|
|
|
|
ফুটবলে অনীহা কেন? চিন্তিত আরামবাগের ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ |
পীযূষ নন্দী • কলকাতা |
ফুটবলের হৃতগৌরব নিয়ে চিন্তিত আরামবাগ মহকুমার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। হুগলির এই মহকুমা থেকে বিভিন্ন সময়ে কলকাতার এ ডিভিশনে খেলেছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রশাসনিক স্তরে উৎসাহ কম। ক্লাবগুলিও কেবল চাঁদা তুলে পুজো ছাড়া খেলাধূলায় আর তেমন উৎসাহী নয়। ফলে, একের পর এক ক্লাব গঠন হয়ে চললেও ফুটবলের দিক থেকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছে এই অঞ্চল।
ফুটবলে এই মহকুমার অতীত গৌরব কেমন?
রাধানগর আনন্দময়ী স্পোটির্ং ক্লাবের সহ সভাপতি অসীম মিত্রের মুখে শোনা গেল সে কথা। জানালেন, ভারতবর্ষে ফুটবল খেলার প্রচলনে যাঁদের অবদান ছিল সর্বাধিক, তাঁদের অন্যতম নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারীর বাড়ি রাধানগর গ্রামে। মোহনবাগান ক্লাবের প্রথম সভাপতি এই গ্রামেরই ভূপেন্দ্রনাথ বসু। ওই ক্লাবের প্রথম সম্পাদক যতীন্দ্রনাথ বসুও এই এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই সারা মহকুমা জুড়ে ফুটবল খেলায় কার্যত জোয়ার আসে। কলকাতার বড় ক্লাবগুলিতে এই মহকুমার ছেলেরা এক সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছে।
আরামবাগ মহকুমার ছ’টি ব্লক যুব দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি নথিভুক্ত এবং অনথিভুক্ত ক্লাবের সংখ্যা এই মহকুমায় প্রায় তেরোশো। এর মধ্যে ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত মাত্র ১০১২টি। নিয়মিত ফুটবল চর্চা হয় গোটা ৫-৬ ক্লাবে। খানাকুলের রাধানগর গ্রামে ১৯২৩ সালে স্থাপিত হয়েছিল আনন্দময়ী স্পোটির্ং ক্লাব। সহ সভাপতি অসীমবাবুর বক্তব্য, অভিভাবকদের উদাসীনতা এই পরিস্থিতির মূল কারণ। পড়ুয়াদের স্কুল ও প্রাইভেট টিউটরের চাপে বেঁধে রাখা হচ্ছে। পাঠ্য বিষয় ছাড়াও নাচ-গান-ছবি আঁকা, তবলা সবেতেই বাবা-মায়েদের উৎসাহ। সময় পেলে তারা ক্রিকেটের দিকেই ঠেলে দিতে চাইছেন ছেলেদের। আর যে সব তরুণ পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত নয়, তারাও আর্থিক কারণে একশো দিনের কাজ বা অন্য কোনও দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আরামবাগের চকহাজি গ্রামের নজরুল স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি তথা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুন্সি হবিবুর রহমানের মতে, স্কুলগুলিতে ফুটবল নিয়ে উৎসাহদানের ব্যবস্থা নেই। ক্লাবগুলিকে প্রশাসন বা স্থানীয় স্তরে সহায়তা করা হয় না। মাঠেরও অসুবিধা আছে। এ সব কারণেই ফুটবল নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে না।
কলকাতার এ ডিভিশনের প্রাক্তন ফুটবলার তথা আরামবাগের বিদ্যুৎ অ্যাথলেটিক ক্লাবের কর্মকর্তা নয়ন তরফদার জানান, মাঠে এখন ছেলেই পাওয়া ভার। ১৯৭০ সাল থেকে এই ক্লাবে ১৯৮৭-৮৮ সাল পর্যন্ত অনেক ভাল ফুটবলার তৈরি করা গিয়েছে। কিন্তু ইদানীং উৎসাহে ভাটা পড়েছে তরুণ প্রজন্মের। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের ডেকে এনে কোনও মতে খেলাধূলা চালানো হয়। প্রশাসন অবশ্য ফুটবলের উন্নতিতে পদক্ষেপ করছে বলে তাঁর মত। ফুটবলের এই দৈন্যদশা কাটাতে স্কুল-স্তরে উৎসাহ দান দরকার বলে মনে করেন এ ডিভিশনের প্রাক্তন খেলোয়াড় পুড়শুড়ার স্বপন পাল, খানাকুলের অনিল রায়-সহ অরূপ কুঁড়, বিমল চৌধুরী, বিশ্বজিৎ পালেরা। একই মত এ ডিভিশনের প্রাক্তন আরও কিছু খেলোয়াড় সুকুমার মিত্র, প্রবীর রায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বের।
সম্প্রতি ফুটবলের এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ করছে মহকুমা প্রশাসন। মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শুভঙ্কর সরকারের বিশেষ উদ্যোগে আন্তঃ বিদ্যালয় নক আউট ফুটবল চালু হয়েছে গত বছর অগস্ট মাসে। তাতে মহকুমার ৫৫টি বিদ্যালয় যোগ দেয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা যে দীর্ঘমেয়াদী নয়, সে কথা স্বীকার করে শুভঙ্করবাবু বলেন, “কোনও একটি মহকুমার এক-দু’জন প্রশাসকের পক্ষে এ ধরনের কাজ দু’এক বারই করা সম্ভব। ফুটবলের উন্নতিতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী সদিচ্ছা জরুরি।” খেলাধূলার উন্নতির লক্ষে বেশ কিছু সুপারিশ করে তিনি সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী খেলাধূলার উন্নতির লক্ষে রাজ্যের প্রায় ৮০০ ক্লাবকে ২ লক্ষ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। ওই তালিকায় আছে রাধানগর আনন্দময়ী স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগের বিদ্যুৎ অ্যাথেলেটিক ক্লাব।
খেলাধূলার উন্নতির লক্ষে ব্লক-পিছু একটি করে যুব দফতর আছে। সেই আধিকারিকেরা কী বলছেন?
খানাকুলের দু’টি ব্লকের আধিকারিক শেখর কোলে (শ্রীরামপুর এবং বৈদ্যবাটিরও দায়িত্বে), পুড়শুড়া এবং গোঘাটের দু’টি ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোপাল দে এবং আরামবাগ ব্লক ও পুর এলাকার আধিকারিক প্রদীপ মণ্ডলদের বক্তব্য, “আমাদের একক চেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের উদ্যোগ দরকার। বিভিন্ন ব্লককে আমরা খেলাধূলার সরঞ্জাম দিচ্ছি। কিন্তু তাতেও ছেলেদের উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।” শেখরবাবু আবার বলেন, “আমি আরামবাগে পড়াশোনা করেছি। নিজে ফুটবল খেলতাম। স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরে আগে খেলার মাঠে ছুটতাম। এখন সে পরিবেশ নেই। আমি অভিভাবকদের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলেছি। বলেছি, ছেলেকে মাঠে ছাড়ুন। ফুটবল খেলার মধ্যে দিয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলাবোধ, শরীর চর্চা, মানসিক তৎপরতা, ধৈর্য, পরিশ্রম করার ক্ষমতা বাড়ে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।” |
|
|
|
|
|