গণপ্রহারে যত উৎসাহ, মুমূর্ষুকে সাহায্যে তত নয়
স্বর্ণময়ী বাজার থেকে খাগড়া বিবি সেন রোডের দূরত্ব প্রায় ৫ কিমি। ছ-দিনের ব্যবধানে সেখানে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষের উদাসীনতার দিকটিই প্রকট হয়ে উঠেছে।
এই শহরে চুরির অপবাদ দিয়ে বা সেই অভিযোগে একাধিকবার গণপ্রহার সম্প্রতি যেন নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। নিরীহ মানুষকে ‘শাস্তি’ দিতে কোথা থেকে যেন জুটে যেত বহু লোক। তারপরে কোনও একটা গাছে বা খুঁটিতে বেঁধে সেই ‘অপরাধী’র উপরে পড়ত নির্বিচারে চড়, কিল, লাথি। তখন আইন হাতে তুলে নেওয়া হত অবলীলায়। কিন্তু কোনও মুমূর্ষুকে সাহায্য করার সময় এই শহরই নানা অজুহাত দেখায়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি স্বর্ণময়ী বাজারের কাছে স্টেশন রোডের উপরে অনাথ পাল (৫২) নামে এক প্রৌঢ়কে গুরুতর জখম অবস্থায় প্রায় ঘন্টা খানেক পড়ে থাকতে হয়। পরে পুলিশ এসে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করলেও সময় মতো চিকিৎসা না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই প্রৌঢ় মারা যান। এর পরে ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কেউ এগিয়ে না আসায় জনবহুল ও ব্যস্ততম রাস্তা খাগড়া বিবি সেন রোডে মোটরবাইক চালিয়ে দু’জন দুষ্কৃতী রিকশার পথ আগলে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ছিনতাই করে পালায় মোটা অঙ্কের নগদ টাকা ও কয়েক কিলো ওজনের রুপো। তেমনই বুধবার বহরমপুর নিউ জেনারেল হাসপাতালের বিশ্রামাগারে এক বৃদ্ধার মৃতদেহ চার ঘন্টা পড়ে রইল।
সাম্প্রতিক ওই তিনটি ঘটনা থেকে বহরমপুর শহরের মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “আমার শহর বহরমপুরের কোথাও চরিত্রগত বদল ঘটেছে। পুরনাগরিকদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই পরিবার ভেঙেছে। পাশাপাশি আলগা হয়েছে মানুষের সম্পর্কও। একা এবং নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার কারণেই মানুষের মধ্যে এই ধরনের উদাসনীতা কাজ করছে।” বহরমপুর গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্বের শিক্ষিকা রত্নাবলী বিশ্বাস অবশ্য বলেন, “সমষ্টির চিন্তা কমে গিয়ে এখন মানুষ বড় বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রীক। পারিপার্শ্বিক সব কিছু জটিলতা থেকে এখন মানুষ নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেও অভ্যস্ত। ফলে স্বর্ণময়ী বাজারের ঘটনায় কাউকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতে দেখছি না। একই ভাবে ঝুঁকি নিয়ে দুষ্কৃতীদের প্রতিরোধে করার চেয়ে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে পালিয়ে যেতে দেখছি।”
বহরমপুরের বাজারে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি দিন কয়েক হাজার মানুষ আসেন। সরকারি বিভিন্ন দফতরে বিভিন্ন কাজে আসা মানুষের সংখ্যাও কম নয়। শহরের বহু মানুষের ধারণা, এই বহিরাগতেরা শহরের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম বোধ করেন না। কাজ সেরে কোনও মতে বাড়ি ফিরে যান। ঘটনার আঁচ তাঁদের মনন-মানসিকতাকে স্পর্শ করে না। রত্নাবলীদেবী বলেন, “বাজার এলাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনও ভাবাবেগ কাজ করে না। নিজের গ্রাম সম্বন্ধে আবেগ থাকলেও তাঁরাই আবার শহরে এসে পাল্টে যান। একই ভাবে পুর-নাগরিকদের পাড়াকে ঘিরে আবেগ থাকলেও ব্যবসা ক্ষেত্রের জায়গায় সেই ব্যক্তির পেশাদার মানসিকতা কাজ করছে। ফলে কোনও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে লুঠপাট চলতে দেখলে অন্য ব্যবসায়ী হয়তো দোকান বন্ধ রেখে এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছে দেখা যাবে। এই সমস্তই নগর জীবনের প্রভাব।”
চেম্বার অফ কমার্সের জেলা আধিকারিক অজয় সিংহ বলেন, “ওই ছিনতাইয়ের ঘটনায় এককাট্টা হয়ে ব্যবসায়ীদের পথে নেমে প্রতিরোধ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। এতে দুষ্কৃতীরা প্রশ্রয় পেয়ে গেল। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের এলাকা ভিত্তিক মনোভাবও দায়ী। নাগরিক সমাজের এই স্বার্থপরতার কারণে শহরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।”
সোমেশবাবু বলেন, “এক ধরণের সমাজ জীবনে এক সময়ে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন সেই সুযোগ নেই। বহির্জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে কাটানোর মতো এখন মানুষের অবস্থা। তাঁদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াই চলছে। ওই লড়াই যত জটিল হবে, নিঃসঙ্গতা-একাকীত্ব বাড়বে আর মানুষ ততো নির্লিপ্ত থাকবে। ফলে শহরের কোনও ঘটনা এখন আর পুর-নাগরিকদের বিচলিত করে না।” বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কৌশিক ঘোষ বলেন, “অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া উচিতমানবিক দিক থেকে এই ভাবনা কাজ করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষ কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছে। মানবিক গুণাগুণ বাড়ানোর একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।”
মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “আত্মকেন্দ্রীক হয়ে পড়ার কারণেই আমাদের মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এই কারণে মানবিক বোধও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজের ব্যস্ত জীবনের অনেকখানি সময় চলে যাবে বলে কোনও ঘটনায় এগিয়ে যাওয়ারও তাগিদ অনুভব করছে না সাধারণ মানুষ। ধ্বংসমূলক এই ভাবনায় সকলেই জারিত।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.