পূর্ব কলকাতা
সংযুক্ত এলাকা
‘ফাঁকি’র নির্মাণ
হাজার পাঁচেক মানুষের পুনর্বাসনের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছিল পরিকাঠামো। অথচ, বর্তমানে সেই জনসংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। ফলে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে লিজ চুক্তিতে পাওয়া জমিতে একতলা বাড়ি ভেঙে দোতলা থেকে চারতলা বাড়ি তৈরি হয়ে চলেছে। অথচ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ি সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুর-অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। ওয়ার্ড কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক স্থানীয় কাউন্সিলর এই নির্মাণের বিরুদ্ধে পুরসভায় লিখিত অভিযোগ করেছেন। পুরকর্তৃপক্ষ অবশ্য ঘটনাটি নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বিধাননগর পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সুকান্তনগর এলাকায় এই সমস্যায় জেরবার বাসিন্দারা। পাশাপাশি, সংযুক্ত এলাকার ১, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলররাও এ ধরনের ‘বেআইনি নির্মাণ’ নিয়ে পুরকর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন তৈরির সময়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের পুনর্বাসন হয়েছিল সুকান্তনগরে। লিজ চুক্তিতে মাথাপিছু কম-বেশি সওয়া এক কাঠা করে জমিতে একতলা বাড়ি পেয়েছিলেন বাসিন্দারা। সেই অনুযায়ী নিকাশি ও পয়ঃপ্রণালীও তৈরি হয়। সাতশোরও বেশি প্লট বিলি করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার মানুষের বসবাসের কথা ভেবে পরিকাঠামো তৈরি হয়।
সংযুক্ত এলাকার অন্যত্র অবশ্য সমস্যা ভিন্ন। সেখানে আবার জমি সংক্রান্ত সম্পূর্ণ তথ্যই নেই বলে দাবি বিধাননগর পুরপ্রশাসনের। তাদের দাবি, সংযুক্ত এলাকায় অনেক ফাঁকা জমি আছে। সেখানে দিনের পর দিন বাড়ি তৈরি হয়ে চলেছে। কিন্তু অনুমোদন নেই। ফলে তথ্য যোগাড়ে মহকুমা থেকে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সুকান্তনগরের চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে কোনও অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে পুরপ্রশাসন।
সংযুক্ত এলাকাগুলি রাজারহাট ও ভাঙর বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় ছিল। ১৯৯৫-তে বিধাননগর পুরসভার আওতায় আসে। কিন্তু ‘বেআইনি নির্মাণ’ যদি আদৌ হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রশাসন যেমন দায় এড়াতে পারে না, তেমনই বাসিন্দারাও কি শুধু প্রশাসনের ঘাড়ে দায় চাপাতে পারেন?
প্রকাশ্যে মুখ খুলতে ভীত বাসিন্দারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেউ কেউ অবশ্য বলেন, “নিয়ম জানা নেই।” আবার অনেকের দাবি, বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা খুব সন্তোষজনক নয়। ফলে প্রোমোটারদের দিয়ে দিলে নিজস্ব আয়ও বাড়ে। ফলে প্রথমে অনেকেই আপত্তি করেনি। পাশাপাশি, এলাকায় বেকার যুবকদেরও কর্মসংস্থান হয়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অনুমোদন ছাড়াই দীর্ঘ দিন ধরে কী ভাবে এই ‘বেআইনি নির্মাণ’ সম্ভব হল? বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবেই কোনও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ১৫ বছরের বাম পুরবোর্ড কিংবা দেড় বছর পার করা তৃণমূল পুরবোর্ড, উভয়ের ক্ষেত্রেই তা সত্য। অভিযোগের জবাবে বিধাননগর টাউন তৃণমূলের সভাপতি তথা পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত বলেন, “আমাদের কাছে এলাকার জমি সংক্রান্ত তথ্য নেই। আগের বামপুরবোর্ড সে সব কিছুই রেখে যায়নি। যে কারণে জেলা-মহকুমা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ফলে পদক্ষেপ করতে সময় লাগছে।”
দীর্ঘ ১৫ বছর বিধাননগর পুরসভায় ক্ষমতায় ছিলেন বামেরা। তাঁরা কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেননি? অভিযোগের জবাবে সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দী বলেন, “বাম আমলেই সুকান্তনগরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছিল। আর্থিক দিক দিয়ে কিছুটা উন্নতি হতে কেউ কেউ দোতলা করেছিলেন। সে সময় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এটা ঠিক। এখন পুরোপুরি প্রোমোটারদের কব্জায়।”
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিপিএমের কল্পনা মুখোপাধ্যায় বলেন, “আগেও অভিযোগ জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। মাত্র দেড় কাঠা জমিতে চার তলা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলেই জানি। এই ধরনের নির্মাণ বন্ধ করার জন্য প্রচারও করা হয়েছিল।”
স্থানীয় তৃণমূলকর্মী তথা আইনজীবী অরুণ চৌধুরীর কথায়: “এ ভাবে বাড়ি তৈরি হতে থাকলে আর কিছু দিনের মধ্যেই এলাকার পরিকাঠামো ভেঙে পড়বে।
অবশ্য যাঁরা বাড়ি তৈরি করছেন তাঁদের একাংশের যুক্তি, পুরসভা কোনও কর নেয় না। ফলে প্ল্যান জমা করলেও তা অনুমোদন পায় না। স্থানীয় ওয়ার্ড অফিসে জমা করলে তারাই দোতলা কিংবা তিন তলা হবে কি না তা বলে দেয়। যদিও স্থানীয় কাউন্সিলর এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিধাননগর পুরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান পারিষদ অনুপম দত্ত বলেন, “লিজ চুক্তিতে পাঁচ হাজার লোকের পুনর্বাসন হয়েছিল সুকান্তনগরে। সেখানে এই ভাবে অনুমোদন ছাড়া বাড়ি বানানোয় নিকাশির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। কিন্তু নির্মাণ সংক্রান্ত কোনও অনুমোদন পুরসভার কাছে নেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে তদন্তের জন্য এগজিকিউটিভ অফিসারকে বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” পুরসভার এগজিকিউটিভ অফিসার মলয় মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “ বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.