বেড়াতে বেরিয়ে খিটিমিটি লেগেছিল স্বামী-স্ত্রীর। নিতান্তই তুচ্ছ সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে।
‘তোমার সঙ্গে আর ঘর করব না’ বলে মেয়ের হাত ধরে সোজা হাঁটা দেন সাহানা। কাছেই শিয়ালদহ স্টেশন। বৌ-মেয়েকে সেখানে ঢুকতে দেখে পিছু নেন শুভ্র।
এক্সপ্রেস ছাড়ছিল। দূর থেকে শুভ্র দেখেন, মেয়ে নিয়ে একটি কামরায় লাফিয়ে উঠলেন সাহানা। ভিড় ঠেলে যেতে-যেতেই ট্রেন হাওয়া।
কোন ট্রেন? শুভ্র নিজে খেয়াল করেননি। আশপাশের লোকজন জানায়, নিউ জলপাইগুড়ি যাওয়ার কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস। আরে, সাহানার বাপের বাড়ি তো শিলিগুড়িতে! সেখানেই চলল না কি?
খানিক ভেবে, ইতস্তত ঘোরাঘুরি করে শেষে সাহানার মোবাইলে ফোন করেন শুভ্র ‘তোমরা কোথায়?’ জবাব আসে, ‘দক্ষিণেশ্বর পেরিয়ে বালি ব্রিজে।’ কাতর কণ্ঠে শুভ্র বলেন, ‘কেন? কোথায় যাচ্ছ?’ যেন সাহানায় বেজে ওঠে তীক্ষ্ণ গলা, ‘আমি আর ফিরব না। হয় বাপের বাড়ি চলে যাব, নয় রেললাইনে মাথা দেব।’
শুনেই মাথা খারাপ শুভ্রর! চোখ অন্ধকার। হঠাৎ দেখেন, বিপদে-আপদে যাতে যাত্রীরা ফোন করতে পারেন, তার জন্য বোর্ডে জিআরপি-র নম্বর দেওয়া। বিধাননগরের এক কল সেন্টারের কর্মী শুভ্র বিলক্ষণ জানেন, ফোনের কত ক্ষমতা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই শিয়ালদহ রেলপুলিশের ফোন বেজে ওঠে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের এস-৩ কামরায় ৫২ ও ৫৩ নম্বর আসনের নীচে বোমা আছে!
বুধবার রাত ১০টা নাগাদ যখন হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে চন্দনপুর স্টেশনে আপ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, বোমার খবর কে দিয়েছে তা কারও জানা ছিল না। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি নাম বলেছিলেন ‘শুভ্র মুখোপাধ্যায়’। কিন্তু এ রকম অপকর্ম করে আসল নাম কে-ই বা বলে? আর নাম যদি সত্যিও হয়, তাকে পাওয়াই বা যাবে কোথায়?
ট্রেন দাঁড় করিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে তল্লাশি। বোমার নামগন্ধ নেই। হঠাৎই রেলপুলিশের এক কর্মীর কানে আসে, এক তরুণী মোবাইলে কাউকে বকাবকি করছেন। বলছেন, ‘কেন মিথ্যে বলতে গেলে যে ট্রেনে বোমা রয়েছে? কখন বর্ধমান পৌঁছব? এত রাতে মেয়ে নিয়ে কী করব? তুমি-ই বা কী করে এখন আসবে?’
ফোন শেষ হতেই রেলপুলিশের কর্মী গিয়ে জানতে চান অপর প্রান্তের মানুষটির নাম। সাহানা স্বামীর নাম বলেন। কী করে ঝগড়া করে তিনি চেপে বসেছেন ট্রেনে, তা-ও বলে যান গড়গড় করে। মুহূর্তে জলের মতো সব পরিষ্কার! রেলপুলিশ সাহানা আর তাঁর মেয়েকে বর্ধমানে জিআরপি থানায় নিয়ে যায়। রেলপুলিশের ওসি আশিসকুমার মজুমদার মা-মেয়ের রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সাহানাই তাঁদের জানান, শুভ্র বর্ধমানে আসছেন তাঁকে আর মেয়েকে নিতে। পুলিশ আর দেরি করেনি। মাঝরাত থেকে বারবার মাইকে ঘোষণা হতে থাকে, ‘শুভ্র মুখোপাধ্যায়, আপনি যদি স্টেশনে থাকেন, অবিলম্বে জিআরপি থানায় চলে আসুন। আপনার স্ত্রী ও মেয়ে আপনার অপেক্ষায় আছেন।’
মাঝরাত থেকে সাহানার ফোনে লাইন পাচ্ছিলেন না শুভ্র (রেলপুলিশ ফোন নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল)। বৃহস্পতিবার সকালে বর্ধমানে স্টেশনে নেমেই তাঁর কানে আসে ওই ঘোষণা। হন্তদন্ত হয়ে জিআরপি থানায় যেতেই পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। রাতভর স্বামীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন সাহানা। তাঁকে দেখেই সব রাগ ভুলে খুশি হয়ে উঠেছিলেন। পরমুহূর্তে তাঁকে গ্রেফতার হতে দেখে কেঁদে ফেলেন। পুলিশ তাঁকে নানা ভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। বিকেলে উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলায় তালবান্দা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে মা-মেয়েকে রওনাও করিয়ে দেয় তারা। চন্দনপুর স্টেশন যাদের আওতায় পড়ে, সন্ধ্যায় হুগলির সেই কামারকুণ্ডু রেলপুলিশের হেফাজতে পাঠানো হয় শুভ্রকে।
রাতে রেলপুলিশের ডেপুটি সুপার (সদর) ধীরাজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ট্রেন আটকানো, ভয় দেখানো ও মিথ্যা কথা বলার অভিযোগে ওঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে কাল উনি জামিন পেয়েও যেতে পারেন।”
বোমার উড়ো খবর দিয়ে নিজের আসল নাম বলতে গেলেন কেন?
হাতকড়া পরা হাত কপালে ঠুকে শুভ্র বলেন, “দূর মশাই! বউ-বাচ্চা নিয়ে চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন চলে গেলে কি আর মাথার ঠিক থাকে?”
|
(স্বামী-স্ত্রীর নাম পরিবর্তিত) |