|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
বইটার মস্ত গুণ লেখকের হিউমার |
অমিতাভ গুপ্ত |
লখনউ বয়: আ মেমোয়ার। বিনোদ মেহতা, পেঙ্গুইন ভাইকিং, ৪৯৯.০০ |
কোনও এক উদীয়মান বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সিঁড়ির নীচের ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করেছিলেন। কলকাতায়, গত শতকের পঞ্চাশের দশকের ঘটনা। তা দেখে নাকি কমলকুমার মজুমদার মন্তব্য করেছিলেন, বুঝলে না, এ সবই আত্মজীবনী লেখার ছক!
সেই বুদ্ধিজীবীর আত্মজীবনী শেষ পর্যন্ত বেরিয়েছিল কি না, জানি না। কিন্তু, বছর বছর যত আত্মজীবনী বেরোয়, তার সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রশ্ন হল, কারও আত্মজীবনী আমি পড়ব কেন? কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাই প্রযোজ্য নয় সচিন তেন্ডুলকর, সনিয়া গাঁধী, অমর্ত্য সেন বা একেবারে হালফিলের সানি লিওন, এঁদের আত্মজীবনী পড়ার সোজাসাপটা কারণ আছে, আমরা এঁদের জীবনের কথা জানতে চাই। কিন্তু, যাঁরা এই গোত্রে পড়েন না, তাঁদের ক্ষেত্রে? আউটলুক পত্রিকার সম্পাদক বিনোদ মেহতা একটি আত্মজীবনী লিখেছেন, সেটার কথাই ধরুন। বিনোদ মেটা, বা তাঁর মতো অন্য কোনও সাংবাদিক তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে কী রকম, বেশির ভাগ মানুষের তাতে আগ্রহ থাকার কারণ নেই। তাঁর আত্মজীবনী পড়তে চাওয়ার, অতএব, একটাই কারণ থাকে তাঁর চোখ দিয়ে তাঁর সময়টাকে দেখা। বিনোদ মেটার মতো সাংবাদিকের ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি প্রযোজ্য, তাঁর পেশার কারণেই। আশা করাই যায়, আর পাঁচ জনের চেয়ে তাঁরা অনেক খুঁটিয়ে দেখবেন সমকালকে।
বিনোদ মেটার আত্মজীবনী ‘লখনউ বয়’ এই প্রত্যাশা খুব বেশি পূরণ করে না। তিনি যে সময়ের মধ্যে সাংবাদিকতা করেছেন, মানে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত, সেটা এক আশ্চর্য সময়। ইন্দিরা গাঁধীর সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রবাদ থেকে হালফিলের খোলামেলা অর্থনীতি, এবং তার সঙ্গতের রাজনীতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ বিনোদের হয়েছে। এই বইয়ে সেই অভিজ্ঞতা আরও অনেক বেশি থাকা প্রত্যাশিত ছিল। আশির দশকের ভারতের চেহারা কেমন ছিল, তার একটা গল্প আছে এই বইয়ে। গল্পটির বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা, সেই তর্কে না গিয়ে বরং গল্পটা বলি। বিনোদ তখন ইন্ডিয়ান পোস্ট-এর সম্পাদক। কাগজটির মালিক রেমন্ডস গোষ্ঠীর অন্যতম অধিকারী বিজয়পৎ সিংঘানিয়া। কাগজটির বেশ কিছু খবর তখনকার ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে যায়। যে সময়কার কথা, তখনও আর্থিক সংস্কার ভবিষ্যতের গর্ভে। কেন্দ্রীয় সরকার তখন সর্বশক্তিমান। ফলে, অবিলম্বে রেমন্ডস-এর ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধা তৈরি হল। দিন কয়েক পরে মালিকের লেখা একটি চিঠি পেলেন বিনোদ। চিঠিটা এই রকম: ‘বিনোদজি, সম্প্রতি আমাদের কাগজে বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের বিরুদ্ধে এমন কিছু খবর ছাপা হয়েছে যে আমি মারাত্মক অস্বস্তিতে পড়েছি। খবরগুলোর আদৌ কোনও বাস্তব ভিত্তি আছে কি না, সেটা আপনি জানেন আমার অবশ্য মনে হয়েছে, ওগুলোর মধ্যে কয়েকটা আন্দাজের ভিত্তিতে লেখা, রঙ চড়িয়ে লেখা। কাগজে কী লেখা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমাদের একটু সাবধান থাকতে হবে। একটা কথা বলি যদি কোনও অকাট্য প্রমাণ আপনার হাতে না থাকে, তবে কয়েক জনের বিষয়ে কোনও খবর এখন না ছাপাই ভাল। অন্যথায় আমাদের ব্যবসার মারাত্মক ক্ষতি হবে। যাঁদের কথা বলছি, তাঁরা হলেন ১) প্রধানমন্ত্রী (রাজীব গাঁধী), ২) অমিতাভ বচ্চন, ৩) সতীশ শর্মা, ৪) ললিত সুরি, ৫) ধীরুভাই অম্বানি, ৬) বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, ৭) মুরলি দেওরা এবং ৮) শরদ পওয়ার। আমার অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’
বিনোদ মেটা তাঁর পেশাদার জীবনে বেশ কিছু শত্রু বানিয়েছেন। তাঁরা এই বইয়ে বিলক্ষণ আছেন। বেশির ভাগ শত্রু সম্বন্ধেই বিনোদ নির্দয়। সলমন রুশদি ব্যতিক্রম। রুশদি বিনোদের বহু পুরনো বন্ধু। তাঁর একটি উপন্যাসের (দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট) অতি তীব্র সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল আউটলুক-এ। পঙ্কজ মিশ্রর লেখা। বিনোদ লিখেছেন, এই সমালোচনার পিছনে তাঁর কোনও অবদান ছিল না তিনি লেখাটি ছাপার অক্ষরে প্রথম বার দেখেছিলেন। কোনও সম্পাদক এই কথাটি বললে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চাকরি যাওয়া উচিত, কিন্তু সে কথা থাক। সমালোচনাটি পড়ে মর্মান্তিক চটেছিলেন রুশদি। সেটা ১৯৯৯ সালের কথা। তার পর কোনও দিন আউটলুক-এর কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে রুশদি একটি কথাও বলেননি। ঘটনার দশ বছর পরে রুশদির সঙ্গে এক পার্টিতে বিনোদের দেখা। বিনোদ ভাবলেন, অনেক হয়েছে, এ বার মিটিয়ে নেওয়া যাক। এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘সলমন, সেই ১৭০০ শব্দের লেখাটা নিয়ে, আশা করি, আর আমার ওপর কোনও রাগ নেই?’ রুশদি বেশ রাগত স্বরেই উত্তর দিলেন, ‘১৭০০ শব্দ? হুঁঃ, ১৭৪০ শব্দ!’ এর পর আর কথা বাড়ানোর অর্থ হয় না। পুরো উপাখ্যানটির বর্ণনায় এমন একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে যে বোঝা যায়, বিনোদ অন্তত সলমন রুশদিকে নিজের শত্রুর তালিকায় রাখেননি।
এই কথাটি অবশ্য খুব বেশি জনের সম্বন্ধে বলার উপায় নেই। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র দিলীপ পদগাওকর থেকে রাজনীতিক শরদ পওয়ার, বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই বিনোদের মতামত স্পষ্ট ভাবে নেতিবাচক। অরুণ শৌরির নামটি উল্লেখ না করলেও অন্যায় হবে অরুণ এবং বিনোদ, দু’জনের প্রতিই। আর, আত্মজীবনীতে আক্রমণ করার জন্য অনেকেই বাবুরাম সাপুড়ের দিয়ে যাওয়া সাপ বেছে নেন। বিনোদ এই কাজটা করেননি। এই বইয়ে তিনি এমন অনেকের সম্বন্ধে এমন অনেক কথা বলেছেন, যেগুলো খুব সহজে ছাড় না-ও পেতে পারে। বরখা দত্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতির জেরে তিনি যে এন ডি টি ভি-র দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ নির্বাসিত, বিনোদ সে কথা পরিষ্কার করেই লিখেছেন। অন্য দিকে, তাঁর বি জে পি-র প্রতি প্রকট বিতৃষ্ণা পড়তে আরাম লাগে।
অন্য লোকের ভুল, দুর্বলতা সম্বন্ধে চারটি খারাপ কথা বলে ফেলা যতখানি সহজ, নিজের ভুল সম্বন্ধে একই রকম সংকোচহীন ভাবে বলা ততখানি সহজ নয়। বিনোদ তাঁর কতগুলো ভুলের কথা একান্তই চেপে গিয়েছেন, বলতে পারব না তাঁর জীবন সম্বন্ধে আমি এই বইয়ের বাইরে বিশেষ কিছু জানি না। কিন্তু, যে ক’টা ভুলের কথা বলেছেন, সেগুলো নির্দয় ভাবে বলেছেন। বাকি ভুলগুলোর কথা থাক, একটা ব্যক্তিগত ভুলের কথা বলি। তাঁর বিলেতবাসের সময় বহু মেয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। শারীরিক ভাবেও। তার মধ্যে একটি মেয়ে, বিনোদ যাঁর নাম উল্লেখ করেননি, ছিলেন সুইটজারল্যান্ডের বাসিন্দা, ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। বিনোদ তাঁকে গর্ভপাত করানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু, গর্ভপাত তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপন্থী। মেয়েটি রাজি হন না। বিনোদ জানিয়ে দেন, তাঁর এবং সম্ভাব্য সন্তানের কোনও দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। মেয়েটি তাঁর দেশে ফিরে যান। সেখানেই সন্তান জন্মায়। একটি ফুটফুটে মেয়ে। তার একটি ছবি পান বিনোদ। আর কিছু নয়। কখনও সেই সন্তানকে দেখতেও পাননি তিনি। ‘আমি জীবনে এই এক বারই সম্পূর্ণ শয়তানের মতো আচরণ করেছিলাম।... আমার দু’টো বিয়ে, কিন্তু কোনওটিতেই আমার কোনও সন্তান হয়নি। আর, আমার একমাত্র সন্তানকে আমি কখনও দেখতেই পেলাম না।... হয়তো আমার ভুলেরই শাস্তি।’
বইটার একটা মস্ত গুণ বিনোদের সেন্স অব হিউমার। আর দোষ গোটাকয়েক। যেমন, বইটির শেষ অংশে তিনি হবু সাংবাদিকদের জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। অপ্রয়োজনীয় জ্ঞান। তাঁর গোটা জীবনী পড়ে এই কথাগুলো যদি কেউ উদ্ধার করতে না পারে, এমনিতেই তার সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা নেই। কাজেই, তেমন লোকদের নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলত। বইটির দ্বিতীয়ার্ধের গতি অপেক্ষাকৃত ভাবে কম। দোষটি তাঁর, নাকি বইটির সম্পাদকের, ভেবে দেখা দরকার।
শেষে একটা কথা না বললেই নয়। বইয়ের মধ্যে যে ছবিগুলি রয়েছে, তার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছবিতে বিনোদকে কোনও রাষ্ট্রনায়ক বা কোনও নামকরা লোকের সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে। যে মানুষটি দীর্ঘ চার দশক বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁর সঙ্গে সনিয়া গাঁধী থেকে বারাক ওবামা অনেকেরই পরিচয়, হৃদ্যতা, সখ্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু, গোটা বই জুড়ে বিনোদ নিজের যে ভাবমূর্তি তৈরি করলেন, অর্থাৎ তিনি অহেতুক ভক্তির বশবর্তী নন, ক্ষমতাকে তোয়াক্কা না করেই চলেন সেই ভাবমূর্তিটি এই ছবিগুলোতে বেশ ধাক্কা খেল। |
|
|
|
|
|