পার্ক স্ট্রিট থানায় ধর্ষণের অভিযোগকারী মহিলার উপর যে ‘একটা কিছু হয়েছে’, তা বৃহস্পতিবারই জানিয়েছিল পুলিশ। ওই রাতে মহিলার যে বন্ধু তাঁকে বেহালার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁর কথাতেও পুলিশের ওই বক্তব্যের সমর্থন মিলল। ওই মহিলার বন্ধু ফারুখ হালিম শুক্রবার জানান, তিনি ওই রাতেই অভিযোগকারিণীর মুখে আঘাতের চিহ্ন দেখেছিলেন। তাঁর ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছিল। এই বক্তব্য তিনি পুলিশকেও জানিয়েছেন।
ফারুখ জানান, ওই মহিলা ও তাঁর পরিবারকে তিনি অনেক দিনই চেনেন। তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বও আছে। ফারুখ বিধানসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ হাসিম আব্দুল হালিমের ছেলে।
ওই রাতে কী দেখেছিলেন তিনি?
ফারুখ বলেন, “ও ট্যাক্সি নিয়ে আমার বাড়িতে আসে। মানসিক ও শারীরিকভাবে তখন ও বিধ্বস্ত ছিল। দেখলাম, ওর ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন। রক্তও বেরোচ্ছে। আমাকে ও ধর্ষণের কথা বলে।” মেডিক্যাল রিপোর্টেও মহিলার শরীরে কালশিটে দাগ মিলেছে। ফারুখের বয়ান, মহিলার উপর শারীরিক নিগ্রহের অভিযোগের সপক্ষে আরও একটি প্রমাণ দিয়েছে বলে এ দিন মনে করছেন তদন্তকারীরা।
ওই মহিলার অভিযোগ, ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে পার্ক স্ট্রিটের একটি নাইটক্লাব থেকে বেরোনোর পর তাঁকে গাড়িতে লিফট দেন পাঁচ যুবক। এর পরে গাড়ির ভিতরেই তাঁকে ধর্ষণ করেন শরাফত আলি নামে এক যুবক। পরে এক্সাইড মোড়ের কাছে ওই মহিলাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়।
এর পরে কী হয়েছিল? এ দিন ফারুখ জানান, ৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ তিনি একটি ফোন পান। ফোনে ওই মহিলা কান্নাকাটি করছিলেন। তাঁকে মারধর এবং ধর্ষণ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। ফারুখ তখন জানতে চান, ওই মহিলা কোথায় রয়েছেন। কিন্তু অভিযোগকারিণী তাঁকে জায়গার নাম বলতে পারেননি। ফারুখ বলেন, “ও বলল, একটা অন্ধকার জায়গা। ঠিক বুঝতে পারছি না।” এর পর ফারুখ তাঁকে বলেন, এলাকাটি কী, তা কোনও গাড়ি বা ট্যাক্সির চালককে জিজ্ঞাসা করতে। ফারুখের কথায়, “এর পর ও একটি ট্যাক্সি ধরে আমার বাড়ি চলে আসে।”
ধর্ষণের কথা জানতে পেরে বন্ধুকে কী বলেছিলেন ফারুখ? ফারুখ জানিয়েছেন, ঘটনার কথা শুনেই তিনি ওই মহিলাকে নিয়ে থানায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই মহিলা যেতে চাননি। তিনি ফারুখকে বলেন, তিনি বাড়িতে মায়ের কাছে যেতে চান। অনেক বার বলা সত্ত্বেও ওই মহিলা থানায় যেতে চাননি বলে ফারুখের দাবি। তিনি বলেন, “ও আতঙ্কগ্রস্ত দেখে আমি ওকে বেহালার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।” ফারুখ জানান, ঘটনার পর দিন, ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ফের ফোন করেন তাঁর বন্ধুকে। ফারুখের দাবি, তিনি ওই মহিলাকে ফের থানায় অভিযোগ জানাতে বলেন। এ-ও বলেন, তিনিও ওই মহিলার সঙ্গে থানায় গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাবেন। কিন্তু ঘটনা বলছে, এফআইআর করার সময় ফারুখ ছিলেন না। কেন?
ফারুখের কথা, ৬ ফেব্রুয়ারি ওই মহিলা তাঁকে প্রথমে থানায় যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কখন যাবেন, তা জানাননি। ফারুখের কথায়, “ঘণ্টা পাঁচ-ছয় পরে ফের আমি ফোন করি। কিন্তু তখন ও জানায়, থানায় যাওয়ার আগে বাবা এবং কাকার সঙ্গে কথা বলবে। এর পর থেকে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি।” ফারুখ জানিয়েছেন, তিনি বার বারই বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে জবানবন্দি দেবেন।
তা হলে ঘটনার পর পরই যে বন্ধুর সঙ্গে ওই মহিলার যোগাযোগ এবং দেখা হয়েছিল, তাঁকে তিনি অভিযোগ জানানোর জন্য সঙ্গে নিলেন না কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকী এফআইআর-এ ফারুখের সঙ্গে ওই রাতে তাঁর যোগাযোগের কথাও তিনি লেখেননি। কেন? এ প্রসঙ্গে স্টার আনন্দকে অভিযোগকারিণী জানান, ফারুখকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। ফারুখের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। এবং ফারুখ একটি রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তাই তিনি ফারুখকে প্রথমে জড়াতে চাননি। তাঁর কথায়, “ফারুখ অতীতেও আমাকে প্রয়োজনে সাহায্য করেছেন। অত রাতে ফোন করার পরেও উনি বারবার আমাকে ভরসা দিয়েছেন। সাহায্য করেছেন।”
বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা ফারুখ এবং অভিযোগকারিণীর মধ্যে টাকা লেনদেনের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। কেন সেই প্রশ্ন উঠল, তা বুঝতে পারছেন না ফারুখও। কী সেই টাকার লেনদেন?
ফারুখ বলেন, “বছর খানেক আগে ওই মহিলা এবং তাঁর বোন, দু’জনে একটি কল সেন্টার খোলার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি ওই ব্যবসার অংশীদার হতে চাইনি। কারণ, ওই ব্যবসায় আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।” তিনি জানান, এর পরে মহিলারা টাকার অভাবের কথা জানালে, তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরেই ওই টাকা ধার দেন। কিন্তু ব্যবসা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই দু’বোনের বনিবনা না হওয়ায় সংস্থা ছেড়ে দেন অভিযোগকারিণী মহিলা। সেই টাকাও ফেরত পাননি বলে ফারুখের দাবি। অভিযোগকারিণীও স্টার আনন্দকে জানান, ফারুখ তাঁকে বলেছিলেন, ছ’মাসের মধ্যে টাকা ফেরত পেলে ভাল হয়। না পেলেও ক্ষতি নেই। তিনি বোনের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন। জানুয়ারির শুরুতে এই টাকা নিয়ে বোনের সংস্থায় দাঁড়িয়ে দু’জনের কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তার পরে বোন তাঁকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে জানিয়েছেন, ওই দিন টাকা ফেরত দেবেন। তা পেলে তিনিও ফারুখকে টাকা দিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।
ফারুখকে নিয়ে যে ভাবে রাজনৈতিক জলঘোলা শুরু হয়েছে, তা নিয়ে শুক্রবার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সিপিএম। শুক্রবার সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “হালিমের ওই ছেলের সঙ্গে সিপিএমের কোনও সম্পর্ক নেই। কাগজে পড়েছি, হালিম জানিয়েছেন, তাঁর ছেলের বয়স ৪৫ বছর। সুতরাং ওই বয়সের কেউ যদি কিছু করেন, সেটা তাঁর নিজস্ব ব্যাপারে। তা ছাড়া হালিমের ছেলের নামে তো কোনও এফআইআর হয়নি! তিনি বেশি রাতে ওই মহিলাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন। ভাল কাজই করেছিলেন। তা হলে বিষয়টি নিয়ে এত কথার কী আছে? আর এ নিয়ে হালিমের নামই বা আসছে কেন?” |