জেলায় পরপর শিশুমৃত্যুর জন্য অপুষ্টিই একমাত্র কারণ নয় বলে জানাল চিকিৎসকদের রিপোর্ট। চলতি মাসের গোড়ায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজে ১৫টি শিশুর মৃত্যুর পরে প্রদেশ কংগ্রেসের তরফ থেকে একটি চিকিৎসকদলকে ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে পাঠানো হয়েছিল।
রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত ওই দল কলেজটি ঘুরে দেখে জানিয়েছে, বহু শিশু স্বাভাবিক ওজন নিয়ে জন্মেও রোগে ভুগে এবং ‘দুর্বল’ চিকিৎসা পরিকাঠামোর শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে। এমনকী যে সিক নিউ-বর্ন কেয়ার ইউনিটে (এসএনসিইউ) রুগ্ন শিশুদের থাকার কথা, শয্যা খালি থাকা সত্ত্বেও বহু রুগ্ন শিশুকে সেখানে রাখা হয়নি দেখে চিকিৎসকরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। যেমন, জন্মের সময়ে গোপালপুরের বাসিন্দা মণিমালা লায়েকের সন্তানের ওজন ছিল আড়াই কিলোগ্রাম। ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তার জন্ম হয়েছিল। সে মারা যায় সে দিনই রাত ৯টা ২০ মিনিটে। সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত এই শিশুটিকে কেন এসএনসিইউ-এ পাঠানো হল না? প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে উপচে পড়া ভিড়। ৭২টি শয্যায় ১৯৯টি শিশুকে রাখা হয়েছিল। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদেরও কেন এমন ভিড়ে ঠাসা ওয়ার্ডে রাখা হবে সেই প্রশ্নও উঠেছে। ১৫টি শিশুর মধ্যে তিনটি শিশু জন্মের পরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় মারা গিয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাননি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
অতএব মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে শিশুমৃত্যুর পিছনে অপুষ্টিকেই দায়ী করেছেন, চিকিৎসকদের রিপোর্ট কিন্তু তার সঙ্গে মিলছে না। পরিদর্শক দলের এক সদস্য তাঁদের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পরপর যে ১৫টি শিশুর মৃত্যু হয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র তিন জনের ওজন আড়াই কিলোর কম ছিল। দু’জনের ওজন ছিল ২২০০ থেকে ২৪০০ গ্রামের মধ্যে। ১০ জনের ওজন আড়াই কিলো থেকে তিন কিলোর মধ্যে। ওই চিকিৎসক-পরিদর্শক স্পষ্ট বলেন, “অপুষ্ট মায়ের সন্তান নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই জন্মাচ্ছে এবং কম ওজনের কারণে মারা যাচ্ছে, এই তত্ত্ব এই সব ক্ষেত্রে খাটছে না।” তাঁর কথায়, “আমরা হাসপাতাল ঘুরে প্রসবকালীন ব্যবস্থার যে ছবিটা দেখেছি, তা যথেষ্ট হতাশার। লেবার রুমে কোনও সিনিয়র চিকিৎসক থাকেন না। এমনকী বহু চিকিৎসক লেবার রুমে ডিউটি দিতে অস্বীকার করেন বলেও আমাদের কাছে খবর।”
প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসার ক্ষেত্রে যে বিশেষ যান চালু হয়েছে বলে সরকারি তরফে বলা হয়, তা নিয়েও পরিদর্শকেরা নানা অভিযোগ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এক পরিদর্শক বলেন, “হাসপাতালে আসার জন্য গাড়ি বা সেই বাবদ টাকা পাননি, এমনকী জননী সুরক্ষা যোজনার টাকাও হাতে পাননি এমন অভিযোগ ভুরি ভুরি। যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদেরও সেই টাকা আদায় করতে যে কার্যত জুতোর সুকতলা খইয়ে ফেলতে হয়েছে, সেই অভিযোগও আমরা পেয়েছি।” এক জন শিশু শল্যচিকিৎসক থাকা সত্ত্বেও বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগটি বহু বছর বন্ধ। তাই যে শিশুদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, তারা ফিরে যাচ্ছে। এ কথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও মেনে নিয়েছেন।
হাসপাতালের সুপার পঞ্চানন কুন্ডু স্বীকার করেছেন, শিশু চিকিৎসার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো তাঁদের নেই। তিনি বলেন, “গোটা বাঁকুড়া তো বটেই। রানিগঞ্জ, আসানসোল, দুর্গাপুর এমনকী পুরুলিয়া থেকেও রোগী আসে। এসএনসিইউ-এ ৩০টি শয্যা এবং নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে ১০টি শয্যা। কোথাওই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স নেই। লেবার রুমেও ডাক্তারের সংখ্যা কম।”
সুতরাং শুধু কম ওজনের শিশুরা মারা যাচ্ছে, ঘটনা তা নয় বলেই মনে করছেন প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “বাঁকুড়ার অবস্থা তো আমাদের পরিদর্শকেরা রিপোর্টে লিখেছেন। আমি নিজে মালদহ মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে দেখেছি, সেপ্টিসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে অন্য শিশুদের সঙ্গে এক শয্যায় রাখা হচ্ছে। এসএনসিইউ-এ দেখেছি যেখানে তিন জন শিশুপিছু এক জন নার্স থাকার কথা, সেখানে ৩২টি শিশুর জন্য তিন জন নার্স রয়েছেন।”
কংগ্রেসের পরিদর্শক দলের এই রিপোর্টকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি স্বাস্থ্য-কর্তারাও। লেবার রুমে পরিকাঠামোর সমস্যার কথা স্বীকার করে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলির দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, রাজ্যের মোট ৩০টি হাসপাতালের লেবার রুমের পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যাপারে বুধবারই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, “লেবার রুমের উন্নতি না হলে যে শিশুমৃত্যু কমবে না তা আমরাও মানি। তাই প্রথম দফায় ১০টি জেলা ও মহকুমা হাসপাতাল, তার পরে মোট ৩০টি হাসপাতালের পরিকাঠামো বাড়ানো হবে।” এই তালিকায় বাঁকুড়ার নামও রয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। |