একটানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে বিরোধী আসনে গিয়ে পথ চলার নতুন রাস্তা খোঁজাই আপাতত তাদের কাছে ‘অগ্নিপরীক্ষা’। পথের সন্ধানে নেমে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি সিপিএমের পরামর্শ, বিরোধী ভূমিকায় তৃণমূলের ‘অনুকরণ’ চলবে না!
কলকাতার প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে আজ, বুধবার থেকে সিপিএমের যে ২৩ তম রাজ্য সম্মেলন শুরু হচ্ছে, সেখানে পেশ করার জন্য তৈরি খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট দলের নতুন বিরোধী ভূমিকার উপরেই সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। গত কয়েক মাসে বিরোধী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যার মুখে দলকে পড়তে হয়েছে, তার বিশ্লেষণের পাশাপাশিই খসড়া রিপোর্টে উঠে এসেছে কঠোর আত্মসমালোচনা। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য দলকে বিরোধী ভূমিকায় যেতে হল, গত বিধানসভা নির্বাচনের পরে এ বারের রাজ্য সম্মেলনে তার আলোচনা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সম্মেলন-পর্বে প্রতিনিধিদের প্রবল আক্রমণের মুখে পড়তে হবে বুঝে নিয়েই বিগত বামফ্রন্ট জমানার ভুল-ত্রুটির দায় রাজ্য নেতৃত্বই নিজেদের ঘাড়ে নিয়েছেন। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম-সহ নানা ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা’র কথা উল্লেখ করে রিপোর্টে সরাসরিই এ বার বলা হয়েছে, ‘এ দায় বা দায়িত্ব ব্যক্তি ও কমিটি নির্বিশেষে রাজ্য স্তরের’। কোনও ব্যক্তির কথা পৃথক ভাবে উল্লেখ না-থাকলেও বাম জমানায় বেশ কিছু ঘটনার যে ভাবে সমালোচনা করা হয়েছে, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই তার লক্ষ্য বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা।
|
রাজ্য সম্মেলনের প্রস্তুতি। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র। |
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ‘রাজ্যে নতুন পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি গোটা অধ্যায় রাখা হয়েছে এ বারের সম্মেলনের দলিলে। যেখানে বলা হয়েছে, ‘নতুন পরিস্থিতির আর একটি উপাদান হল প্রায় চার দশক পরে পার্টিকে বিধানসভায় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে’। কিছু ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলে গিয়ে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় ঘাটতি ছাড়া গত আট মাসে সিপিএম বিরোধী ভূমিকা পালনে খুব পিছিয়ে নেই, এ কথাই বলতে চাওয়া হয়েছে রিপোর্টে। কিন্তু সেই সঙ্গেই ‘গঠনমূলক ও দায়িত্বশীল’ বিরোধী দল হওয়ার পথে সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেই সূত্রেই বলা হয়েছে: ‘দু’টি ভ্রান্ত ঝোঁকের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম না-করে এই সমস্যা মোকাবিলা করা অসম্ভব। এর মধ্যে একটি হল, তৃণমূল যে ভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছিল, তাকে অনুকরণ করার ঝোঁক। অপরটি হল, আত্মসমালোচনার নামে সরকার পক্ষের বামফ্রন্ট সরকার-বিরোধী বক্তব্যের যুক্তিনিষ্ঠ প্রতিবাদ করার পরিবর্তে কোনও কোনও ক্ষেত্রে কার্যত তার সঙ্গে সুর মেলানো’।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, বিরোধী শিবিরে থাকাকালীন তৃণমূল যে ভাবে সর্বদল বৈঠকে যেত না, উন্নয়নের কাজে ‘বাধা’ দিয়ে ‘ধ্বংসাত্মক’ ভূমিকা নিত, কোনও ‘প্ররোচনা’তেই যাতে দল সেই রাস্তায় না-হাঁটে, সেই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিতে চেয়েছেন রাজ্য নেতৃত্ব। পাশাপাশি, আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো কিছু নেতার কারণে-অকারণে দলীয় নেতৃত্বের ভুল-ত্রুটি নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা এবং সরকার পক্ষের সঙ্গে সেই সব সমালোচনার সুর মিলে যাওয়া যে আলিমুদ্দিন অনুমোদন করছে না দেওয়া হয়েছে এই ‘বার্তা’ও।
সম্মেলনের দলিল অবশ্য আত্মসমালোচনায় পিছিয়ে নেই। ‘ত্রুটি সংশোধন’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে এসেছে বাম সরকারের জমানায় শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহণ বিরোধী প্রচারের কথা। সেই সূত্রে বলা হয়েছে: ‘বিরোধী শক্তির এই কাজে ইন্ধন জুগিয়েছে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে দু-এক জন নেতার প্রকাশ্য উক্তি। এই সময়েই কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনকী সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কথাতেও দাম্ভিকতার সুর এসেছে। মিডিয়ায় অংশগ্রহণের সময় কোনও কোনও ক্ষেত্রে পার্টি অপেক্ষা ব্যক্তি চিন্তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এসেছে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামের শেষ হাতিয়ার সম্পর্কে (ধর্মঘট) প্রকাশ্যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি’। এই সমালোচনার লক্ষ্য যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবু, দলে তা নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই। এ ছাড়াও, সংবাদমাধ্যমের সামনে নেতৃত্বের ‘বক্তব্য ও ভঙ্গিমা’ নিয়ে প্রশ্ন, বামফ্রন্টের শেষ কয়েক বছরে ‘প্রশাসনিক শিথিলতা’, ‘আমলাতন্ত্রের অসহযোগিতা’র কথাও রিপোর্টে এসেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ-ও বলা হয়েছে, নন্দীগ্রামে ‘বিরোধী-সৃষ্ট নৈরাজ্য’ রুখতে প্রশাসনের ভূমিকা ছিল ‘অনাকাঙ্খিত’।
শুধু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বা জমির প্রশ্নে আটকে না-থেকে এ বারের সম্মেলনের দলিল সিপিএমের অন্যান্য ‘ব্যর্থতা’র দিকেও আলোকপাত করতে চেয়েছে। যেমন, প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো পরিষেবা ক্ষেত্রে ‘দলতন্ত্রে’র অভিযোগ। প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সূচকে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটলেও এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা জনগনকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিছু ক্ষেত্রে দলীয় সঙ্কীর্ণতা ও সমাজের বিভিন্ন অংশের শিক্ষানুরাগীদের সরকারি কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করার দুর্বলতা এবং বিরোধীদের কুৎসা ও অপপ্রচার জনগণের একাংশকে বামপন্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করেছে’। একই ভাবে স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়া হয়েছে: ‘পঞ্চায়েত ও পুরসভা ইত্যাদির কাজে যে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি বিবর্জিত সঙ্কীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, কোথাও কোথাও সততা ও স্বচ্ছতার অভাব শ্রেণি মিত্রদের মধ্যে বিভাজন’ সৃষ্টি করেছিল।
সাংগঠনিক ত্রুটির বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ২০১১ সালের পুনর্নবীকরণের পরে কোচবিহার (সর্বাধিক), নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, কলকাতা ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সিপিএমের সদস্যসংখ্যা কমেছে। সব চেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। যেখানে ২০০৮ সাল থেকেই জেলা পরিষদে তৃণমূল ক্ষমতাসীন। তথ্য পর্যালোচনা করে রিপোর্ট বলছে, এখন সিপিএমের ৯৬.৫% সদস্যেরই বিরোধী দলে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। তাঁদের খানিকটা সতর্ক করে দেওয়ার ঢঙেই বলা হয়েছে, নতুন সরকারের জমানায় ‘শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। এর অর্থ এই নয় যে, মানুষ সিপিএমকে পুনঃসমর্থন করছেন’। সম্মেলনে প্রতিনিধিরা স্বভাবতই বুঝতে চাইবেন, দলের সামনে আশু লক্ষ্য কী? খসড়া রিপোর্ট বলছে ‘আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচন, তা যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, হবে রাজনৈতিক সংগ্রাম। যাতে ভারসাম্য পরিবর্তনের প্রথম পরিমাপ হবে। ক্রমবর্ধমান হিংস্র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে ব্যাপকতম গণসমাবেশ ও গণপ্রতিরোধ কত দ্রুত গড়ে তোলা যায়, ২০১২ সাল হবে তার প্রস্তুতি পর্ব।... অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে’।
‘অগ্নিপরীক্ষা’য় উতরোনোর দাওয়াই খুঁজতেই আজ থেকে সরগরম হবে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবন! |