ফরাক্কা ব্যারাজের দু’টি লকগেট ভেঙে যে বাংলাদেশের দিকে হু হু করে জল বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা রাজ্য সরকারের নজরে আসার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠল।
বৃহস্পতিবার মুখ্যসচিব সমর ঘোষ বিষয়টি নিয়ে মহাকরণে নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ও রাজ্যের সেচ-সচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকের পরে কল্যাণবাবু বলেন, ফরাক্কা থেকে বাংলাদেশের দিকে চুক্তির তুলনায় অনেক বেশি জল বয়ে যাওয়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে বড় বিপদ দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে অচিরেই কলকাতা ও আশপাশে পানীয় জলের লবণাক্ত ভাব বেড়ে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। কল্যাণবাবুর ব্যাখ্যা: জোয়ারের সময়ে সমুদ্রের নোনা জল নদীতে ঢোকে। আর ভাটার টানে উপরের মিষ্টি জল এসে সেই লবণাক্ততা দূর করে। কিন্তু ফরাক্কার ফিডার ক্যানালে জল না-ঢোকায় ভাটার সময়ে উজান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে মিষ্টি জল এসে জোয়ারের জলের নোনাভাব কাটাতে পারবে না।
এ দিন বৈঠক সেরে মুখ্যসচিবের ঘর থেকে বেরিয়ে কল্যাণবাবু জানান, ফরাক্কা ব্যারাজে জলস্তরের উচ্চতা থাকার কথা ৭২ ফুট। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫.৮ ফুট। ফলে ফরাক্কার ফিডার ক্যানালে জল ঢুকছে না। তাই ভাগীরথীর জলস্তর কমতে শুরু করেছে। নবদ্বীপের উজানে নৌ-যান যেতে পারছে না। মালদহে গঙ্গার জলস্তর ইতিমধ্যে তিন থেকে চার ফুট নেমে গিয়েছে। ভাগীরথীর জলস্তর নেমে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জে নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। কারণ, স্তরের সমতা বজায় রাখার স্বভাবধর্ম মেনে ভূগর্ভের জল প্রচুর বালি সঙ্গে নিয়ে ভাগীরথীর দিকে বয়ে যাচ্ছে। আর বালির ধাক্কায় নদীর পাড়ের মাটি ভেঙে পড়ছে।
কিন্তু ফরাক্কার ভেঙে যাওয়া ১৩ ও ১৬ নম্বর লকগেটের মেরামতি শেষ হতে তো সময় লাগবে! তার আগে এই বিপর্যয় ঠেকানোর উপায় কী?
কল্যাণবাবু মনে করেন, এ হেন সঙ্কটের পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের উচিত আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিশেষ প্রযুক্তির সাহায্যে অবিলম্বে গেট দু’টি আটকে দেওয়া। লকগেট ভেঙে যাওয়ার জন্য তিনি ব্যারাজ রক্ষণাবেক্ষণের গাফিলতিকে দায়ী করে বলেন, “১৯৭৫ সালের ২১ মে ফরাক্কা ব্যারাজ চালু হয়েছিল। এত দিনে তার উপরে সময়ের প্রভাব পড়েছে।” আরও পাঁচ-ছ’টা গেটের অবস্থাও বেশ খারাপ বলে তাঁর অভিযোগ। এ দিকে ফরাক্কার পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে এসে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত। তাতে ঘটনাটির পিছনে ‘চক্রান্তের’ সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। যার ব্যাখ্যা হিসেবে রিপোর্টে তিনি বলেছেন, ‘ফরাক্কা ব্যারাজের ১৩ নম্বর গেট ভেঙেছিল গত বছরের ২৬ জুন। অথচ ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ সেটি মেরামতির জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দিয়েছেন সবে গত মঙ্গলবার। এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। এবং এই কারণেই চক্রান্তের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’
মণীশবাবুর রিপোর্ট বলছে, ‘এর পরে গত ৯ ডিসেম্বর ১৬ নম্বর গেটও ভেঙে যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা রাজ্য সরকারকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।’ এটিকে ‘অত্যন্ত দায়িত্বহীন কাজ’ বলে রিপোর্টে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শুখা মরসুমে তিস্তার উজান থেকে উত্তরবঙ্গে কত জল আসে, রাজ্য সরকারের তরফে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে যাচাইয়ের দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণবাবুকেই দিয়েছেন। সেই সমীক্ষার কাজ এখনও শেষ হয়নি বলে এ দিন জানিয়েছেন কল্যাণবাবু। |