তরণীমোহন দত্তমজুমদারের চার ছেলে, এক মেয়ে। প্রত্যেকেরই জন্মের সাল-তারিখ-বার তাঁর নখদর্পণে। কিন্তু কোনও দিন কারও জন্মদিন পালন করেননি। কিন্তু আজ তাঁর সন্তানেরা ঘটা করেই বাবার জন্মদিন পালন করলেন। বেলুনে সাজিয়ে তোলা বিশাল হলঘরে বসল গান-বাজনার আসর। ছিল সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার অনুষ্ঠানও। আনন্দের এই আসরে হাজির ছিলেন আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্যও।
এমনটা হবে না-ই বা কেন, একশো বছর বেঁচে থাকা কি আর চাট্টিখানি কথা! তরণীবাবু চলাফেরার জন্য কারও ওপর নির্ভরশীল নন। পিঠ টান করে বসেন। ঘাড় থেকে কোমর একেবারে সোজা। কথাবার্তায় সামান্য জড়তাও নেই। চশমা ছাড়াই পত্রপত্রিকা, বই পড়েন নিয়মিত।
শতায়ু তরণীমোহন।
ছবি: হিমাংশু দে |
একশো বছর পার করার রহস্যটা কী? চিরতরুণ তরণীবাবু বললেন, ‘‘রুটিন মেনে চলেছি সারা জীবন। শীত-গ্রীষ্ম, যৌবন-বার্ধক্যঘুম থেকে উঠি ভোর চারটেয়। এর পর প্রাতঃভ্রমণ। ফিরে এসে ব্যায়াম। শরীর রক্ষায় ব্যায়াম জরুরি। নিয়ম মেনে শরীরচর্চা করি এখনও। বিকেলে পায়চারিও নিয়মিত। খাওয়াদাওয়া ঘড়ি ধরে।” দিনের ঘুম নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতপার্থক্য থাকলেও শতবর্ষের অভিজ্ঞতায় তাঁর পরামর্শ, “দিনে সামান্য ঘুমোবে। এতে পরমায়ু বাড়ে। আমিও ঘুমোই।”
রুটিন মেনে চলাকে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার বড় উপায় বলে মনে করেন তরণীবাবু। তাঁর যুক্তি, শতায়ু হওয়ার বড় কারণ নেশাসক্ত না হওয়া। একশো বছরে কোনও দিন সিগারেটে টান দেননি। মদ্যপান দূরে থাক, চায়ের কাপ পর্যন্ত ঠোঁটে ঠেকাননি।
কে এই তরণীমোহন দত্তমজুমদার? শতবর্ষে পা রাখলেন, এটুকুই কি তাঁর পরিচয়? বড় ছেলে অরুণ শিলচর জেলা কংগ্রেসের বর্তমান সভাপতি। যৌবনে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’বার জেল খেটেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন নেননি। তরণীবাবুর কথায়, “স্বাধীনতার জন্য কোথায় আর কী করলাম। যে টুকু করেছি, তা মোটেও পেনশনের আশায় নয়, আদর্শের জন্য।”
স্বাধীনতা পাওয়ার সাড়ে ছয় দশক পর কেমন অভিজ্ঞতা? আক্ষেপের সুর শতায়ু গলায়, “ইংরেজ শাসনে দুর্নীতির কথা ভাবাই যেত না। আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। সাধারণ মানুষ সরকারি সুযোগ-সুবিধের ছিটেফোঁটাও পান না!” তাঁর মনে হয়, আজ একান্ত দরকার নেতাজি সুভাষের মতো একজন বিপ্লবীর।
একশো বছর আগে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার ছয়সতী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তরণীবাবু। কানিংহাম সার্কুলার যখন বের হয়, তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়ুয়াদের বিপ্লবী দলে নাম লেখানো নিষিদ্ধ হওয়ায় স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক বছর পর ভর্তি হন সিলেট টেকনিক্যাল স্কুলে। তাঁতশিল্পের কোর্স সেরে শিলচর রামকৃষ্ণ মিশনে অবৈতনিক শিক্ষাদান করেন দু’বছর। পরে চাকরি পেয়ে যান ঢাকেশ্বরী কটন মিলে। সেখান থেকেই কারাবাস, পরে পাকাপাকি শিলচর চলে আসা। বইখাতার দোকান খুলে সংসারজীবন। ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত দোকানে গিয়েছেন। এখন ছেলেরাই সে সব সামলান। পত্রপত্রিকা, বই নিয়েই দিন কাটে তাঁর।
প্রকৃতপক্ষেই সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার রোলমডেল শতায়ু তরণীমোহন দত্তমজুমদার। |