|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
‘জেলের দরজার ওপাশে ভয়ংকর শূন্যতা’ |
সাতচল্লিশ বছর বয়সে শেষ বারের মতো স্বদেশ ছেড়েছিলেন ফরাসি শিল্পী ইউজিন অঁরি পল গগ্যাঁ (১৮৪৮-১৯০৩)। শেষ আট বছর কেটেছিল পলিনেশিয়ায়। তাহিতি-বাসের কালে আঁকা তাঁর চিত্রকলা বিশ্ববন্দিত হয়েছে। ‘সভ্যতা’র নকল জীবন অসহনীয় হয়েছিল তাঁর, সুদূর দ্বীপভূমির প্রাচীন সমাজের অকৃত্রিম মানুষগুলোকে তাঁর নিজের মনে হয়েছিল, ক্রমশ নিজের জীবনাচরণে এবং মনের অভ্যাসে তিনি তাদেরই মতো হয়ে উঠেছিলেন। সেই জীবনের জার্নাল নোয়া নোয়া (মনফকিরা, ১৯৫.০০)। ‘নোয়া’ মানে সুগন্ধী। বিশ্লেষণটি তেহুরা সম্পর্কে। তেহুরা গগ্যাঁকে বিয়ে করেছিল। তার মধ্যে তিনি তাহিতিকে খুঁজে পেয়েছিলেন। বিশ্লেষণটি তাই তাহিতি সম্পর্কেও। শিল্পীর আঁকা বেশ কিছু ছবির প্রতিলিপি আছে বইটিতে।
শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেন সুদূরের পিয়াসী-র লেখক, সুমথনাথ ঘোষ। নামটি এখন তত পরিচিত নয়, কিন্তু একদা তাঁর ওই ভ্রমণকাহিনি, কিংবা উপন্যাস বাঁকা স্রোত সাড়া জাগিয়েছিল বাংলা সাহিত্যে। তাঁর শতবার্ষিকী সংকলন (মিত্র ও ঘোষ, ৩০০.০০) ধরে রেখেছে বাংলা সাহিত্যের সেই সময়কে সুমথনাথের দুটি উপন্যাস, কয়েকটি গল্প আর বেশ কয়েকটি কিশোর রচনায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের সঙ্গে নিজে-র (সংকলন ও সম্পাদনা রফিক উল ইসলাম, প্রতিভাস, ২৫০.০০) কোনও ভূমিকা নেই। কারণ এ বইয়ের সব পৃষ্ঠাই ভূমিকাময়। এ পর্যন্ত সুনীল নিজের যত বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন, সে সবেরই সংকলন এটি। মৌলিক ও অনুবাদ কবিতার বই, গল্পের বই, উপন্যাস, সংকলন, পত্রিকা-সংকলন, সম্পাদিত সংকলন এমনকী তাঁর আত্মজীবনীরও ভূমিকা সংকলিত এখানে। বইটি ছাড়া পরের পর ভূমিকা পড়ার একটাই সার্থকতা মনে হয়, লেখকের সাহিত্যচিন্তার একটা পরিচয় পাওয়া।
‘একটা লোক যার সঙ্গীতশিক্ষার, সাঙ্গীতিক অভ্যেসের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজলে সব ধরনের সঙ্গীতই পাওয়া যাবে, কিন্তু কিছুতেই, কোনওভাবেই রক মিউজিকের ত্রিসীমানায় তাকে পাওয়া যাবে না। আমি হলাম সেরকমই একজন! ... কোন ম্যাজিকে, কোন সুযোগে আমার ঘাড়ে চাপল এই রকের ভূত? এর উত্তরে অনেক কথাই বলতে হয়...’ অনেক কথা বলেছেন রূপম। তাঁর গান-জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, নানা তর্কবিতর্ক, বহু কনসার্টের ‘ব্যাকস্টেজ ডায়েরি’, ইত্যাদি। সঙ্গে আছে বেশ কিছু গান। এবং অবশ্যই, নানা বিষয়ে রূপমের মতামত, সমালোচনা। প্রচুর ছবি ও অলঙ্করণ সহ নানারঙের পাতা সাজিয়ে তৈরি এই তো আমি (আনন্দ, ৩০০.০০)।
খদ্দরের জ্যাকেটটুকু দেখা যাচ্ছে শুধু, তার পকেটে দুটি কলম, একটি চশমা। মানুষটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। প্রচ্ছদেই চমকে দিয়েছে সুধীর চক্রবর্তীর দেখা না-দেখায় মেশা (লালমাটি, ৪০০.০০)। অবিশ্যি মুখ দেখার দরকার কি, তাঁর কলমই যে দেখায় না-দেখা সব অচিন মানুষ। ব্যক্তিগত গদ্যে এমন একান্ত স্মৃতিচারণ সম্প্রতি বিরল। বিরল সুব্রত মাজীর করা প্রচ্ছদটিও।
‘চারুদা মানতেই চান না, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। হঠে যাচ্ছি। তর্ক হলেই, ভীষণ আবেগী হয়ে যাচ্ছেন। কাঁদছেন। বারবার বলছেন, আমার শরীরটা ভালো থাকলে... খবর আসছে কখনো নদীয়ায়, কখনো বাঁকুড়ায়, কখনো বীরভূমে গণফৌজ মার্চ করছে। চারুদা আমাকেই পাঠাতেন।... যেতাম এবং দেখতাম কিছুই নেই। প্রত্যেকবার একই ব্যাপার। তবু যেতেই হত। আর প্রত্যেকবারই চারুদাকে মিথ্যে বলতে হত গণফৌজ ধীরে ধীরে হলেও এগোচ্ছে।’ এক নকশালবন্দির স্মৃতি, চারুবাবুর ছায়াসঙ্গী ছিলেন তিনি, তাঁর সঙ্গে জেল-ওয়ার্ডে কয়েক জন ছাড়া আর কেউ মিশতেন না, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে চারু মজুমদারকে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ছিল। লিখেছেন কল্লোল তাঁর কারাগার, বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা-য় (একটি গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা, ৩০.০০)। কল্লোলের ঝুলিতে অবশ্য এমনই আরও নানান বন্দিজীবনের গল্প, নকশাল আন্দোলনে নিজের জড়িয়ে পড়া বা জেলে যাওয়ার স্মৃতির সঙ্গে তিনি তুলে এনেছেন সে সবও। বইটির গোড়ায় ‘ধরতাই’তে লিখেছেন ‘একজনের স্মৃতি অন্য একজনের স্মৃতির ভিতর, সেই মানুষটির স্মৃতি হয়ে থেকে যেতে পারে। এমন তো হয়ই, স্মৃতিতে স্মৃতির স্মৃতি।’ ১৯৬৯-১৯৭৭ অবধি ব্যাপ্ত সেই স্মৃতি যে শুধু সে সময়ের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন আর আক্রান্ত আন্দোলনকারীদের চিহ্ন বা দলিল হয়ে উঠেছে তাই নয়, বিপ্লবী মানসিকতার মধ্যে ঘুমিয়ে বা জেগে থাকা কত অনতিতুচ্ছ অনুভূতিরও হদিশ এনে দিয়েছে। এমনকী বন্দিমুক্তির সময় আবেগের বাইরে বেরিয়ে এসেছে কল্লোলের কলম: ‘জেলের দরজার ওপাশে ভয়ংকর শূন্যতা। দারিদ্র তার দাঁত নখে শান দিয়ে আছে। বেরোলেই ছিঁড়ে খাবে।... মুক্তি এমন এক অসহায়তাকে সামনে এনে দিলো, যেখানে তর্ক চলে না। যেখানে জেতা-হারা হয় না।’ |
|
|
|
|
|