ব্রিটিশ-মোগল ঘরানার ছিমছাম দোতলা বাড়ি। মাথায় ছোট গম্বুজ। সামনে প্রশস্ত সবুজ লন। ১৯০০ সালে পুরনো বাড়ি কিনে গড়েপিটে নতুন করে নিয়েছিলেন মতিলাল নেহরু। নাম দিয়েছিলেন ‘আনন্দ ভবন।’ পরে যা হয়ে উঠেছিল জাতীয় আন্দোলনের ভরকেন্দ্র। সে সময় গম গম করত এই বাড়ি। আজ অবশ্য নেহরু-গাঁধী পরিবারের স্মৃতিমাখা এক মিউজিয়াম।
গেট থেকে বেরিয়ে এলেই চাচার দোকান। বয়স হয়েছে। ভোটে কী হবে জানতে চাইলে, খুশবুদার কত্থা-কিমাম দিয়ে সাজা পান এগিয়ে বললেন, “এখানে কংগ্রেসের হাওয়া আছে বাবু। লড়কা মেহনত করছে।
ঘাম ঝরাচ্ছে!”
পাঁচ বছর আগেও চাচার কাছে এসেছিলাম। সে দিন বলেছিলেন, “বাবু বহেনজি এগিয়ে।” সেটা জানাতে তাঁর ‘দুখ্’ হয়েছিল। কিন্তু আজ যেন চাচার আবেগ বলছে। আনন্দ ভবনের চৌহদ্দিতে থাকলে হয়তো এমনটাই স্বাভাবিক।
গত এক সপ্তাহে লখনউ থেকে কানপুর, বেনারস, আজমগড়, জৌনপুর, মির্জাপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরেছি। তবে কংগ্রেসের ভোট সম্ভাবনার সুলুক সন্ধান করতে গিয়ে ফিরে আসতেই হল আনন্দ ভবনের দোরগোড়ায়। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের উত্থান শুধু নয়, পতনেরও স্মারক যেন এই ভবন। ইলাহাবাদের ফুলপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে জিততেন জওহরলাল নেহেরু। অথচ ফুলপুর লোকসভা আসন তো দূর-স্থান, বিধানসভা কেন্দ্রটিও এখন কংগ্রেসের হাতছাড়া। ইলাহাবাদের ১২টি আসনের মধ্যে এখন মাত্র একটিতে রয়েছে কংগ্রেস। অমেঠি-রায়বরেলীর হিসাব পরে হবে। নেহরুর ইলাহাবাদকেই ধরে রাখতে পারেনি যে কংগ্রেস, উত্তরপ্রদেশে তাঁর অস্তিত্বও তো এখন ওই মিউজিয়ামের মতোই।
অতএব চাচা যাঁকে সস্নেহে ‘লড়কা’ বললেন, সেই রাহুল গাঁধীর চ্যালেঞ্জ তা হলে এখান থেকেই শুরু। এবং রাহুলও সেই চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছেন। তিন মাস আগে উত্তরপ্রদেশে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু করেছিলেন ফুলপুর থেকেই। তা-ও নেহরুর জন্মদিনে।
তার পর থেকে টিভির পর্দায় নিশ্চয়ই রোজ তাঁকে দেখছেন। এক গাল খোঁচা দাঁড়ি। উত্তরপ্রদেশের আনাচেকানাচে দু’বেলা তাঁর ‘গুস্সা’ ঢেলে দিচ্ছেন।
কুর্তার হাতা গুটিয়ে কখনও বলছেন, ভিন্ রাজ্যে গিয়ে
আর কদ্দিন ভিক্ষা করবেন এখানকার মানুষ? আবার এ-ও বলছেন, দু’টো পাই বা দু’শো আসন, উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে যাব না। আপস হবে শুধু মানুষের সঙ্গে, চোর-গুন্ডার সঙ্গে নয়। ইত্যাদি।
কিন্তু এই ‘গুস্সা আর জেদ কতটা স্পর্শ করছে উত্তরপ্রদেশকে?
বেনারসের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ রাঘবেন্দ্র চাড্ডা বলছিলেন, “দেখে বোঝা যাচ্ছে, ‘দিল সে’ বলছেন রাহুল। তাঁর বক্তৃতায় সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার রাজনীতির প্রতিফলন রয়েছে।” রাঘবের সঙ্গে সহমত অনেকেই। তাঁদের নাম লিখে ভারাক্রান্ত না করে, এক কথায় বলা যায়, কংগ্রেস এ বার অন্তত আলোচনায় রয়েছে। তা সে গ্রামে হোক বা শহরে। ট্রেন-বাস, মন্দির-মসজিদ, গরিব-ধনী সর্বত্র। পাঁচ বছর আগে-পরের ফারাকটাও তাই স্পষ্ট। তবু হিন্দি হৃদয়খণ্ডের মন জয় কি সহজ কাজ! লখনউয়ে দিল খুশ যদি বিরিয়ানিতে, তবে বেনারসে কাম তামাম এক খিলি কিমাম-পানেই। অজস্র সমীকরণ ও কত না খুঁটিনাটি!
আনন্দ ভবনের লাগোয়া দোকানের চাচা ছোটবেলায় দেখেছেন নেহরুকে। আবছা হলেও সেই স্মৃতি এখনও রয়েছে। পুরনো কংগ্রেসি। তাই মানুষজনের আলোচনায় কংগ্রেসকে উঠে আসতে দেখেই আশা ঝিলিক দিচ্ছে তাঁর মনে। কিন্তু নেহরুর আমলে যাঁরা যুবক, তাঁদের অনেকেই এখন তো আর বেঁচেবর্তে নেই। পালাবদলে যাঁরা বড় ভরসা, সেই নবীনদের কি ছুঁতে পারছেন রাহুল?
জানতে গিয়েছিলাম কয়েকটি পেশাদার ট্রেনিং কলেজে। কানপুরে নিউলাইট কোচিং সেন্টার ও ইলাহাবাদের অগ্রবাল আকাডেমিতে। ক্লাস শুরুর আগে বাইরে ছাত্রদের জটলা। এঁদের বেশির ভাগই প্রথম বার ভোটার। এক বাক্যে সবাই স্বীকার করে নিলেন, “রাহুল তো সত্যিটাই বলছেন। উত্তরপ্রদেশে চাকরি-বাকরির সুযোগ কোথায়?
এমনকী, পড়াশোনার জন্যও অনেককে অন্যত্র ছুটতে হচ্ছে।”
তবে ভিন্ন মতও রয়েছে। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমেশ দীক্ষিতের মতে, “সন্দেহ নেই রাহুল কংগ্রেসকে আলোচনায় এনে দিতে পেরেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের জন্য শুভেচ্ছা ও সহানুভূতিকে ভোটে রূপান্তরিত করার মতো স্থানীয় নেতা কই? কর্মীরাই বা কোথায়। আর যাই হোক ময়দানে নিজেদের বেশ কিছু ক্যাডার নামাতে পেরেছেন মায়াবতী-মুলায়মরা।”
এই খামতি আড়াল করতেই যেন উত্তরপ্রদেশে নিজেকেই নেতা হিসাবে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছেন রাহুল। বুঝিয়ে দিচ্ছেন ভাল-মন্দ সব দায়ই তাঁর। রামচন্দ্র গুহের মতো রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা কিন্তু এটাকেই যথেষ্ট বলে মনে করছেন না। তাঁদের মতে, রাহুল বরং নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী পদের প্রার্থী হিসাবেই নিজেকে তুলে ধরতে পারতেন। এত বড় একটা রাজ্য। কুড়ি কোটি মানুষের বাস। রাহুলের কাছে এই প্রত্যাশাটুকু তাঁরা করতেই পারেন। রাহুল এটা করলে আরও বিশ্বাসযোগ্য হত তাঁর রাজনীতি। যেমনটা করেছিলেন নীতীশ কুমার।
এমনকী এমন মতও উঠে আসছে যে, রাহুল কার্যত যেন একটা খিচুড়ি রাঁধলেন। দলিতদের ঘরে রাত কাটিয়ে তাদের সহানুভূতি পেতে চাইলেন। স্যাম পিত্রোদাকে সামনে রেখে বার্তা দিতে চাইলেন অনগ্রসরদের। আবার সংরক্ষণের কথা বলে মন রাখতে চাইছেন মুসলিমদেরও। যেন কিছু দলিত, কিছু মুসলিম, আর কিছু অনগ্রসর ও উচ্চবর্ণের ভোট মিলিয়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট পেলেই মোক্ষ লাভ হবে। স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেস নেতারা তা মানতে রাজি নন। বরং তাঁরা বলছেন, রাহুল তো দায়িত্ব নিয়েছেন। শুধু রাহুল নন, গোটা গাঁধী পরিবারই শক্তি ঢেলে
দিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। অমেঠি-রায়বরেলীর বাইরে প্রিয়ঙ্কা প্রচারে যাননি ঠিকই। কিন্ত মায়াবতী-মুলায়মের বিরুদ্ধে তাঁর ঝাঁঝালো সব মন্তব্য রোজই প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে স্থানীয় খবরের কাগজগুলিতে। এখানকার টিভি চ্যানেলগুলিতেও ২৪ ঘণ্টা তা চলছে। সেই ‘গ্ল্যামারের’ কাছেই বা বাকিরা ঘেঁষতে পারছেন কোথায়!আর অবিশ্রান্ত ঘুরে চলেছেন রাহুল। ভোটের পর কারও সঙ্গে জোট না করার বার্তা দিয়ে চলেছেন। আঞ্চলিক সব শক্তির শাসনে অতিষ্ঠ উত্তরপ্রদেশবাসীকে কংগ্রেসের কাছে টানতে চাইছেন। গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস পেয়েছিল ৭ শতাংশ ভোট। লোকসভা ভোটে তা বেড়ে হয় ১৮ শতাংশ। এ বার লক্ষ্য, তা আরও বাড়ানো। সেই সঙ্গে অবশ্যই কংগ্রেসের আসন বাড়িয়ে উত্তরপ্রদেশে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠা।
এবং তাই, উত্তরপ্রদেশ জানাচ্ছে, এবার সব থেকে কঠিন লড়াইটা লড়ছেন রাহুলই। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের লড়াইয়ের থেকেও বুঝি কম নয় এই লড়াই। এ-ও তো জমি উদ্ধারেরই লড়াই। যে লড়াইয়ে ‘সাফল্য’ পেলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে পায়ের তলার জমিটা আরও শক্ত হয়ে উঠতে পারে গাঁধী পরিবারের নবীন প্রজন্মের এই নেতার। সে জন্য ঘাম তো ঝরাতেই হবে! |