ধর্ষিত হয়েছি, অনড় মহিলা
লাভির ‘নাম ভাঁড়িয়ে’ আলাপ করল কে, প্রশ্ন
পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের ঘটনাটি আদৌ ঘটেছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ কমিশনার বলেছেন, অভিযোগটি নিয়ে কোনও কোনও মহলে ইচ্ছে করে ভুল খবর রটানো হচ্ছে। এ সব সত্ত্বেও অভিযোগকারিণী নিজের অবস্থানেই অনড় রইলেন। শুক্রবারও সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বললেন, ধর্ষিতই হয়েছেন তিনি। বললেন, “আমি আমার বক্তব্য থেকে এক চুলও সরছি না। শরাফত আলির মুখটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ও-ই ধর্ষণ করেছিল।”
ওই মহিলার আগের বয়ানের সঙ্গে এ দিনের কথার কিছু তারতম্য যদিও রয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন, ঘটনার দিন লাভি গিদওয়ানির নাম ভাঁড়িয়ে অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিল, এমন সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। কিন্তু শরাফতের মুখটা তাঁর এতই ভাল করে মনে আছে, যে সেই মুখের বিবরণ দিয়ে স্কেচও আঁকাতে পারবেন তিনি।
অথচ শরাফত আলি এবং আজহার আলি নামে যে দুই যুবককে অভিযুক্ত সন্দেহে পুলিশ আটক করেছিল, তাঁরাও কিন্তু একই রকম জোর গলায় বলছেন যে, ওই রাতে অভিযোগকারিণীর সঙ্গে তাঁদের কোনও রকম সংস্রব ঘটেনি। গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের কথায়, “অভিযোগকারিণীকে অবিশ্বাস করছি না। গুরুত্ব দিয়ে ওঁর অভিযোগের তদন্ত করছি। কিন্তু যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরাও কিছু অপকর্ম করেছেন বলে এখনও প্রমাণ পাইনি। ওই দুই যুবকও জোর গলায় নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করছেন।”
এই ধোঁয়াশার মধ্যেই ধর্ষণের তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তা ‘সাজানো’ বলে মন্তব্য করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া সমালোচনা করেছে রাজ্যের বিরোধী-শিবির। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “কোনও মহিলা যদি ধর্ষণের অভিযোগ করেন, তা হলে সবার আগে তা নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া উচিত। তখন যদি দেখা যায় তিনি মিথ্যে কথা বলছেন, তা হলে তাঁর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তার আগে মুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশ কমিশনার এ ভাবে মহিলাকে দোষ দিতে পারেন না।” সেলিমের অভিযোগ, “ষড়যন্ত্রের কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনার তদন্ত প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের মন্তব্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থী।”
পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ ওই মহিলার অভিযোগকে গোড়ায় কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল, এ দিন সেই প্রশ্নও উঠেছে। পুলিশের একাংশ জানিয়েছে, ওই মহিলা যখন অভিযোগ করতে থানায় আসেন, তখনই তিনি গাড়ির মধ্যে কয়েক জন যুবকের উপস্থিতির কথা বলেছিলেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ওই যুবকদের মধ্যে এক জন তাঁকে ধর্ষণ করে। অন্যরা ধর্ষণ না করলেও বাধাও দেয়নি। এই ধরনের ঘটনাকে আইনের পরিভাষায় ‘গণধর্ষণ’-ই বলে। সে ক্ষেত্রে পুলিশের উচিত ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬(২)(জি) ধারায় গণধর্ষণের মামলা রুজু করা। কিন্তু পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ তা না করে শুধু ৩৭৬ ধারায় ধর্ষণের মামলা রুজু করে। গোয়েন্দাপ্রধানের অবশ্য বক্তব্য, “কোন ধারায় মামলা দায়ের করা হবে, তা চার্জশিট পেশ করার সময়ে চূড়ান্ত হবে। উপযুক্ত প্রমাণ মিললে তখন প্রয়োজনে গণধর্ষণের মামলা দেওয়া যেতে পারে।” ঘটনার দিনের কথা বলতে গিয়ে লাভি গিদওয়ানি প্রসঙ্গে অভিযোগকারিণী এ দিন যা বলেছেন, তা কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। ওই মহিলা বলেন, “এখনও আতঙ্কের মধ্যে আছি। কিন্তু পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে ওই রাতের কয়েকটি খুঁটিনাটি দিক আমার মনে পড়েছে। নাইটক্লাবটিতে আলো কম ছিল। তার মধ্যে এক যুবক এসে আমার সঙ্গে আলাপ করে। সে হাসতে হাসতে নিজের নাম বলে রহমান খান। পরে হাত মিলিয়ে বলে, ‘সরি, আমি লাভি গিদওয়ানি।’ পাশে দাঁড়িয়ে আজহার আলি তখন হাসছিল। কেউ যে আমায় মিথ্যে বলতে পারে, তা তখন আমার মাথায় আসেনি।” লাভি গিদওয়ানির (যিনি এখন কানাডায় রয়েছেন) নাম ভাঁড়িয়ে যদি কেউ তাঁর সঙ্গে আলাপ করে থাকে, তা হলে তিনি লাভি এবং তাঁর পরিবারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী বলেও জানিয়েছেন ওই মহিলা। একই সঙ্গে বলেছেন, “শরাফতকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছি। ওর চেহারাটা এখনও আমার চোখে ভাসছে। চাইলে ওর ছবি আঁকাতেও আমি সাহায্য করতে পারি। শরাফত প্রচণ্ড জোরে আমার পেটে ঘুষি মারার পরেই আমার নেশা কেটে গিয়েছিল। ওকে চিনতে আমার ভুল হবে না।”
তদন্তে এগোতে পুলিশের কাছে সূত্র বলতে আর রয়েছেন অম্বর আলি। কে তিনি? পুলিশ জানতে পেরেছে, অম্বর এক সময়ে লাভির কল সেন্টারে কাজ করতেন। কোনও বিরোধের জেরে অম্বর ওই চাকরি ছেড়ে দেন। পরে তিনি অভিযোগকারী মহিলার বোনের কল সেন্টারে যোগ দেন। এখন তিনি সেখানকারই ম্যানেজার। তদন্তে পুলিশ জেনেছে, সম্প্রতি এক বাদানুবাদের সময়ে অভিযোগকারিণীকে অম্বর ধাক্কাধাক্কিও করেছিলেন। ওই মহিলাও বলেছেন, “বোনের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটির সময়ে অম্বর এক বার আমায় ধাক্কা দিয়েছিল।”
কিন্তু অম্বরের সঙ্গে তদন্তের যোগসূত্র কোথায়? ওই মহিলা বলেন, “ধর্ষণের পরের দিন আমার ঠাকুমা জানতে চাইছিলেন, কারও সঙ্গে আমার শত্রুতা আছে কি না। তখনই অম্বরের কথা মনে পড়ে। এর পরে ফেসবুকে অম্বরের প্রোফাইল ঘাঁটতে গিয়ে তার বন্ধুদের মধ্যে এই তিন জনকে খুঁজে পাই।” অম্বরকে এ দিনও লালবাজারে জেরা করেছেন গোয়েন্দারা। ফোনে অম্বর বলেন, “আমার নাম এই ঘটনায় কেন উঠছে, বুঝতে পারছি না। আমার মা অসুস্থ। তিনি এ সব শুনলে সহ্য করতে পারবেন না।”
ইতিমধ্যে অভিযোগকারিণীকে সঙ্গে নিয়ে পার্ক স্ট্রিটের ওই পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে আশপাশের কয়েকটি অঞ্চলে গাড়ির ‘রুট’ ধরে ঘুরে অপরাধটি কী ভাবে ঘটেছে তা বোঝার চেষ্টা করেন তদন্তকারীরা। পার্ক স্ট্রিট থানার কাছ থেকে ঘটনার তদন্তভার নিয়েছে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজও কয়েক ধাপ এগিয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধান জানিয়েছেন, আজহারের ‘হন্ডা সিভিক’ গাড়িটির (যার ভিতরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ) থেকে ফরেন্সিক পরীক্ষার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন থাকছে, অভিযোগ ওঠার এত দিন পরে ফরেন্সিক পরীক্ষা হলেও তা আদৌ তদন্তে কতটা কাজে আসবে। এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দাপ্রধানের বক্তব্য, আজহার-শরাফতদের হদিস মেলার তিন দিনের মধ্যেই গাড়িটি বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। অভিযোগকারিণী একটি ফুলহাতা জ্যাকেটও এ দিন পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন। সাদার উপরে কালো স্ট্রাইপ আঁকা জ্যাকেটটায় রক্তের কিছু শুকনো দাগ। তারও ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে।
অভিযুক্ত দুই যুবকের ঘনিষ্ঠদের তরফে এ দিন পুলিশের কাছে একটি ভিডিও ফুটেজ পাঠানো হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কলিন স্ট্রিটে আজহারের বাড়িতে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন শরাফত। কিন্তু ওই সময়ে তাঁরা নাইটক্লাবে ছিলেন বলে অভিযোগকারিণীর দাবি। এই ফুটেজও যাচাই হচ্ছে। চেষ্টা চলছে নাইট ক্লাবের সিসিটিভির ফুটেজ উদ্ধারের।
এক দিকে চলছে পুলিশি তদন্ত। অথচ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানই ঘটনাটিকে বলেছেন ‘সাজানো’। সেই প্রসঙ্গ তুলতে অভিযোগকারিণী বললেন, “আমি এক জন মহিলা। উনিও এক জন মহিলা। এই কথাটা তো বানিয়ে বলা যায় না!”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.