রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
গল্প-দাদুর আসর
অ্যাটেনবরোর ‘গাঁধী’ দেখেছেন নিশ্চয়ই। ছবিটা শুরুই হল গাঁধীর জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্তগুলো ছুঁয়ে, আততায়ীর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলেন মহাত্মা। বলুন তো, এই শেষ দিয়ে শুরু করা কেন?
এই ‘কেন’-র নানা রকম উত্তর হয়। কোনটা বলা যায়, ভাবছিলাম। তিনি আলতো চোখ টিপে বললেন, সিম্পল। ছবিটা যাঁরা বানিয়েছেন, তাঁরা জানতেন, হলে যত লোক থাকবে, তার মোটামুটি অর্ধেক জানে যে এই মানুষটা কে, কী করেছিল, আর বাকি অর্ধেক? তারা সব মার্কিন স্কুলে পড়েছে, বেচারা!
মানে, তারা জানেই না, গাঁধী লোকটা কে?
জানেই না কি না জানি না, তবে না-জানার সম্ভাবনা যে খুবই বেশি, সেটা হলফ করে বলতে পারি। তাই ছবির প্রথমেই গাঁধীর ওই ট্রেডমার্ক চেহারা, ওই পোশাক আর আচমকা আততায়ীর গুলি। লোকে হলের মধ্যে একটু নড়েচড়ে বসল। ভাবল, দেখাই যাক না, কী হয়!
অ্যাটেনবরোর প্রসঙ্গ মিলিয়ে যেতে না যেতেই প্রশ্নবাণ ধেয়ে এল আবার।
খুবই বিখ্যাত এক মার্কিন কার্টুন চরিত্র, যে ফিল্মেও খুবই নাম করেছে? সত্যি বললে, ফিল্মেই বেশি নাম করেছে! কে?
খানিকক্ষণ এ দিক সে দিক ভেবে আমি আকুল হওয়ার পরে জবাব তিনিই দিলেন। দেখলাম, মাথার ভিতরে ওয়াল্ট ডিজনির কুলুজি ঘেঁটে লাভ হয়নি। চরিত্রটির নাম র‌্যাম্বো। নামভূমিকায় সিলভেস্টার স্ট্যালোন। হাতে আগুন ছোড়া অস্ত্র।
কিন্তু, সারা দুনিয়া তো ওই আগুনখোর লোকটির ‘মাচো’মি-তে মজেছে! তা হলে হঠাৎ র‌্যাম্বোকে কার্টুন বলে ঠেস দেওয়া কেন?
হুমম... গোড়ায় র‌্যাম্বোর এ রকম কার্টুনপনা ছিল না! একটা লোক ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, শরীরে-মনে বিধ্বস্ত। একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি এলাকায়। তার পর এক শেরিফ নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্যেই নিশ্চয়ই, কথা নেই বার্তা নেই, অকারণেই খোঁচাল সেই একলা মানুষটাকে। ব্যস, সেই নিঃসঙ্গ মানুষের খোলস থেকে বেরিয়ে এল র‌্যাম্বো! এই পর্যন্ত কিন্তু ভাল!
তা হলে র‌্যাম্বোকে খারাপ, মানে আপনারই ভাষায় ‘স্যাটারডে মর্নিং কার্টুন’ বলছেন কেন?
কারণ, র‌্যাম্বো সেই যে খোলস ছেড়ে বেরোল, সেই খোলসে আর ঢুকল না। সারা গায়ে ফুলে উঠল পেশি। তেল-চুপচুপে পেশি। শরীর ঘিরে বুলেটের ঝাঁক। হাতে একটা বিদঘুটে বড় মাপের আগ্নেয়াস্ত্র। মাথায় বাঁধা বন্দনা। পণ করেছে, তাকে সুপারহিরো হতেই হবে শুধু না, হয়ে থাকতেও হবে। সেটাই বিপদ।
এই পর্যন্ত বলে হেসে উঠলেন তিনি। রবার্ট ম্যাকি। সত্তর পেরিয়েছেন, দুনিয়া ঘুরে গল্প আর চিত্রনাট্য লেখা শেখান, হলিউডের তাবড় সব ব্যক্তিত্ব তাঁর ছাত্র। ভারতে এই প্রথম আগমন। রামোজি অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন-এর আমন্ত্রণে।
ম্যাকি-র ‘ক্লাস’ করেছেন এবং পরে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড, অর্থাৎ অস্কার পেয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা পঁয়ত্রিশ। ‘অস্কার নমিনেশন’-এর সংখ্যা একশো পঁয়ষট্টি। ম্যাকি নিজেও ‘বাফটা’-সহ নানাবিধ পুরস্কার পেয়েছেন। তা বলে যদি ভাবা হয় যে, ভদ্রলোক হাড়েমজ্জায় হলিউডি, ভুল! কেন ভুল, তার কয়েকটা নমুনা ম্যাকি-র উপরে লেখা কয়েকটি মন্তব্য থেকে স্পষ্ট। আরও নমুনা চাইলে আরও দু’একটি মন্তব্য দাখিল করা যাক।
রবার্ট ম্যাকি দ্বিধাহীন ভাবে বলেন, হলিউডে বছরে পাঁচশো ছবি হয়, ক’টা ভাল বলুন তো? স্রেফ এক শতাংশ। পাঁচটি। গুণে পাঁচটি। ব্যস, ওই ঢের! ঠিক যে রকম, ভারতে যদি বছরে হাজারখানেক ছবি হয়, তার থেকে বছরে হয়তো দুটো, বড়জোর তিনটে সেই মানের ছবি বেরোতে পারে যা নিয়ে বিশ্বের যে কোনও জায়গায় যাওয়া যায় বুক ফুলিয়ে।
রবার্ট ম্যাকি একটি ঘটনার কথা বলেন। তাঁর নিজেরই জীবনের ঘটনা। অন্তত, তাঁর দাবি মানলে তো সেটাই বলতে হয়। তিনি থাকেন আরিজোনার কাছে, কোনও একটি মরু-শহরে। এক দিন গাড়ি চালিয়ে ফিরছেন। সস্ত্রীক। ফাঁকা, ঝকঝকে হাইওয়ে, যেমন হলিউডি ছবিতে দেখা যায়। হঠাৎই, কী করে যেন সামনে চলে এল একটা হরিণ। ব্রেক কষা হল শেষ মুহূর্তে, কিন্তু অত দ্রুত বেগে ধাবমান গাড়িকে ওইটুকু সময়ে বশে আনা মুশকিল। ছিটকে পড়ল হরিণটি।
তৎক্ষণাৎ আমার স্ত্রী গাড়ির দরজা ধাক্কা মেরে খুলে ছিটকে বেরিয়ে এল। চিৎকার করে বলল, কাম আউট, কাম আউট... আমি ভাবলাম বোধ হয় হরিণটার জন্যে বলছে। আমি নামছিলামই গাড়ি থেকে, কিন্তু সে তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে, তার দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেন! সে চিৎকার করছে আর বলছে, কাম আউট, প্লিজ কাম আউট ইমিডিয়েটলি! দ্য কার উইল এক্সপ্লোড!
ম্যাকি বলছেন, এটাই হলিউড! লোককে রীতিমতো বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে যে, যার সঙ্গেই ধাক্কা লাগুক না কেন, সংঘর্ষ হওয়ামাত্র গাড়িটা মাটি থেকে ফুট চল্লিশেক ওপরে সাঁ করে উড়ে যায়।
বললাম, সে তো এখন দুনিয়ার সর্বত্রই হচ্ছে। বিস্ফোরণে গাড়ি ধাঁই করে আকাশে লাফিয়ে উঠল। একটা গুলি খেয়ে, বা ঘুঁষি খেয়েও কোনও লোক উড়ে গিয়ে পড়ল কুড়ি ফুট দূরে। ‘ম্যাট্রিক্স এফেক্ট’!
ঠিক, ‘ম্যাট্রিক্স’ ছবিতে এ রকম উড়ে যাওয়ার ব্যাপার ছিল। কিন্তু, একটা কথা মনে রাখবেন। ‘ম্যাট্রিক্স’ ছবিটা কিন্তু খুব সফল ভাবে নিজের মতো করে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছিল। সেখানে কী করলে কী হয়, তার হিসেবটা আমাদের এই রোজকার পৃথিবীর সঙ্গে মিলবে না। তাই, সেটা দেখতে বসলে আপনাকে মেনে নিতেই হবে যে একটা গুলি খেয়ে কেউ ছিটকে যেতেই পারে কুড়ি ফুট! মজাটা হল, সে রকম কিছু নেই, এমনিতে সবই এই দুনিয়ার মতো, অথচ গুলিগোলা শুরু হলেই ‘ম্যাট্রিক্স’ এফেক্ট, সেটা তো হাস্যকর, তাই না?
তার মানে, আপনি বলছেন, কোনও ছবি যদি তার নিজের মতো করে একটা জগৎ তৈরি করে নিতে পারে, সেটা তা হলে তার পক্ষে খুব বড় একটা সাফল্য। এই যে হিন্দি ছবি, যাকে বলিউড সিনেমা বলে ডাকা হয়, সেখানে যে কোনও সময় নাচগান শুরু হয়ে যায়, একটা গানের মধ্যে দশটা লোকেশন আসে আপনার কথা মানলে তো বলাই যায় যে, এই ধরনের ছবি সে রকম একটা জগৎ তৈরি করে ফেলে। ফলে, এই ছবি দেখতে বসলে আপনাকে মেনে নিতে হবে যে, এ সবই সম্ভব!
নিশ্চয়ই সম্ভব। যদি ছবিটা সেই রকম একটা জায়গা তৈরি করতে পারে, তা হলে ‘ছি, এমন কখনও হয় নাকি’ বলে নাক কুঁচকালে চলবে না। কিন্তু, ওই জায়গাটা তৈরি করতে হবে। শুধু সাত-আটটা ঝকঝকে সেট, সমুদ্রসৈকত আর পাহাড়চুড়ো দেখালেই হবে না, ছবির গল্পের মধ্যে সেই অন্য দুনিয়ার সুতোগুলো বুনে দিতে হবে। সেটা যদি ঠিক করে করতে পারেন, তা হলে ‘সং অ্যান্ড ডান্স’-এ আপত্তি ওঠার কথা নয়। এটা একটা ধারা। নিজের জোরেই তার পরিচয়। অন্যে কে কী বলল, তাতে কী যায় আসে?
রবার্ট ম্যাকি বাকশিল্পে নিপুণ। কিন্তু, সেই বাকচাতুরি ছাড়াও তাঁর কয়েকটা বিশ্বাসের জায়গা আছে।
যেমন, তিনি বিশ্বাস করেন যে, আমরা যে যা করি, তার নব্বই শতাংশই ফালতু, বাকি যে দশ শতাংশ, তার মধ্যে প্রতিভার ছোঁয়া থাকতে পারে।
বললাম, ভাল জিনিস যত কম হয়, ততই ভাল, এ রকম একটা কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু সত্যিই কি সারবস্তুর ভাগটা এত কম?
ম্যাকি হাসলেন, বললেন, মুশকিলটা কী জানেন, দারুণ ঝকঝকে ছবি, দেখতে বসে মুগ্ধ হয়ে যাবেন, সংলাপ কানে লেগে থাকবে, শুধু বেরিয়ে এসে মনে হবে, আহা, গল্পটা যদি একটু ঠিকঠাক থাকত! জীবনের একেবারে শুরুতে হলিউডি নানা ফিল্ম-সংস্থায় চাকরি করতাম, কাজটা ছিল ‘চিত্রনাট্য’ পড়েটড়ে তার সম্পর্কে মন্তব্য লেখা। গাদাগুচ্ছের খাম রোজ জমা হত অফিসে, আমিও পড়তাম। তার পর কমেন্ট লিখতাম, ব্রেথটেকিং সিনস, উইটি ডায়ালগস, এক্সেলেন্ট সিচুয়েশনস...হাওয়েভার...
ম্যাকি ফের হাসলেন, এই ‘হাওয়েভার’-টাই গুরুত্বপূর্ণ! হাওয়েভার দ্য স্টোরি ইজ প্যাথেটিক! গল্প বলে কিছু নেই। অবশ্য, সব সময় এই ‘হাওয়েভার’-টা লিখতে পারিনি, চাকরি যাওয়ার ভয় ছিল, মনে মনে ভাবতাম, ইস, এই স্ক্রিপ্টটায় সবই আছে, শুধু যদি গল্পটা থাকত!
বললাম, কেন বলুন তো, ছবিতে যারা সবই দিতে পারে, ঠিকঠাক চিত্রনাট্যটা কেন দিতে পারে না?
খাটে না মশাই, তাই পারে না। হেমিংওয়ের একটা কথা আছে, জানেন, যে কোনও লেখারই প্রথম খসড়াটা ফালতু! ফলে, আপনাকে বারবার লিখতেই হবে। সরি, এর কোনও শর্টকাট নেই।
কিন্তু, অনেকে তো খাটেন, একটা চিত্রনাট্য নিয়েই পড়ে থাকেন...
দুর, আমি ‘রি-রাইটিং’-এর কথা বলছি! সেটা ফাঁকি মেরে হয় না। আপনি এখানে একটা সিন একটু বদলালেন, ওখানে দুটো সংলাপ একটু অদলবদল করলেন? তাকে ‘রি-রাইটিং’ বলে নাকি? ছ্যা!
তা হলে?
‘রি-রাইটিং’ মানে ফিরে লেখা শুধু নয়, ফিরে দেখাও বটে! নতুন করে দেখা। আগের খসড়াটাকেই চ্যালেঞ্জ করা। প্রতি বার নতুন কিছু আনবেন লেখার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে, তবে না! এই করতে করতে দেখবেন, আপনি সেই জিনিসটা পেয়ে যাচ্ছেন। সেই নোঙর যা গল্পটাকে ধরে রাখবে, অডিয়েন্সকে ধরে রাখবে।
অর্থাৎ, আপনি যাকে বলেন, ‘ইনসাইটিং ইনসিডেন্ট’!
রাইট! প্রথমে জনগণের মনটাকে তো গেঁথে নিতে হবে বঁড়শিতে, তার পর গল্প এগোবে।
সেই বঁড়শি, রবার্ট ম্যাকির ভাষায় ‘হুক’, খুবই জরুরি। কী রকম হতে পারে তার চেহারা, জিজ্ঞেস করলে সত্তরোর্ধ্ব চক্ষু ঝকঝক করে উঠবে। তিনি বলবেন, দেখুন, তার কোনও ধরাবাঁধা কানুন কিছু নেই। ওই যে বলছিলাম, ‘গাঁধী’। ছবিটা শুরুই হল গাঁধীর হত্যা দিয়ে। শুরু থেকেই গাঁধীর স্ট্রাগল, দক্ষিণ আফ্রিকা, তার পর নানা রকম আন্দোলন ইত্যাদি দেখালে লোকে একটু ক্লান্ত হতেও পারত। ওই হত্যার দৃশ্যটা সেই যে তাদের গোড়া থেকেই টানটান করে বসিয়ে দিল, ব্যস! আবার দেখুন, ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ লিখতে গিয়ে আকিভা, আমার ছাত্র, একটা অদ্ভুত রাস্তা নিল। দেখেছেন ছবিটা?
বললাম, দেখেছি। অর্থনীতিবিদ জন ন্যাশকে নিয়ে ছবি, রাসেল ক্রো-র অভিনয়...এক জন অসামান্য প্রতিভাবান মানুষ, কিন্তু মানসিক ভাবে বেসামাল...
ঠিক, কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, একটা জীবনী-ভিত্তিক ছবি, যাকে ‘বায়োপিক’ বলা হচ্ছে এখন, সেটা শুরুই হচ্ছে কিছু সম্পূর্ণ ভুল তথ্য দিয়ে। আমরা দেখছি, ন্যাশকে মার্কিন সরকার খুঁজছে, একটা গোপন সোভিয়েত কোড-এর পাঠোদ্ধার করতে হবে, এফ বি আই-এর লোক তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে, সর্বত্র! অথচ, ছবিটা বেশ খানিকটা গড়ানোর পরে দেখা গেল, ও বাবা, এ সবের কিছুই ঘটেনি। সবটাই ন্যাশ ভেবেছিল! তখন দর্শক ভাবল, তাই তো, সে কেন এ রকম ভেবেছিল?
এই বার ছবিটা জানাল যে, ন্যাশ প্যারানয়েড স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত! ফলে, ছবিটা অনেকখানি গড়ানোর পরে দর্শক যখন দেখল, যা ঘটেছে বলে দেখানো হল, তা আসলে ঘটেইনি, তার কিন্তু রাগ হল না, বরং কষ্ট হল। ওই ন্যাশ-এর জন্য কষ্ট হল। ভাবল, আহা, বেচারা... অর্থাৎ, ততক্ষণে সে ওই চরিত্রটার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। এটাই ছবির গল্প-লিখিয়ের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। এর কোনও শর্টকাট নেই, কোনও ফর্মুলাও নেই...
সে কী? আপনি বিশ্বজুড়ে গল্প লেখা শিখিয়ে বেড়ান, দুনিয়ার সমস্ত নামজাদা ফিল্ম স্কুল-এ আপনার লেখা বই ‘স্টোরি’ ধর্মগ্রন্থের মতো পড়ানো হয়, আপনিই যদি বলেন যে ভাল গল্প রচনার সূত্র বলে কিছু হয় না, তা হলে আর...
ম্যাকি বললেন, ওটাই তো মজা। গল্প নিয়ে থাকি বলেই জানি, সিনেমার ক্ষেত্রে ভাল গল্প ঠিক কী, আজ পর্যন্ত তার কোনও ধরাবাঁধা নিয়ম বেরোয়নি, কয়েকটা সাধারণ কথা বলা হয়, ওই পর্যন্ত... ভাল গল্পের আর একটা উদাহরণ দিই। আপনাদেরই উদাহরণ।
মানে?
সত্যজিৎ রায়। হাতে-গোনা যে সব পরিচালক গল্পটা ঠিকঠাক বলতে পারেন, রায় তাঁদেরই এক জন। ওঁর অনেক ছবি আমি দেখেছি, সব থেকে প্রিয় যেটা, সেটা আমি দেখেছিলাম, ধরুন আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে। ‘দ্য মিউজিক রুম’।
‘জলসাঘর’।
ইয়েস। তখন আমার বয়েস আন্দাজ বাইশ-তেইশ, যে জায়গাটা দেখানো হচ্ছে ছবিতে, তার সঙ্গে আমার পরিবেশের কোনও মিল নেই, কিন্তু দেখতে বসে আমি উঠতে পারিনি। মূল চরিত্র যে, এক জমিদার, একটা দিকে সে একা, অন্য দিকে তার দ্রুত পাল্টাতে-থাকা পরিবেশ। সেই জমিদারের সঙ্গে আছে তার একটা অনুভূতি। সুন্দরের প্রতি তার ভালোবাসা। আর ওই যে লোকটা, যে সদ্য কিছু পয়সা করছে, সে টাকার গরমে বুঝতেই পারে না, এই লোকটা সর্বস্ব পণ করে হঠাৎ এই নাচের বন্দোবস্তটা করছে কেন! ছবির শেষে যখন সেই বিরাট ঘরে শেষ নাচটা হচ্ছে, নাচটা ফুরোল, এই লোকটা ইনাম দিতে গেল আর তখনই তার হাতটা ছড়ি দিয়ে টেনে ধরল এই জমিদার। সেই লোকটা তখন... মনে নেই কে অভিনয় করেছিলেন...
গঙ্গাপদ বসু!
ইয়েস, গ্রেট অ্যাক্টর! সে তাকায় এই জমিদারের দিকে। কী আশ্চর্য দৃষ্টি! সে বুঝতে পারে, এই লোকটা তার চেয়ে বড়, কিন্তু বুঝতে পারে না, কেন বড়! দর্শক বোঝে, কেন। তার সুন্দরের বোধ-টা আছে, ওই লোকটার নেই, তাই। এই জিনিসটা এমন আশ্চর্য ভাবে বেরিয়ে এল ছবিটা থেকে, ভাবা যায় না। এটাই ছবির কাজ। মানুষের চরিত্রের মধ্যে, নানা রকম সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করে, খুঁটিয়ে দেখা, কোন ঘটনা থেকে জীবন কোন দিকে বাঁক নিতে পারে, তা ভাবতে চেষ্টা করা, সম্পর্কের সুতোগুলিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা...
হলিউড সেটা করছে বলে আপনার মনে হয়?
ছোঃ! রবার্ট কাঁধ ঝাঁকালেন, সেটা করলে বছরে এতগুলো করে ভুষি মাল বেরোত না। তবে, ধাপ্পাবাজি প্রচুর। নাম করেই বলি। যেমন, স্টিভন স্পিলবার্গ। এই ভদ্রলোকের একটি ছবি এখন চলছে, ‘ওয়র হর্স’, অস্কার-এ অনেকগুলো নমিনেশন পেয়েছে ছবিটা, বেশ কয়েকটা পেয়েও যাবে হয়তো, কিন্তু আমার মতে, এটা খারাপ ছবি। কারণ, ওপরে মোড়কটা যা-ই থাক, ভেতরে ভেতরে এটা একটা প্রো-ওয়র ফিল্ম! মুখে বলবেন, ইস, যুদ্ধ কী বীভৎস, এ দিকে ছবিতে নিখুঁত ডিটেলিং-এ মারামারি কাটাকাটি দেখাবেন, একটা মুণ্ডু ছিটকে উঠল, দেহটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এটা অর্থহীন। তার চেয়ে বরং বলেই দিক না, এই সব দেখাচ্ছি বিনোদনের জন্য, ছবিটা বেচতে হবে, তাই। কিন্তু, তা তো বলবে না... বরং পর্দা জুড়ে ওই সব দেখিয়ে একটা স্পেকট্যাকল তৈরি করবে... লোকে দু’চোখ ভরে হাঁ করে দেখবে, পর্দা জুড়ে এন্তার গুলি, বোমা, মৃত্যু...
বললাম, দুনিয়া জুড়ে হলিউডের খ্যাতির একটা বড় কারণ তো এটাই যে, দেখে হাঁ হয়ে যেতে হয়...
রবার্ট ম্যাকে একটু থামলেন। চায়ে চুমুক দিলেন, তার পর ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাসকে কথার ভিতরে চালান করে দিয়ে বললেন, ঠিক। কিন্তু, ওই যে আপনাকে হাঁ করিয়ে দিল, তার পর আর আপনার কোনও দায় থাকল না চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করার, তাকে নিয়ে ভাবার...। শুনুন, বিনোদনের অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। আপনি যা চাইছেন, পর্দায় সেটা ফুটে উঠবেই। ভায়োলেন্স থাকতেই পারে যেমন ‘জস’-এ ছিল, কিন্তু সেখানে একটা বিশাল হাঙরের পাশাপাশি মানবিক সম্পর্কের একটা গল্পও ছিল। কিন্তু, এখন মাথা নেই মুণ্ডু নেই, শুধু মারামারি... প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে, রাতকে দিন করা কোনও ব্যাপার নয়। লেখকদেরও আর খাটতে হচ্ছে না, চারটি ধুমধাড়াক্কা দেখিয়ে দিতে পারলেই হল, ব্যস!
রবার্ট ম্যাকি প্রশ্ন করতে ভালবাসেন। বললেন, সিনেমার ইতিহাসের সব থেকে বড় ধাপ্পাটা কী বলুন তো? যেটা দীর্ঘকালের, এখনও চলছে, পরেও চলবে!
প্রশ্নটি জামাই-ঠকানো গোত্রের, প্রশ্নকর্তা ছাড়া তার জবাব কে-ই বা জানে? সুতরাং, হাসি হাসি মুখে মৌনাবলম্বনই বাঞ্ছনীয়।
রবার্ট ম্যাকি বললেন, ধাপ্পাটা এই যে, সিনেমায় পরিচালকই নাকি সব! গল্পকার, চিত্রনাট্যকার এরা কিছুই নয়। ভাল ছবির সমস্ত কৃতিত্ব পরিচালকই নিয়ে চলে যায়, এদের কথা কারও মনেই থাকে না। কিন্তু, গল্প ভাল না হলে, টানটান চিত্রনাট্য না হলে কখনও কোনও ছবি দাঁড়িয়েছে?
ম্যাকি হাসলেন।
অর্থপূর্ণ হাসি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.