশুরমশাই বলেছিলেন যা ছড়ানো ছিল তার প্রায় সবটাই গুছিয়ে এনেছেন, শুধু পুরুলিয়ায় একটা সম্পত্তি পড়ে আছে, যেটার কোনও হিল্লে হচ্ছে না। কারণ, ওই জমির জন্যে খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। যে লোকটা ওটার দেখাশোনা করে সে-ই না কোনও দিন দখল করে নেয়। কিন্তু সে সব তো অনেক দিনের কথা। শ্বশুরমশাই গত হয়েছেন তা না হলেও বছর পনেরো হবে। এর পরে ও সব প্রসঙ্গ আর কোনও ভাবেই সামনে আসেনি। তা হলে কুসুমতলার কথা সুচেতনার মাথায় এল কী ভাবে? কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল অবিনাশ।
সুচেতনা বলেছিল, গুরুদেবের কথাটাই সব কিছু ঘটাল।
গুরুদেবের কথা সব কিছু ঘটাল!
হ্যাঁ, ওই যে মনে আলো ফেলার কথা উনি বলেছিলেন না, আশ্রম থেকে ফিরছি, গাড়িতে বসে আলো শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি হঠাৎ মাথায় এল কুসুমতলার কথা।
ও। অবাক হয়েছিল অবিনাশ। কে কোথায় কী ভাবে পৌঁছে যায় কে জানে। যাক পৌঁছনোটাই কথা। সুচেতনা পৌঁছতে পেরেছে। ভাল। তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ও বিদেশে চলে যাওয়ার পরে এক প্রকাণ্ড ফাঁকা সময় যে ভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল সুচেতনাকে তার থেকে ও বেরিয়ে আসতে পেরেছে। থাকুক না এ সব নিয়ে। অবিনাশের তো এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও দরকার নেই।
এই পর্যন্ত ব্যাপারটা মোটামুটি ঠিক ছিল। ওই আলোচনার দিন দুয়েক পরে এক দিন দুপুরবেলায় অবিনাশ তার সমাজতত্ত্বের বইয়ের প্রুফ দেখছিল। এরই মাঝখানে সুচেতনা এসে বলল, ভাবছি সামনের রবিবার কুসুমতলায় যাব...
টেবিলের ওপরে বিরক্তির সঙ্গে কলম গড়িয়ে দিয়ে অবিনাশ বলল, তা যাও...
‘তা যাও’ বলে দিলাম আর হয়ে গেল! এত দিন কোনও যোগাযোগ নেই, যে দেখাশোনার দায়িত্বে আছে সে কী রকম ব্যবহার করবে কে জানে, এ সব ক্ষেত্রে অনেক সময়ে ঝামেলা হয়, ছেলেরা কেউ সঙ্গে না থাকলে হবে!
অবিনাশ স্তব্ধ হয়েছিল ভেতরে ভেতরে। রবিবারগুলো তার কাছে কত মূল্যবান বিয়ের একত্রিশ বছর পরেও সুচেতনাকে বুঝিয়ে বলতে হবে! বোবা হয়ে যাওয়া বোধটা ফের সবাক করার জন্যে অবিনাশ বলেছিল, সব বুঝলাম, তুমি আমায় শুধু একটা কথা বলো, তুমি এই গরমে এক ঘণ্টার বেশি রান্নাঘরে থাকতে পারছ না, এ সি-র মধ্যেও তোমার পিঠ ঘামছে, সেখানে তুমি সাত-আট ঘণ্টা গাড়িতে থাকবে কী করে?
ঠিক পারব, তুমি যাবে কি না বলো।
সুচেতনার দু’চোখ আলোয় ভরে গিয়েছিল। অমন আলো সুচেতনার চোখে দেখেনি অবিনাশ। অবিনাশের মনে হয়েছিল গুরুদেবের নির্দেশ অদ্ভুত বস্তু তো! কোনও দিন গরম কালে মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যায়নি। ড্রাইভারই আনা নেওয়া করেছে। সেই সুচেতনাই বলছে ঠিক পারবে!
অবিনাশকে চুপ করে থাকতে দেখে সুচেতনা বলেছিল, কী হল! মানে, বলো যাবে কী যাবে না?
অবিনাশ টেবিলের ওপরে খুলে রাখা প্রুফগুচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, এখন এই কাজটা শেষ করতে হবে, ওটা নিয়ে পরে ভাবছি।
তার পরে একটা সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। যে রবিবার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সুচেতনার সেই রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতার জন্যে হেড এগজামিনারের বাড়িতে আলোচনা ছিল। ফলে দুপুরের পর থেকে বাড়িতে থাকতে হয়নি। আর অদ্ভুত ভাবে ওই প্রসঙ্গও তোলেনি সুচেতনা। অবিনাশ সচেতন ভাবে সময় গুনেছেন, প্রসঙ্গটা ফিরে আসেনি। অবিনাশের মনে হয়েছে যে কোনও কারণেই হোক ইচ্ছেটা সুচেতনার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আজ রবিবার। মানে দু’এক সপ্তাহ পূর্ণ হল কুসুমতলায় যাওয়ার পরিকল্পনার। এর মধ্যে প্রসঙ্গটা আসেনি। অবিনাশ ভেতরে ভেতরে প্রায় নিশ্চিত হতে চলেছে প্রসঙ্গটা আর ফিরবে না। রবিবার অবিনাশ পাঁচটা কাগজ রাখে। অন্য দিন তিনটে। রবিবার কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। শুধু পড়তে ইচ্ছে করে। আর আন্ডারলাইন করতে। বিছানার ওপরে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে সুখের আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শিরোনাম দেখার চেষ্টা করছিল।
সুচেতনা ঘরে ঢুকে বলল, তুমি এ রকম হিংসুটে জানতাম না তো!
হিংসুটে? আমি? কেন? শিরোনাম ঘুমের রেশ সব একসঙ্গে কেটে গেল অবিনাশের।
নয়তো কী! এই যে তুমি সোশিয়োলজি পড়াচ্ছ, সেই বিষয়ে বই লিখছ, কত মানুষ তোমায় চেনে, এ সব তো আনন্দের কথা, আমি তো সেই কাজটাই করতে চাইছি, একটা স্কুল হবে, কত ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করবে সেখানে, যেহেতু কাজটা আমি করতে চাইছি তাই তোমার রাগ, হিংসুটে না তো কি? উত্তরের অপেক্ষা না করে দপদপান পদক্ষেপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুচেতনা।
অবিনাশ একেবারে থ। যে অভিযোগ সুচেতনা করে গেল তা ভুল প্রমাণ করতে হলে কুসুমতলায় যেতেই হয়। আজ রবিবার। পাঁচটা কাগজ পড়ার দিন। আন্ডারলাইন করার দিন। বারবার চা খাওয়ার দিন। এই সব মুহূর্তের মধ্যে মাথার ভেতর থেকে উবে গেল অবিনাশের। মোবাইলে বোতাম টিপে এজেন্সি থেকে ড্রাইভার নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করে দিল। রোজকার ড্রাইভার আজ ছুটিতে। আগে থেকে বলাও নেই। রিং হয়ে হয়ে কেটে গেল। এত সকালে হয়তো খোলেনি। কিন্তু অবিনাশ ফের রিং করল।

দুই
কিছু দূরে রাস্তা হাল্কা ধোঁয়া হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। টায়ার আটকে যায়নি এই না কত ভাগ্য। কপালের ওপর থেকে জলের মতো ঘাম নামছে। রুমাল হয়ে গিয়েছে ন্যাতা। তবুও সেটাই কপালের ওপরে আলতো করে চাপতে চাপতে অবিনাশ আড়চোখে তাকাল সুচেতনার দিকে। ওর অবস্থা তারই মতো। কিন্তু ঠোঁটে, গালে অমলিন হাসির আভা।
সুচেতনা স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে বলল, কী দেখছ?
অবিনাশ ভাবছিল গুরুদেবের নির্দেশের মাহাত্ম্য। কিন্তু মুখে বলল, তোমায় আজ খুব ভাল লাগছে...
সুচেতনা হেসে বলল, আমি যে কাজে যাচ্ছি সেটাই আসলে সুন্দর, কাজটাই ফুটে উঠেছে আমার মধ্যে।
এত গরম যেন মুহূর্তের জন্যে ভুলে গেল অবিনাশ। এ রকম গভীরতার কথা আগে তো শোনেনি সুচেতনার মুখে! মুহূর্তেই অবশ্য সেই গরম ফিরে এল। পাশের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে হাসল অবিনাশ, শরীর থাকলে না তবে আমি সুন্দর হব, এ যা অবস্থা কিছুক্ষণের মধ্যে না গলে যাই...
সুচেতনা বলল, আসল কথা কী জানো, তুমি আমার কাজটাকে ভেতর থেকে নিতে পারছ না তাই তোমার এত গরম লাগছে...
অবিনাশ নিরুত্তর রইল। উত্তর দেওয়া মানে তাপমাত্রা বাড়ানো।
সুচেতনা বলল, গুরুদেব কী বলেন জানো, মানুষের মনে আলো ফেলা হল আমাদের সকল কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কর্ম।
অবিনাশ যেমন পাশের দিকে তাকিয়ে ছিল তেমনই তাকিয়ে রইল। মনে মনে হাসল। তিনি যতই সোশিয়োলজির ওপরে বই লিখুন, যতই লোকে তাকে চিনুক, অবিনাশ জানে এটা অনেকটা ইন-বিল্ট স্টেবিলাইজারের মতো। জন্মের সময় মানুষ নিয়ে আসে, যাওয়ার সময়ে নিয়ে যায়। এটা সুচেতনাকে বোঝায় কী করে?
বার চারেক জিজ্ঞেস করে অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছেছে অবিনাশ ও সুচেতনা। চার পাশের ওপরে নজর বুলিয়ে যা দেখতে পাচ্ছে তাতে বলা যায় স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের সম্পত্তি একটা ছোটখাটো জঙ্গল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় নিমগাছ। মাদার গাছ আর ফণিমনসার ঢিবি উঁচু হয়ে সামনেটাকে কিছুটা আড়াল করেছে। মাঝে মাঝে কী সব বুনোলতায় গুচ্ছগুচ্ছ বেগুনি ফুল। কিন্তু মানুষজনের কোনও চিহ্ন নেই। আসার সময়ে নজরে এসেছে লোকালয় এখান থেকে সাত-আট কিলোমিটার পিছনে। এ রকম এক জায়গায় সুচেতনা খুঁজছে গোবর্ধন বারুইকে। সুচেতনার স্মৃতি বলছে ওই নামই ছিল লোকটার। এই সম্পত্তির দেখাশোনা করত। কিন্তু চার পাশে ঝুপসি হয়ে থাকা জঙ্গল আর ভরদুপুরেও ঝিঁ ঝিঁ-র ডাক ছাড়া কিছুই নেই যে এখানে! তবে জায়গাটায় বেশ ছায়া আছে।
অবিনাশের দৃষ্টিতে ধরা দিল রাস্তা। কোমর সমান জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সরু পায়ে চলা পথ হারিয়ে গিয়েছে সবুজের ভেতরে। ড্রাইভারকে গাড়ি এখানেই রাখতে বলে সেই সরু পথে এগোতে থাকল দু’জনে। ডাল, লতা-পাতার আঁচড় খেয়ে স্বল্প ফাঁকা একটা জায়গায় এসে পৌঁছল।
চার পাশের জঙ্গলের ওপরে নজর বোলালে বোঝা যায় অনেক পরিশ্রম করে ফাঁকা জায়গাটা তৈরি করা হয়েছে। স্বল্প কিছু চাষ পড়েছে আনাজের। তবে সব্জিগুলো ক্ষয়াটে। সুচেতনা বলল, ওই দেখো...
সুচেতনার নির্দেশিত আঙুল বরাবর তাকাতে অবিনাশ দেখতে পেল একটা ঘর। তালপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরটাকে ঘর বললে ভুল হবে। বলা যেতে পারে উল্টে রাখা একটা বিশাল ঝুড়ি। যদি কেউ মাঝারি উচ্চতার থেকে বেশি হয়, তবে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হবে ওই ঘরে। ঝুড়ি চাপা দিয়ে মুরগি রাখতে দেখেছে অবিনাশ। কিন্তু মানুষের এই রকম আবাস কখনও দেখেনি।
সেই বড়সড় উল্টোনো ঝুড়ির সামনে এসে বেশ মজা পেল অবিনাশ। দরজা ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একটা নয়, অর্ধেক লাথিতেই ওটা শুয়ে পড়বে। অথচ তার বুকে দুটো বড়সড় কড়ায় নামী কোম্পানির ভারী তালা ঝুলছে। অবিনাশ মনে মনে হাসল। এই তো মানুষের বোধ আর সেটাই তৈরি করার কাজে নামতে চাইছে সুচেতনা! বুঝবে। এখনও তো গাড্ডায় পড়েনি।
সুচেতনা সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলল, কী হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, চার পাশে একটু ঘুরে দেখো না কাউকে পাও কি না...
যে জায়গাটায় সব্জির চাষ পড়েছে সেখানে দু’চারটে পাক দিল অবিনাশ। কিন্তু কিছুই চোখে পড়ছে না। হঠাৎ করেই ঝুপসি হয়ে থাকা সবুজের মধ্যে চোখে পড়ল ওই রকমই একটা উল্টোনো ঝুড়ি। তবে একেবারে ওই রকম নয়। মাটির থেকে কিছুটা উঁচুতে, যেন মাচার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। অবিনাশ এগিয়ে গিয়ে বলল, কেউ আছেন?
প্রশ্ন শেষ হতেই অবিনাশ দেখতে পেল মাচার মধ্যে থেকে টপটপ করে মাটিতে পড়ল মানুষের রেচন পদার্থ। চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ও দিকে দৃষ্টি নিয়ে যেতে বাধ্য হল, কারণ সামনের উল্টোনো ঝুড়ির মধ্যে থেকে হেঁড়ে গলায় ভেসে এল, কে, কে ডাকে...
আমরা কলকাতা থেকে আসছি, গোবর্ধনকে খুঁজছিলাম।
দাঁড়ান আসছি।
কয়েক মুহূর্ত পরে তালপাতা দিয়ে তৈরি খাটা পায়খানা থেকে বেরিয়ে এল একটা মানুষের কঙ্কাল। দীর্ঘ দিন রোদেজলে পড়ে থাকা কাঠ যেন। শরীরের হাড়গুলো শুধু চামড়া দিয়ে মোড়া। অথচ ওই শরীরেও কত আবেগ রয়েছে, সেটা অবিনাশ বুঝল লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে। গর্ত হওয়া গালে চামড়া হাসছে।
অবিনাশ নিজের পরিচয় দিতে যাচ্ছিল, লোকটা বলল, একটু অপেক্ষা করুন আসছি। হাতে ধরা রয়েছে একটা বেবিফুডের টিন। কবেকার সেটা টিনটা নিজেই ভুলে গেছে। সেটা নিয়ে সামনের সবুজের মধ্যে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এল। অবিনাশ দেখতে পেল টিনের তলা দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।
এই ভাবে কয়েক বার যাতায়াত হল। পরনের লুঙ্গিটা লেংটির রূপ নিয়েছে। সামনে এসে তাতেই হাত মুছে একগাল হাসল লোকটা, বলুন...
সুচেতনা বলল, আপনি গোবর্ধন বারুই তো?
লোকটা কিছু বলে না। গালের চামড়া শুধু হাসে। মানে ঠিক ধরেছেন।
সুচেতনা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে বলল, জটেশ্বর বারুইয়ের ছেলে তো আপনি? আপনার বাবাও তো এই সম্পত্তির দেখাশোনা করতেন?
হ্যাঁ, আমিই গোবর্ধন, আপনার পরিচয় তো পেলাম না...
আমি উকিলবাবুর মেয়ে।
এখন আর গালের গর্তে চামড়ায় কোনও হাসি নেই। হাল্কা কালচে ছোপের জিভ বেরিয়ে আসে। জিভ কাটে গোবর্ধন। বলে, আপনি হলেন এই সম্পত্তির মা লক্ষ্মী আর আপনাকে আমি দাঁড় করিয়ে রেখেছি! আসুন আসুন...
নিচু দরজার মধ্যে দিয়ে সাবধানেই ঢুকছিল অবিনাশ। তবুও পিঠে খোঁচা খেল। ডলে দেওয়ার জন্যে হাত এগিয়ে দিল গোবর্ধন। ধরে নিল অবিনাশ। চার দিকে এত তাপ। পৃথিবী পুড়ছে। অথচ মানুষটার হাত অদ্ভুত রকমের ঠান্ডা। ঘরের ভিতরে একটা সোঁদা গন্ধ। অনেক সময় গর্ত খুঁড়লে নীচের ঠান্ডা মাটি যখন উঠে আসে এ রকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়। তবে কি ও গর্তবাসী? গুহাবাসী বলে একটা কথা আছে। গর্তবাসী আবার কী? ধুৎ।
একটা তেলচিটে চৌকির ওপরে সুচেতনা আর অবিনাশকে বসিয়েছে গোবর্ধন। বলল, আপনাদের যে কী ভাবে অতিথ্য করি...
সুচেতনা হেসে বলল, অতিথ্য কিছু করতে হবে না, যে জন্যে এসেছি সে কথা বলি...
গোবর্ধনের মুখে বাঁকাচোরা রেখার কয়েকটা সোজা হয়ে গেল।
সুচেতনা একটু অবাক হল। অবিনাশও। সুচেতনা গলা ঝেড়ে নিয়ে বলল, এই যে চার পাশে জঙ্গল হয়ে রয়েছে এ সব পরিষ্কার করতে হবে, এখানে বিল্ডিং তৈরি হবে, স্কুল করব...
গোবর্ধনের গর্ত গালে চামড়া ফের হাসে। বলে, এখানে স্কুল করে কী করবেন! দুটো স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, ছেলেপিলে আসে না, আর যেটায় ছেলেমেয়েরা এখনও পড়তে যায়, তার অবস্থা তো আমার খাটাপায়খানার থেকেও খারাপ...।
সুচেতনা হাল ছাড়ে না। স্বরে কোনও রকম উত্তেজনা না এনে বলে, তাই জন্যে তো করব, আমারটার অবস্থা এ রকম হবে না, আমার স্কুলে তো পাস-ফেল থাকবে না, অন্য রকম ব্যাপার...।
গোবর্ধন নীরব।
সুচেতনা নীরবতার সুযোগ নিয়ে বলল, তুমি বলো এই যে জঙ্গল পরিষ্কার করা, বিল্ডিং তৈরি করা, এই সব কাজের জন্যে লোক ঠিক করা, তাদের সঙ্গে আমাদের কথা বলানো, এ সব পারবে?
মুহূর্তেই ঘাড় নাড়ে গোবর্ধন। মানে পারবে। তার পর বলে, এখানে বিল্ডিং তৈরি হলে আমি থাকব কোথায়?
যে সুচেতনা বোধবৃদ্ধিতে নিবেদিত, সে নিজেই বোধ হারিয়ে ফেলল। বলল, বাবার মুখে আমি শুনেছি বারো বছর কেউ যদি কোনও জায়গায় বসবাস করে তার একটা রাইট জন্মায়, তুমি কি সে রকম কিছু বোঝাতে চাইছ?
গোবর্ধন আবার নীরব।
নীরবতা সুচেতনাকে আরও উত্তেজিত করল। এ যে দেখছি উকিলের ওপরে ওকালতি! উকিলবাবুর সম্পত্তিতে আইন টানছ তুমি!
বলতে বলতে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সুচেতনা। আর জোরে খোঁচা খেল। নিচু চাল। তার থেকে শুকনো তালপাতা ঝুলে আছে ভেঙে। সুচেতনাকে কিছুটা নিরাময় দেওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অবিনাশ।
গোবর্ধনও সচেষ্ট হল। ঘরের অন্ধকারের মধ্যে কী কারণে যেন সরল। আর তাতেই জায়গাটা আলোকিত হল। সাদাকালো পোর্টেবল টিভি। কীসের যেন বিজ্ঞাপন চলছে। গোবর্ধনের মনে হয়েছে টিভি দেখলেই সুচেতনার খোঁচার ব্যথা কমবে।
অবিনাশ বলল, এই জঙ্গলে ‘কেবল লাইন’ পেলে কী করে!
এ দিকে তো নতুন পুলিশ ক্যাম্প হয়েছে, ওই জন্যেই তো লাইন এসেছে, যে লোকটা লাইন টেনেছে ওই বলল এ দিকে লাইন ছিল না, যাচ্ছে যখন নিয়ে নাও কম পয়সায় হয়ে যাবে...
কম পয়সায় হয়ে যাবে!
হ্যাঁ। গোবর্ধনের গালের গর্তে অমলিন ঢেউ।
অবিনাশ বলতে পারল না তোমার বাথরুমের মগটাই তো ফুটো আর কম পয়সায় পেয়ে গেলে বলে কেবল কানেকশন নিয়ে নিলে! আজব!
গোবর্ধন কী বুঝেছে ওই জানে। বলল, ওটা নিলাম বলেই না কত কিছু জানতে পারলাম, জগৎটা জানতে পারলাম।
অবিনাশ দেখতে পেল টিভির পর্দায় টাইলস কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। বাথরুম না বলে রাজপুরী বলাই ভাল।
গোবর্ধন অবিনাশের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, কী সুন্দর না!
অবিনাশের শরীর কী রকম শিরশির করে উঠল। চার পাশে প্রায় জঙ্গল। তারই মাঝখানে শুকনো তালপাতার ঝুপড়ি। কিছুটা ক্ষয়াটে সব্জির চাষ। গালের গর্তে হাসি। অথচ চোখে ঠিক ধরা পড়েছে সুন্দর। অবিনাশের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু মনে হচ্ছে সুন্দরকে বোঝার বোধটা বোধ হয় ওর না থাকলেই ভালছিল।
সুচেতনার খোঁচার ব্যথা সম্ভবত প্রশমিত হয়েছে। মাথার ওপরে ডলতে ডলতে হাত নামিয়ে এনে বলল, তুমি ঠিক করে বলো তো কত হলে তুমি জায়গা ছেড়ে চলে যাবে?
খুব স্বাভাবিক স্বরে গোবর্ধন বলে, লাখ চারেক দেবেন...
চার লাখ!
গোবর্ধন হাসে।
উত্তেজনা বাড়ে সুচেতনার ভেতরে। প্রায় চেঁচিয়ে বলে, তোমার সাহস কম নয়, তোমার বাবা আমার বাবার আমলের লোক, সেই মানুষটা এই জমির আনাজপত্তর কলকাতায় গিয়ে দিয়ে আসত আর তোমার এত লোভ!
লোভের তো কিছু নেই মা লক্ষ্মী, আমার বাবার তো কপাল অনেক ভালছিল, আমার বাবা গরিব ছিল আর জানতও না দুনিয়ায় কী কী আছে, আমার অবস্থা বাবার মতোই, কিন্তু আমি যে জেনে গিয়েছি দুনিয়ায় কত কিছু আছে, আমি কী করব মা লক্ষ্মী?
সুচেতনা হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে অবিনাশের দিকে। অবিনাশ কিছু বলতে পারে না। অবিনাশের খুব বলতে ইচ্ছে করছে তুমি জানো না সূচি যদি ওর ওই বোধটা না থাকত তা হলে ওর জীবনটা অনেক সুন্দর হত। এর পরেও ওর বোধ বৃদ্ধিতে তুমি রত হতে চাও। কিছুই বলা হয় না অবিনাশের। সুচেতনার মতোই সুচেতনার দিকে থ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

ছবি: সায়ন চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.