শনিবারের নিবন্ধ
হীরক রানির দেশে
র্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওঁর তিনটে জিনিস আজও রয়ে গেছে অবিকল একই রকমডিগনিটি, সেন্স অফ ডিউটি আর হেয়ারস্টাইল!
কথাগুলো ধার করা। হেলেন মিরেনের কাছ থেকে। বছর পাঁচেক আগে ‘দ্য কুইন’ ছবিতে রানি এলিজাবেথের ভূমিকায় অভিনয় করে এই ডাকসাইটে অভিনেত্রী যখন অস্কার পেলেন, সে বারই অ্যাকসেপ্ট্যান্স স্পিচে রানিকে কুর্নিশ জানিয়ে বলা ওপরের কথাগুলো। ইংল্যান্ডেশ্বরীর জীবনকে একটা ক্যানভাসে ধরার জন্য একেবারে মোক্ষম।
ঠিক ১০ বছর আগে যখন এই রানির রাজ্যপাটে এসে থিতু হলাম, সে বছরই ছিল তাঁর অভিষেকের ৫০ বছর পূর্তি। সত্যি বলতে কী, শহর জুড়ে দেদার ফুর্তি আর বাড়তি একটা ছুটির দিন ছাড়া সে উৎসবের আলাদা মাহাত্ম্য খুঁজে পাইনি। কিন্তু এর পর টেমসে যত জল গড়িয়েছে, টের পেয়েছি কী ভাবে ব্রিটিশ জীবনচর্চায় ওতপ্রোত ভাবে সেঁটে আছেন রানিআর কেনই বা ট্র্যাডিশনবিলাসী একটা জাতির বুকের ভেতরে তাঁর পাকাপাকি রিজার্ভেশন! এবং এই ভদ্রমহিলা শুধু সকলের প্রাণপ্রিয় ডায়ানার খিটখিটে ভিলেনমার্কা শাশুড়িই ননতাঁর প্রোফাইলে অনেকগুলো শেড, ঠিক মাথার ঝলমলে মুকুটটার মতোই।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ব্যাপারটা অনেকেরই ঘোর অপছন্দকিন্তু এই রানিকে খুব খারাপ লাগাটাও বোধহয় কঠিন। আর গত ৬০ বছর ধরে নিখুঁত আভিজাত্যে, অননুকরণীয় বনেদিয়ানায় তিনি যে ভাবে গোটা কমনওয়েলথ আর বাকি বিশ্বে ব্রিটেনের মুখ হয়ে দেখা দিয়েছেন, তাতে রানিকে ছাড়া ব্রিটেন আর মেসিকে ছাড়া বাসের্লোনা একই কথা। চার্চিল থেকে ক্যামেরনদেশে ডজনখানেক প্রধানমন্ত্রী গেছেন-এসেছেন, ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়েছে আর্থিক বুম আর রিসেশন, ইংল্যান্ড নিজের দেশে ’৬৬-তে বিশ্বকাপ জিতেছে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলতে গিয়ে ল্যাজে-গোবরে হয়েছেশুধু বাকিংহাম প্যালেসের মালকিনের বদল নেই।
১৯৫৩: রানির মহিমায়
এ জন্যই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটেনের একটা শৌখিন অভ্যেস আর অস্ফুট গর্বের মতো। তাঁর ঠাটবাট, বিলাসব্যসনে করদাতাদের খরচ আছে। তাই নিয়ে অনুযোগও বিস্তরকিন্তু এই রানির টানেই যে লক্ষ লক্ষ পর্যটক প্রতি বছর বিলেতমুখো হচ্ছেন বা উইন্ডসর ক্যাসলে গিয়ে পকেট খালি করছেন, সেটা অস্বীকার করা যায় কি?
আর এ তো এক-আধ বছরের মামলা নয়, কবে থেকেই রানি এলিজাবেথ এই দায়িত্ব সামলে আসছেন! ১৯৫২-তে কেনিয়ায় বসে বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলেন। আর ২৫ বছরের তরুণীকে দুম করে বসে পড়তে হল ব্রিটেনের রাজ-সিংহাসনে। সেটা ’৫২-র ফেব্রুয়ারি। দিল্লিতে পণ্ডিত নেহরু তখনও ভোটে জিতে নিজের প্রথম ক্যাবিনেট গড়েননি, বসুশ্রীতে মুক্তি পায়নি উত্তমকুমারের প্রথম হিট ‘বসু-পরিবার’, এমনকী লর্ডস টেস্টে সেঞ্চুরি আর ইংনিসে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভিনু মানকড়ের দু’টো অনার্স বোর্ডেই নাম তোলা সেটাও আরও কয়েক মাস পরের কথা। সে বছরই অক্টোবরে মুক্তি পেল চার্লি চ্যাপলিনের ‘লাইমলাইট’। আর অনেকে যাঁকে ইদানীং ভারতে রানির কাউন্টারপার্ট বলে মনে করেন, সেই সনিয়া গাঁধীও তখন নেহাত ছ’বছরের বাচ্চা মেয়ে ইতালির লুসিয়ানা গাঁয়ে সবে হয়তো ফ্রক দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন।
এত লম্বা একটা চান্সলেস ইনিংস খেলার পরও রানি দিব্যি নট আউট। এবং হেলেন মিরেন যেমনটা বলেছেন, মর্যাদাটা মারাত্মক, কর্তব্যবোধ প্রখর আর কেশবিন্যাসেও কনসিস্টেন্ট, তা এমন রানির হীরকজয়ন্তীর হুল্লোড়ে গা তো ভাসবেই!
স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে
উৎসবের আদ্যোপান্ত

আসছে জুলাইতে লন্ডনে অলিম্পিককে ঘিরে শহরে এখন থেকেই বিয়েবাড়ির পরিবেশ। কিন্তু মেয়র কথা দিয়েছেন, রানির ডায়মন্ড জুবিলি মোচ্ছব অলিম্পিককেও টেক্কা দেবে। লোকে নাকি নাতি-নাতনিকেও গপ্পো করে বলতে পারবে, এমন ফাটাফাটি পার্টি আর আতসবাজির ফোয়ারা হবে। উৎসব শুরু ২ জুন থেকে, আর টেনে লম্বা করা চার দিনের উইকএন্ড জুড়ে চলবে রাজকীয় ধুন্ধুমার।
টেমসের বুকেই যেমন পাড়ি দেবে হাজার নৌকার সুসজ্জিত বহরএমন বর্ণাঢ্য ফ্লোটিলা আর রাজসিক জলযাত্রা পৃথিবীতে চোখে পড়েনি বহু বহু যুগ। রাস্তা জুড়ে খানাপিনা আর ফুর্তির ব্রিটিশ সংস্করণ হল স্ট্রিট পার্টি। আর সে রকম অগুন্তি পার্টি চলবে সারা দেশ জুড়ে। ঘোড়ার প্রতি রানির ভালবাসার কথা কে না জানে! তাঁর সেই ঘোড়ারোগকে সম্মান জানাতে উইন্ডসর ক্যাসলের উঠোনে তে-রাত্তির ধরে চলবে অশ্বারোহীদের কসরত। সঙ্গে দুনিয়ার নানা প্রান্তের নাচাগানা। স্কটিশ ব্যাগপাইপার থেকে পঞ্চনদের ভাংড়ারানির সে দরবারে আমন্ত্রণ সবারই!
স্মরণকালের মধ্যে এই বিপুল আনন্দযজ্ঞের আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ঠিক ১১৫ বছর আগে এই লন্ডনেই মহারানি ভিক্টোরিয়ার অভিষেকের ৬০ বছর পূর্তি উৎসবের তুলনাটা মনে আসতে বাধ্য! ১৮৯৭-এ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সত্যিই সূর্যাস্ত হত না। ভিক্টোরিয়া ছিলেন ৩০ কোটি প্রজার রানি (যার আবার দুই-তৃতীয়াংশই ভারতে) আর ব্রিটেন ছিল তার শৌর্য ও পরাক্রমের শীর্ষে। সেই তুলনায় আজ রানি এলিজাবেথের জমিদারি হয়তো নেহাতই ছবি বিশ্বাসের ‘জলসাঘর’। তবু তুলনা যদি করতেই হয়, একমাত্র ভিক্টোরিয়াই লড়াইয়ে আসবেন।
ছেলে চার্লস আর প্রাক্তন পুত্রবধূ ডায়নার সঙ্গে
মাস কয়েক বাদে লন্ডন যখন হীরকজয়ন্তী নিয়ে মাতবে, তখন হাজার হাজার মাইল দূরে কলকাতায় কেউ কাউকে হয়তো এক মুঠো বুলবুলভাজাও সাধবে না (হরিদাসের বানানো এই অমৃত মহারানি ভিক্টোরিয়া প্রায়ই কিনে খেতেন)। ঐতিহাসিকেরা জানাচ্ছেন, ১৮৯৭-এ ভিক্টোরিয়ার পার্টি থেকে কলকাতা বাদ পড়েনি। তখনকার অবিভক্ত ভারতের রাজধানীতে পাঁচ হাজার কাঙালি পেট পুরে ভালমন্দ খেয়েছিল। আর গোটা ভারতে ১৯ হাজার বন্দিকে ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী।
গবেষক লরেন্স জেমস সম্প্রতি লিখেছেন, ভিক্টোরিয়ার হীরকজয়ন্তী উৎসবে একটা বড় আকর্ষণ ছিল বেঙ্গল ল্যান্সার্সভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনী। ঝলমলে সবুজ-সোনালি-লাল-নীল টিউনিক আর ততোধিক উজ্জ্বল রংয়ের পাগড়ি পরে দৃপ্ত ভঙ্গিতে লন্ডনের রাস্তা দিয়ে তাঁরা সে দিন যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন, মানুষ না-তাকিয়ে পারেনি। লাডগেট সার্কাসের কাছে এক জন দর্শক নাকি ‘থ্রি চিয়ার্স ফর ইন্ডিয়া’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। উপস্থিত জনতা সমস্বরে তাতে গলা মেলায়।
১১৫ বছর পর যখন রানি এলিজাবেথ সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের থ্যাংকস গিভিং সার্ভিসে যোগ দিতে যাবেন, সেই শোভাযাত্রায় ভারতের নামে নিশ্চয় কেউ জয়ধ্বনি দেবে না। আর বোধহয় প্রয়োজনও নেই। একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ ভারত এখন চিকেন টিক্কা আর ইমিগ্রান্টদের বেশে ব্রিটেনকেই গিলে খেতে উদ্যত। কিন্তু এই কঠিন সময়েও খাঁটি ব্রিটিশ ঐতিহ্য-সহবত আর মূল্যবোধের জলজ্যান্ত প্রতীক হয়ে রয়েছেন রানি এলিজাবেথ। সাধে কি ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ সাইমন হেফার লিখেছেন, ৬০ বছর ধরে রাজনীতিকরা তাঁকে যতই খাটো করার চেষ্টা করুন, আজও ব্রিটেনের সব চেয়ে দামি সম্পদ রানি!
নাতি আর নাত বৌ: উইলিয়াম আর ক্যাথেরিন
যুবরাজের যন্ত্রণা

কিন্তু উৎসবের এই ঘোর-লাগা আমেজেও রানিকে ঘিরে একটা তিরতিরে খচখচানি রয়েই যায়...কবে ছাড়বেন রানি? প্রশ্নটা বেশি করে উঁকি দেয় প্রিন্স চালর্সকে দেখলেই। কারণ, যুবরাজের চুল পাতলা হতে হতে এখন মাথাজোড়া টাক। কিন্তু ছেলের জন্য মা সিংহাসন ছেড়ে দেবেন, এমন আভাস তো দূরতম কল্পনাতেও নেই।
ব্রিটেনের সিংহাসনে লম্বা সময় ধরে রাজত্ব করার রেকর্ড যাঁদের, সেই তৃতীয় এডওয়ার্ড (৫০ বছর), তৃতীয় হেনরি (৫৬ বছর) কিংবা তৃতীয় জর্জ (৫৯ বছর)-কে এর মধ্যেই পিছনে ফেলেছেন এই রানি। সামনে এখন শুধু ভিক্টোরিয়া। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে রানি যদি ২০১৫-র সেপ্টেম্বর অবধি সিংহাসনে টিঁকে যান, তা হলে ভিক্টোরিয়ার রেকর্ডও চুরমার হয়ে যাবে।
কিন্তু এই সব শুকনো পরিসংখ্যানে প্রিন্স চার্লসের আদৌ কি কিছু আসে-যায়? মেঘে মেঘে ৬৪ হতে চলল। অনেকেরই বিশ্বাস, রাজা হওয়ার আগ্রহটাই হারিয়ে ফেলেছেন এই প্রৌঢ় রাজকুমার। ডায়ানার সঙ্গে অস্থির দাম্পত্যের ঝড়ঝাপ্টা সামলে এখন দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যামিলাকে নিয়ে থিতুকয়েক গণ্ডা চ্যারিটি আর নিজের প্রিন্সেস ট্রাস্ট নিয়েই দিব্যি আছেন তিনি।

পুনশ্চ

রানি এলিজাবেথের ডায়েরি লেখার অভ্যেস অনেক দিনের। যখন ১৯ বছরের উচ্ছল কিশোরী, সেই ১৯৪৫-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ভি ই ডে-র প্যারেডের পর রাতভর পার্টি করেছিলেন। রাজকুমারীর ডায়েরিতে লেখা ছিল, ‘ট্রাফালগার স্কোয়ার, পিকাডেলি, প্যাল ম্যালউফ, মাইলের পর মাইল হাঁটা। রাত সাড়ে ১২টায় ব্যালকনিতে এক বার বাবা-মাকে দেখলামখেলাম, দেদার পার্টি করলাম। বিছানায় যেতে যেতে সেই রাত তিনটে!’
সেই ঐতিহাসিক পার্টির ৬৭ বছর পর ব্রিটেনের এক লম্বা সামার উইকএন্ডে রানির আপামর প্রজাকুলের রুটিনটা অন্য রকম হবেভাবার কোনও কারণ নেই!
গড সেভ দ্য কুইন!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.